ড. আশরাফ পিন্টু : ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে বাঙালির যে স্বাধীকার চেতনার সূত্রপাত ঘটেছিল সেই চেতনা সঞ্চারিত হয়েছে ১৯৭১ পর্যন্ত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা অর্জন একুশের চেতনারই এক সফল প্রতিসরণ। আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে মুক্তিযুদ্ধের রয়েছে অসামান্য অবদান স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে কাব্য কবিতায় স্বদেশ প্রেমের যে অকৃত্রিম স্ফুরণ দেখা যায় তা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধেরই ফল। এই মুক্তিযুদ্ধের ফলেই সাহিত্যে একটি স্বতন্ত্র ধারায় বিকাশ ঘটে যা এ দেশের মা মাটি মানুষের কথা বলে।
ওমর আলীর কাব্য কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের এক সুনিপুণ আলেখ্য চিত্রায়িত হয়েছে। তার প্রায় প্রতিটি কাব্যগ্রন্থেই রয়েছে মাতৃভূমি, মাতৃভাষা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কবিতা। এছাড়া ‘স্বাধীনতার কবিতা’ শিরোনামে তার একটি স্বতন্ত্র কাব্যগ্রন্থ রয়েছে। এসব কবিতায় পাওয়া যায় স্বদেশ প্রেমের উপলব্ধির সচকিত উচ্চারণÑ
পান্তাভাত পেঁয়াজ কাঁচামরিচ অথবা আগুনে পোড়ানো
শুকনো লালমরিচ আর একটু ফ্যাঁকসে লবণ
পরিতৃপ্তি এই তো আমার বাংলাদেশ
কমদামি তাঁতের শাড়ি ছাপাকাপড় গ্রীষ্মের দুপুরে
বাঁশ বাগানের সুশীতল ছায়া আম নিম কাঁঠাল গাছে
জাম গাছে পেয়ারার ডালে সুকন্ঠ পাখি দিনভর...
(পান্তাভাত কাঁচামরিচ এই তো আমার বাংলাদেশ)
স্বাধীনতা কি? সাধারণ মানুষ স্বাধীনতার প্রকৃত সংজ্ঞা জানে না। তারাÑ
খুব একটা বেশি কিছু চায়না কারো কাছে
দোচালা ঘরের ডোয়াগুলো মাটি ও গোবর
পানিতে গুলিয়ে পাট মুঠো করে দু-চারদিন পরেই মসৃণ শুধু লেপা
উঠোনে খোলা চুলোয় অ্যালুমিনিয়ামের পাতিলে
দুটো চালসিন্ধকরা লবণ মরিচ দিয়ে শাকভাজা
(আয়াতুন নেসার স্বাধীনতা)
কিন্তু এমন অকৃত্রিম স্বাধীনতাকে ভূলুণ্ঠিত করে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী। তারা এ দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষগুলোকে এতটুকু শান্তিতে থাকতে দিতে চায়নি। তারা-
যাকে তাকে মারছে ঘরদোর দিচ্ছে পুড়িয়ে লুটে নিচ্ছে
নারীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ নরপশু দুর্বৃত্ত হানাদার
পাকিস্তানিদের অত্যাচারের প্রতিশোধ ছাড়তে হবে নিয়ে
এদের বিবেকে বাঁধেনি মাসুম শিশুকেও হত্যা করতে আর ...
(বিজয় দিবসে উত্তরাকে)
এমাতাবস্থায় কবি স্বাধীনতা প্রাপ্তিকে নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত। এই অত্যাচার এই পরাধীনতা কবে শেষ হবে? এই দুঃসহ সময় কাটতে চায় না কিছুতেই। তাই সাড়ে সাত কোটি বাঙালির ব্যথাতুর হতাশার সুর যেন বেজে উঠে কবির কবিতায়-
আমি কি আমার স্বাধীনতা পাবো কোনদিন খাঁটি ও নিখাঁদ
মনে হয়েছিল আর আমার ঠোঁটের সামনে ফুল ফুটবে না।
সাদা দু’দিনের চাঁদ জুঁই বেলী মল্লিকা ধুতরা কোনোদিন
আমার পায়ের নিচে সেই প্রিয় পথ থাকবেনা চিরচেনা
গ্রীষ্মের মাঠের মধ্যে আর কি ডাকবে সেই বিটপি প্রাচীন
আমার শহর গ্রাম মনে হয়েছিল ছেড়ে যাচ্ছি শেষবার
দিনের আলোতে ভয় আর রাতের ভূতের ভয়াল অন্ধকার।
(আমি কি আমার স্বাধীনতা পাবো)
কিন্তু বাঙালি ভীত জাতি নয়, বীরের জাতি। শত অত্যাচারেও তারা দমবার পাত্র নয়। তারা মনোবলকে সুদৃঢ় করে নিজেদেও তৈরী করে। বৃদ্ধ তরুণ যুবক সকলেই স্বাধীনতার বীজমন্ত্রে দীক্ষিত হয়। কিন্তু অত্যাচারিত মজলুম জনতার হাত রিক্ত এমনি একজন জনতার দীপ্ত উচ্চারণ-
আগ্নেয়ান্ত্র নেই, ছুরি নেই, বেয়োনেট নেই,
আমার ওসব কিছুই নেই
আমার একটাই অস্ত্র আছে
অভিশাপ।
আমার বিশ্বাস
তুমি বলতে পার-অন্ধবিশ্বাস
এ অস্ত্র থেকে পাবে না রেহাই
এবং হবে না কথার খেলাপ
এই মারণাস্ত্রে ঠিকই ধ্বংস হবে
মূর্তিমান পাপ
আমার একটাই অস্ত্র আছে
অভিশাপ।
(অভিশাপ)
শুধু অভিশাপ নয়, যুদ্ধে জেতার জন্যে সশস্ত্র সংগ্রামেরও প্রয়োজন হয়; প্রয়োজন হয় সম্মুখ সমরের। আর এ জন্যেই আমাদের তরুণ যুবকরা সংশপ্তক মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে হানাদার পাক সেনাদের উপর। ফলশ্রুতিতে আসে আমাদের মহান স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধের চরম বিজয়-
আমরা আগুনের ক্রুদ্ধ মুঠো ছুড়ে দিয়েছিলাম
হানাদারদের মুখে তাদের বাধ্য করেছিলাম নতমস্তকে
আত্মসমর্পণ করতে রেসকোর্স মাঠে
এইতো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চরম বিজয়
আমরা বন্ধুকের নলে উড়িয়ে দিয়েছিলাম
স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা প্রথম বিজয়ের গর্বিত পতাকা
উত্তরা তার অভিমন্যুকে হারিয়েছে চিরকালের মতো ঠিকই
কিন্তু কতো উত্তরা আজ সুখী সংসারে অভিমন্যুকে নিয়ে ...
ত্রিশ লক্ষ মানুষের রক্ত আর অজস্র মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা যে স্বাধীনতা পেয়েছিলাম সে স্বাধীনতার স্বাদ কি প্রতিটি বাঙলির ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে পারছি? নাকি ফিরে যাচ্ছি সে পাক হানাদারদের চিরচেনা হত্যা জুুলুম আর অত্যাচারের দিকে! বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপট যেন পাওয়া যায় “বিপদাপন্ন স্বাধীনতা” শিরোনামের কবিতাটিতে-
স্বাধীনতা স্বাধীনতা বিপদাপন্ন স্বাধীনতা দাকোপে
সুন্দরবনে আগুন বাঘের মুখে চিত্র হরিণ
ছুটছে ছুটছে ছুটছে ভয়ে অরণ্য কাঁপিয়ে
দ্রৌপদী ছুটছে আর দাকোপের যুবতী রহিমা পালাচ্ছে সম্ভ্রম প্রাণ নিয়ে
একদল রক্তলোপী মাংসলোভী তেড়ে আসে স্বপ্নে জাগরণে রাতদিন
বিপদাপন্ন স্বাধীনতা সুন্দরবনের চিত্র হরিণ
বৃত্রাসুর দৈত্যরা দখল করে ঢাকা ও পাবনা শহরের অলিগলি
কমল শিশুর মাংস পোরে ইস্পাতে পুড়িয়ে
দীর্ঘ চুল দাঁড়ি আর সাধু-সন্ত মানুষকে ক্রুশে
বিদ্ধ করছে মচ্ছবে দিচ্ছে নরবলি।...
ওমর আলী মূলত রোমান্টিক প্রেমের কবি হলেও জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের মত এত বড় একটা ঘটনা তাঁর কাছে উপেক্ষিত হয়নি। তিনি যুগ ও কাল সচেতন কবি বলেই তাঁর বিদগ্ধ কবিআত্মা একাত্মতা ঘোষণা করেছিল ১৯৭১ সালের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে। জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের মহান আত্মত্যাগ ও ডিসেম্বরের বিজয়ের মহিমা তাঁকে আন্দোলিত করেছিল এবং কলমের আঁচড়ে তা বাঙময় হয়ে উঠেছে তাঁর অসংখ্য কবিতায়। জাতীয়চেতনা তথা দেশপ্রেম, কাক্সিক্ষত দেশ ও তার স্বাধীনতা স্বপ্নসাধ হয়ে উঠেছে তাঁর কবিতায়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন