ডায়াবেটিস একটি মারাত্মক রোগ। কেউ কেউ একে অন্যান্য সকল মারাত্মক রোগের জননী বলে। কাঠের সাথে ঘুনের যে সম্পর্ক, শরীরের সাথে ডায়াবেটিসের সে সম্পর্ক। অর্থাৎ কাঠে ঘুণ ধরলে যেমন এর স্থায়িত্ব নষ্ট হয়ে যায়, তেমনি ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকলে তাড়াতাড়ি শরীর ভেঙে পড়ে। তাই সমগ্র জীবনের রোগ ডায়াবেটিস। একসময় বলা হতো, ডায়াবেটিস বড়লোকের রোগ, কিন্তু আক্রান্ত মানুষের চার ভাগের তিন ভাগই নি¤œ ও নি¤œমধ্যম আয়ের দেশের নাগরিক। বাংলাদেশেও দ্রæত হারে বাড়ছে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা। পরিসংখ্যান বলছে, দেশে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা ৮৪ লাখে দাঁড়িয়েছে, যা ২০৪৫ সালে দেড় কোটিতে দাঁড়াবে। তাই এখনই সচেতন হওয়া দরকার।
অসংক্রামক রোগের মধ্যে বিশ^জুড়ে ডায়াবেটিস অন্যতম; তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ডায়াবেটিস প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ। কোভিড মহামারিকালে এই সত্য আরও প্রকটভাবে দেখা দিয়েছে। কোভিড আক্রান্ত হয়ে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদেরও একটি বড় অংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন। এ ছাড়া ডায়াবেটিসের দীর্ঘস্থায়ী জটিলতায় যেমন- হৃদরোগ, কিডনি রোগ, চোখের রোগ, ¯œায়ু রোগ, গর্ভকালীন জটিলতায় কয়েক গুণ বেশি মানুষের অকালমৃত্যু হয়। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, এভাবে চলতে থাকলে ২০৫৪ সাল নাগাদ বিশে^ ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা হবে ৭০ কোটি। তখন বাংলদেশে প্রতি দশজনে দুই থেকে তিনজন মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারে। তবে চিকিৎসকরা বলছেন, এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করা সম্ভব। তাই ডায়াবেটিস রোগীদের সুগার লেভেল নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি রক্তচাপ ও লিপিড নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, স্থূলতা কমাতে হবে, ছাড়তে হবে ধূমপান। বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সোসাইটির বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে হৃদরোগ, কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়া, মুখের ও দাঁতের নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হতে পারে। চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। পঙ্গুত্ব বরণ করতে পারে। কিন্তু সচেতনতা ও সুশৃঙ্খল জীবন ডায়াবেটিস রোগীকে দীর্ঘ ও সুস্থ জীবন দিতে পারে। বাংলাদেশে এখন বয়স্ক ডায়াবেটিস রোগীদের নিয়েই কাজ হচ্ছে। কিন্তু এখন শিশুরাও ডায়াবেটিস-এ আক্রান্ত হচ্ছে। যেকোনো বয়সের মানুষই আক্রান্ত হতে পারে। বাংলাদেশে তারা আক্রান্তের হিসাবের বাইরে থেকে যাচ্ছে। আমরা মনে করি, সকল বয়সের মানুষদের নিয়ে কাজ করা উচিত। আমাদের অনুসন্ধান বলে, বর্তমান সময়েও প্রতি দুইজন ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে একজনের ওষুধ কেনার ক্ষমতা নেই। বিশে^ চারজনের মধ্যে তিনজন ডায়াবেটিস রোগী বিশে^র মধ্যম ও নি¤œ আয়ের দেশে বসবাস করছেন। আমাদের দেশের অবস্থাও সেরকম।
এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের ৫৬ ভাগেরও বেশি ডায়াবেটিসের রোগী মনে করেন তাদের ডায়াবেটিস নেই। তারা পরীক্ষাও করাননি। গত বছরের এপ্রিলে আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে ১০০ জনের মধ্যে ৬২ জন ডায়াবেটিসের রোগী অশনাক্তকৃত। চিকিৎসকরা বলছেন, প্রয়োজন দ্রæত ডায়াবেটিস শনাক্ত করা এবং চিকিৎসা নেওয়া। নিরাপদ খাদ্য এবং সুশৃঙ্খল জীবন ডায়াবেটিস থেকে রক্ষা করবে।
বাংলাদেশে ডায়াবেটিস চিকিৎসায় ওষুধ এবং ইনস্যুলিনের দাম তেমন বেশি মনে না হলেও বাস্তবে এটা একটা বোঝা। কারণ এই ওষুধ একদিন বা সপ্তাহ নয়, সারা জীনের জন্য গ্রহণ করতে হয়। আর এর পরিমাণ বাড়তে থাকে। ফলে এটা আসলেই অনেক খরচের ব্যাপার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশে^র বিভিন্ন দেশে ডায়াবেটিসের ওষুধের দাম কমানোর দাবি উঠছে। সরকারকে আমাদের দেশের দরিদ্র ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত রোগীদের কথাও ভাবতে হবে। রোগীর নিয়ন্ত্রণ লক্ষ্যমাত্রার বাইরে। অথচ সবাই সমান সুযোগ পেলে বা সচেতন হলে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব। বাংলাদেশের একটি বড়সংখ্যক ডায়াবেটিস রোগী আর্থসামাজিক কারণে ও সচেতনতার অভাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়ে যাচ্ছেন। সে জন্যই সবার জন্য বা সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার কথা জোর দিয়ে বলা হচ্ছে। বাংলাদেশের মতো মধ্যম আয়ের দেশে ডায়াবেটিস চিকিৎসা যেমন জরুরি, তার চেয়ে বেশি জরুরি ডায়াবেটিস প্রতিরোধের সর্বাত্মক সুগভীর কর্মকান্ড। রাষ্ট্রকে ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়ে এ কাজে নেতৃত্ব দিতে হবে, যাতে সর্বস্তরের মানুষকে যুক্ত করা সম্ভব হয়। পাঠ্যসূচি থেকে শুরু করে নগর-পরিকল্পনা, বিদ্যালয় স্থাপনসহ সব ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস প্রতিরোধসহ মেটাবলিক রোগগুলো নিয়ন্ত্রণের কাঠামোগত উন্নতি করতে হবে।
চিকিৎসক-কলামিস্ট, মোবাইল: ০১৭১৬-২৭০১২০
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন