শেরপুর গারো পাহাড়ে ৩৫ বছরে সরকারি হিসাবে হাতির পায়ে পৃষ্ট হয়ে মারা গেছে ৫৪ জন। অহত ৭ শতাধিক। হাতি মাড়া পড়েছে ৩২ টি। তবে বেসরকারি হিসেবে মৃত্যের সংখ্যা ও ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশী বলে জানান পাহাড়ি লোকজন। সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ির মানুষের বন্যহাতিই জীবন-মরণ সমস্যা। একদিকে হাতির বোবা কান্না, অন্যদিকে মানুষের মৃত্যুর মিছিল বাড়ায় আতংকে দিশেহারা হাজার হাজার পাহাড়ি মানুষ। মানুষ ও হাতি রক্ষায় সকল আয়োজন ভেস্তে গেছে।
শেরপুর বন বিভাগের তথ্যানুযায়ী, ১৯৯৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত হাতির আক্রমণে ৫৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ৭ শতাধিক। হাতি মারা পড়েছে ৩২টি। ২০১৪ সালের পরই মানুষ-হাতি যুদ্ধে দু’পক্ষেরই মৃত্যুর মিছিল বড় হচ্ছে। ক’দিন আগেও নালিতাবাড়িতে ১ জন ও ৫ নভেম্বর ঝিনাইগাতীতে ১ কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। ৪ নভেম্বর রাতে ঝিনাইগাতী পাহাড়ে ১টি বাড়ি ভাঙচুর করেছে হাতি। গত ৮ বছরেই হাতির আক্রমণে মারা গেছে ২৯ জন। হাতি মারা গেছে ২৮টি। ৩ উপজেলার ২ হাজার একর জমির ফসল, ঘরবাড়ি, গাছপালাসহ কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট করছে ফি-বছর।
স্থানীয়দের দাবি, মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি সরকারি হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি। বন বিভাগ জানায়, হাতির সংখ্যা ১০০’র ওপরে। পাহাড়িদের মতে ২ শতাধিক। সীমান্তবর্তী ৮ হাজার ৩৭৬ একর বনভূমি জুড়ে হাতির আবাসস্থল। ১৯৯৫ সালে ২০ থেকে ২৫টি হাতি ভারতের মেঘালয় রাজ্য থেকে এ পাড়ে আসে। কাঁটাতারের বেড়া ও (বিএসএফ)’র বাঁধায় আবাসস্থলে ফিরতে পারেনি হাতি। ধান ও কাঁঠালের মৌসুম ছাড়াও খাদ্যের সন্ধানে প্রায়ই লোকালয়ে আসে। কয়েক পালে বিভক্ত হয়ে ঝিনাইগাতী শ্রীবরদী, নালিতাবাড়ি থেকে শুরু করে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ৬০ কিলোমিটার সীমান্তজুড়ে তান্ডব চালিয়ে চষে বেড়ায়। ফসল ও বাড়িঘর রক্ষায় এলাকাবাসী জীবন বাজিরেখে মশাল জ্বালিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে হইহুল্লোড় করে তাড়ানোর চেষ্টা করেন। ঝিনাইগাতীর নওকুচি গ্রামের শ্রী ধীরেন্দ্র কোঁচ, জাগেন্দ্র কোঁচ ও যুগল কিশোর কোঁচ জানান, হাতি দুই-তিন পালে বিভক্ত হয়ে খাবারের সন্ধানে গোটা পাহাড় চষে বেড়ায়। লোকালয়ে তান্ডব চলায়। তাড়াতে গেলেই ঘটে দুর্ঘটনা। ২০১৪ সালে হাতি তাড়াতে সীমান্তে ১৩ কিলোমিটার সৌরবিদ্যুৎ সংযোগে বেড়া (বায়োলজিক্যাল ফেন্সিং) প্রকল্প করে বন বিভাগ। ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ি উপজেলায় হাতির বিচরণক্ষেত্রে বেড়া নির্মাণ করে। ২০১৫ সালে ঝিনাইগাতীর তাওয়াকুচা ও কর্নঝুড়ায় ১০০ হেক্টর বনভূমিতে হাতি খাদ্যের বাগান করে। তাওয়াকুচা, ছোট গজনী, বড় গজনী, হালচাটি ও মায়াঘাসিতে ১৩ কিলোমিটারজুড়ে লেবু ও বেত বাগান করে। হাতি পর্যবেক্ষনে সীমান্তে ১৬টি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার নির্মাণ করে। পাহাড়ি গ্রামে চার্জার লাইট, টর্চলাইট ও জেনারেটর বিতরণ করে কোটি কোটি টাকা ব্যায়ে।
এ সব আয়োজনে বন বিভাগের বাণিজ্য হলেও সব পরিকল্পনাই ভেস্তে যায়। পাহাড়িরা বলেন, হাতির আক্রমণে মানুষ মরলে ৩ লাখ, আহত হলে ১ লাখ ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হলে ৫০ হাজার টাকা দেন। এ টাকা একেবারেই কম। মারা গেলে ক্ষতিপূরণ ১০-২০ লাখ টাকা করা উচিৎ। নালিতাবাড়ির পানিহাটা বিশপনগর গ্রামের কবির চিসিম (৬৫) বলেন, হাতি তাড়াতে মানুষের মৃত্যু হয়। হাতিও মারা পড়ে। হাতিইবা কী করবে? পাহাড়ে হাতির খাওন অইলে লোকালয়ে আইতনা। হাতি ও মানুষের উপকার অইত। তাড়াইবার গিয়া মরলে পরিবারের যে ক্ষতি হয়, এই অল্প টেহায় চলে না। ক্ষতিপূরণ বাড়ানো দরকার। বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে হাতি হত্যায় সর্বোচ্চ ৭ বছরের কারাদন্ড ও সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা অর্থদন্ডের আইন রয়েছে। পুনরাবৃত্তিতে সর্বোচ্চ ১২ বছর কারাদন্ড ও ১৫ লাখ টাকা অর্থদন্ডের বিধান আছে। গত বছর ডিসেম্বরে শ্রীবরদী পাহাড়ে সবজিবাগানে সংযোগের বৈদ্যুতিক জিআই তারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠে ১ হাতি মারা যায়। বন বিভাগ আদালতে মামলা করে। হাতি মৃত্যুতে এটাই প্রথম মামলা।
এ প্রসঙ্গে বন বিভাগের ময়মনসিংহ, জামালপুর ও শেরপুরের দায়িত্বের সহকারী বন কর্মকর্তা আবু ইউসুফ বলেন, গত বছর থেকে এ পর্যন্ত ৪ হাতির মৃত্যু হয়েছে। একটি মামলা হয়েছে। বাকি ৩ হাতি মৃত্যুর আলামত পরীক্ষায় পাঠানো হয়েছে। হাতি মৃত্যুতে থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। ময়মনসিংহ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ কে এম রহুল আমিন বলেন, হাতি রক্ষায় ও সমতলে আসতে বাধা দেওয়ায় বন বিভাগ বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। সীমান্তবর্তী মানুষের সচেতনতায় প্রচারণা চালছে। হাতি বনে থাকবে, সেই বনে মানুষ বসতি গড়ে হাতিকে প্রতিপক্ষ বানিয়েছে।
এ ব্যাপারে ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ফারুক আল মাসুদ বলেন, সমস্যাটি দীর্ঘদিনের। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। আশা করছি কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন