দেশে বর্তমানে মূল্যস্ফীতি লাগামহীন, যা থেকে শিগগিরই উত্তরণের লক্ষণ নেই। এমন বাস্তবতায় কলেজ বিশ^বিদ্যালয়ের নিম্ন আয়ের শিক্ষার্থীরা খাদ্য ব্যয় কমিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছে। মূল্যস্ফীতির ব্যাপক প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের খাবারে। মাসে একবার গরুর গোসত খেতে হিমসিম খেতে হচ্ছে তাদের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ^বিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে তিন ধরণের শিক্ষার্থীরা থাকেন। এদের কেউ নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান, কেউ মধ্যবিত্ত আর কেউ উচ্চবিত্ত পরিবারের। তাদের কেউ কেউ রাজনৈতিক কর্মী আবার কেউ সাধারণ শিক্ষার্থী। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা শিক্ষার্থীদের আচরণে বোঝার উপায় নেই যে দেশে দ্রব্যমূল্য অতিমাত্রায়। অন্যদিকে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সাধারণ শিক্ষার্থীদের খাবারের তালিকা ক্রমেই কমছে। আগে যেই শিক্ষার্থী দিনে দুইটা ডিম খেত সে এখন খাচ্ছে একটা। কারণ কিছুদিন আগেও একটি সিদ্ধ হাসের ডিম পাওয়া যেত ২০ টাকায় কিন্তু তা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ টাকায়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে এক হালি সিদ্ধ ডিম বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়। গত এক বছর আগেও ঢাবি ক্যাম্পাসে শীতকালীন চিতল পিঠা বিক্রি হতো ৫ টাকায়। কিন্তু সেই পিঠাই এখন বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকায়। তাও আকারে হয়েছে ছোট। কেন্টিন, মেস, দোকানের খাবারের মূল্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় প্রতিটি খাবারের মূল্য ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে স্থীর আয়ের এসব মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শিক্ষার্থীরা দূর্বিষহ জীবন পার করছে। অপরদিকে কেন্টিনের খাবারের মান নিয়ে তো অভিযোগের শেষ নেই। যদিও ক্যান্টিন মালিকদের দাবি লাগামহীন মূল্যস্ফীতির কারণে স্বল্প মূল্যে ভালো খাবার পরিবেশন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের মুহসীন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী রিফাত বলেন, আগে যেখানে ২০ থেকে ২৫ টাকার মধ্যে সকালের নাস্তা সারতে পারতাম সেটা এখন ৩০ টাকায়ও পারছি না। এক প্লেট নুডলস খেতেই খরচ করতে হচ্ছে ৪৫ টাকা। সকালে ভাত ডিম খেতেই লাগছে ৩৫ টাকা। দুপুর ও রাতের খাবারে লাগছে ৫০ টাকা করে। এর বাইরে যদি অতিরিক্ত একটা ডিম কিংবা এক গ্লাস দুধ খেতে চাই তাহলে ভাঙতে হচ্ছে আরো ২৫ থেকে ৪০ টাকা। সবমিলিয়ে দিনশেষে শুধু খাওয়ার পেছনেই খরচ হচ্ছে অন্তত ১৫০ টাকা। দেখা যাচ্ছে খুব সাদামাটাভাবে চলতে গেলেই মাস পেরুয় না ৫ হাজার টাকায়। অথচ বছর খানেক আগেও ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজারের মধ্যে চলা যেতো। আমাদের ব্যয় বাড়লেও ইনকাম তো বাড়েনি। টিউশনি করে আগে যত টাকা পেতাম এখনো তো সেই টাকাটাই পাচ্ছি।
জানা যায়, বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ নিজেদের ব্যয়ভার নিজেরাই বহন করে থাকে। টিউশন থেকে যে শিক্ষার্থীরা খরচ জোগাতো তাদের অনেকেই এখন আয় ব্যয়ের হিসেব মিলাতে হিমসিম খাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের ভাষ্যমতে দেশে সামগ্রীকভাবে লাগামহীন মূল্যস্ফীতির কবলে পড়ে অনেক পরিবারই এখন খরচ কমাতে বাধ্য হয়েছে। করোনায় অনেক পরিবার তাদের চাকরি হারিয়েছে। জনজীবন বিপর্যস্ত প্রায়। এমতাবস্থায় অনেক শিক্ষার্থীই টিউশনি হারিয়েছে আবার অনেকেই ঠিকমতো তাদের বেতন পাচ্ছে না।
সরকারি হিসেবেই গত সেপ্টেম্বরে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ১০ শতাংশ। তার আগের মাস আগস্টের চিত্র ছিল আরো ভয়াবহ। মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ, যা গত ১৩৫ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। মূল্যস্ফীতির বিপরীতে সেপ্টেম্বরে মজুরি বেড়েছে ৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ আর তার আগের মাস আগস্টে তা ছিল ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ। এর অর্থ হচ্ছে দেশে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির বিপরীতে মানুষের আয়ও কিছুটা বেড়েছে। তবে অর্থনীতির এই চার্ট মিলে না শিক্ষার্থীদের আয় ব্যয়ের হিসেবে। গত এক বছর আগে যেই শিক্ষার্থী ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা আয় করে পড়াশোনার খরচ চালাতো সেই শিক্ষার্থী এখনো একই আয়ের উপর আছে। অনেকের ক্ষেত্রে তা আরো কমেছে।
সলিমুল্লা মুসলিম হলের শিক্ষার্থী জাকির হোসেন বলেন, ক্যান্টিনের খাবারের মান অত্যন্ত নিম্নমানের হওয়ায় প্রায়ই শিক্ষকরা আমাদের পরামর্শ দেন রেগুলার খাবারের বাইরে কিছু দুধ ডিম কিনে খেতে। কিন্তু বর্তমানে দুধ, ডিমের যে মূল্য তা আমাদের মতো সীমিত আয়ের শিক্ষার্থীদের পক্ষে জোগান দেয়া দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে।
হলের শিক্ষার্থীদের মাস শেষে রুম ভাড়া দিতে হয় না। তবুও তাদের খরচ চালাতে হিমসিম খেতে হয়। আর যারা রাজনৈতিক কিংবা আবাসন সংঙ্কটের কারণে হলের বাইরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন তাদের জীবন আরো দুর্বিষহ হয়ে পড়ছে। মুয়াজ আহমেদ নামের ঢাবির এক শিক্ষার্থী জানান, আজিমপুরে একটি ভাড়া বাসায় থাকেন তিনি। যেখানে ৩ জনকে মাস শেষে শুধু রুম ভাড়া দিতে হয় ১২ হাজার টাকা যা জনপ্রতি হয় ৪ হাজার টাকা করে। ওই শিক্ষার্থী বলেন, একটা মাত্র টিউশনি করে চলি। মাস শেষে শুধু বাসা ভাড়া দিতেই শেষ হয় রোজগারের অর্ধেক। এদিকে লাগামহীন মূল্যস্ফীতি। ফলে বাধ্য হয়েই খাবার কমিয়েছি। পুরো অক্টোবর মাসে একদিনও গরু মাংস কিনার সাহস পাইনি।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর মো. খুরশিদুল জাহিদ (পিএইচডি) বলেন, দেশে সামগ্রীকভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়ার কারণে সবার হাতেই এখন লিমিটেড অর্থ রয়েছে। যার ফলে শিক্ষার্থীদেরও কষ্ট করেই চলতে হচ্ছে। তবে ক্যান্টিনে যে খাবারটা এখন ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে কোনভাবে ভর্তুকি দিয়ে হলেও তা ৪০ টাকায় আনতে পারলে কিন্তু তাদের ১০ টাকা সেভ হচ্ছে। এছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সহায়তায় যদি মৌসুমি ফসল স্বল্প মূল্যে আনা যায় তাহলে স্বল্প মূল্যে খাবার পরিবেশন করাও সম্ভব। কারণ গ্রামে যে ফসলটা ১০ টাকায় পাওয়া যায় তা এখানে ৫০ টাকা। অনলাইনের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ফসল নিয়ে আসা খুব কঠিন কিছু না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন