ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং-এ ভর করে মৌসুমের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের পরে দক্ষিণাঞ্চলের দড়জায় শীত কড়া নাড়ছে। মঙ্গলবার কার্তিকের শেষ প্রান্তে শরতের ভোরে বরিশালে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৮.১ ডিগ্রী সেলসিয়াসে নেমে এসেছে। যা আগের দিনের চেয়ে দশমিক ৫ ডিগ্রী এবং স্বাভাবিকের চেয়ে দশমিক ৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস কম ছিল। ফলে মঙ্গলবার সকালে অনেককেই গরম কাপড় আর কানটুপি পড়ে ঘর থেকে বের হতে দেখা গেছে। শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে এসময়ে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের তাগিদ দেয়া হয়েছে। বিশেষকরে করোনা ও ডেঙ্গু আক্রান্তদের এসময়ে ঠান্ডা এড়িয়ে বাড়তি সতর্কতার সাথে রাখতে বলেছেন চিকিৎসকগন।
বছর যুড়ে বৃষ্টিপাতের আকালের পরে সদ্যসমাপ্ত অক্টোবরে বরিশালে স্বভাবিকের চেয়ে প্রায় ১৫০% বেশী বৃষ্টি হয়েছে। যা আগের মাসেও ছিল স্বাভাবিকের ৬.৬% বেশী। চলতি বছরের শুরু থেকে আগষ্ট মাস পর্যন্ত দক্ষিণাঞ্চল স্বাভাবিক বৃষ্টির মুখ দেখেনি। কিন্তু সেপ্টেম্বরে স্বাভাবিক ৩১৬ মিলিমিটারের স্থলে ৩৩৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছিল আবহাওয়া বিভাগ। আর গত মাসেই স্বভাবিক ১৭৬ মিলিমিটারের স্থলে ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’এ ভর করে বরিশালে ৪৪১ মিলি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। যা স্বাভাবিকের ১৪৯.৯% বেশী বলে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে। অথচ দক্ষিণ উপক’ল থেকে বর্ষা মাথায় করে দক্ষিণÑপশ্চিম মৌসুমী বায়ু বিদায় নিয়েছে গত ২০ অক্টোবর। কিন্তু সিত্রাং-এ ভর করে ২৪ অক্টোবরই বরিশালে ৩৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং গত ২৪ অক্টোবর মধ্যরাতের মধ্যেই দূর্বল হয়ে ভোলা ও হাতিয়াÑসন্দ্বীপ উপক’লে মেঘনা নদী দিয়ে মূল ভ’খন্ডে আছড়ে পরে। কিন্তু উপক’ল আঘাত হানার আগেই সিত্রাং-এ ভর করে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালা উপক’ল হয়ে দক্ষিণাঞ্চলে ধেয়ে এসে ২৪ অক্টোবর দিনভর প্রবল বর্ষনে সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল সহ উপক’লভাগকে সয়লাব করে দেয়। সে বর্ষণ থেমে যাবার পরেই দক্ষিণষাঞ্চলের তাপমাত্রার পারদ প্রতিদিন নামতে শুরু করে।
তাপমাত্রার পারদ ক্রমশ হৃাস পেয়ে মঙ্গলবার স্বাভাবিকের দশমিক ৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস নিচে নেমে আসে। তবে দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা স্বাভাবিকের ওপরে রয়েছে। সোমবার দুপুরে বরিশালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৩১.২ ডিগ্রী সেলসিয়াস। অথচ আবহাওয়া বিভাগের মতে, এমাসে বরিশালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকার কথা ২৯.৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস।
আবহাওয়ার এ তারতম্য দক্ষিণাঞ্চলে জনস্বাস্থ্য সহ কৃষি ব্যবস্থায়ও বিরূপ প্রভাব ফেলার আশংকা বৃদ্ধি করছে। গত মাসে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং-এর প্রভাবে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি ব্যবস্থায় আবার বড় বিপর্যয় ডেকে এনেছে। গত মে মাসের ঘূর্নিঝড় ‘অশনি’র প্রভাবে এ অঞ্চলে আউশ ও তরমুজের সাথে গ্রীষ্মকালীন সবজির ব্যাপক ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার আগেই সিত্রাং দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান দানাদার খাদ্য ফসল আমনেরও ব্যাপক ক্ষতি করেছে। তবে আমনের জমি থেকে দ্রুতি পানি সরে গেলেও এ অঞ্চলের শীতকালীন সবজির পুরোটাই বিনষ্ট হয়েছে। কারণ প্রবল বর্ষনে পুরো দক্ষিণাঞ্চলে কোথাও এক বর্গ ইঞ্চি ফসলী জমিও প্লাবন মূক্ত ছিল না।
গত এপ্রিলে বরিশাল সহ দক্ষিণাঞ্চলে স্বাভাবিক ১৩২ মিলিমিটরের স্থলে মাত্র ১৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। যা ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে ৮৫.৬% কম। মে মাসেও আবহাওয়া বিভাগ বরিশালে স্বাভাবিক ২৬০ মিলিমিটারের স্থলে ২৪৫ থেকে ৩১০ মিঃমিঃ পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিলেও বাস্তবে বৃষ্টি হয়েছিল স্বাভাবিকের চেয়ে ৫.৬% কম । অথচ ঐ মাসেই ঘূর্ণিঝড় ‘অশনি’তে ভর করে ৭ থেকে ১১ মে পর্যন্ত অতি বর্ষণে তরমুজ সহ বিভিন্ন রবি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জুনে স্বাভাবিক ৪৮৩ মিলিমিটারের স্থলে আবহাওয়া বিভাগের পূর্বাভাস ছিল ৪৬০ থেকে ৫১০ মিলি। কিন্তু ঐ মাসে বৃষ্টিপাতের পরিমান ছিল স্বাভাবিকের ৪৪.৪৫% কম, ২৬৮.৫ মিলিমিটার। জুলাই মাসেও স্বাভাবিকের প্রায় ৬৫% কম বৃষ্টিপাতের পরে আগষ্টেও বরিশালে স্বাভাবিকের ১৬.৪% কম বৃষ্টি হয়েছে। ঐ মাসে বরিশালে ৪৩৩ মিলিমিটারের স্থলে ৩৬২ মিলি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়।
মৌসুমের প্রায় পুরেটা যুড়ে অনাবৃষ্টির পরে গত মাসে প্রবল বর্ষনে ফসল সহ জনজীবনে বিপর্যয় সৃষ্টি করে এখন তাপমাত্রা আগে ভাগেই স্বাভাবিকের নিচে নেমে যাওয়ায় সামনে কি পরিস্থতি সৃষ্টি হয়, তা নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি যোদ্ধাগন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন