বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

পার্বত্যাঞ্চলে অবাধে চলছে খ্রিস্টানকরণ

ড. মাহফুজ পারভেজ | প্রকাশের সময় : ২১ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি পাহাড়ে দুই দশকের অধিককালের সংঘাত ও রক্তপাতের অবসান ঘটিয়ে শান্তি, স¤প্রীতি, উন্নয়নের নবদিগন্ত সূচিত করেছে। সুস্পষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে পাহাড়ের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তনের ধারা পরিলক্ষিত হচ্ছে। রাস্তাঘাট, কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি মৌলিক অধিকারের নিরিখে পশ্চাৎপদ পার্বত্যাঞ্চল শান্তিচুক্তির ফলে চলে এসেছে উন্নয়ন ও অগ্রগতির সামনের কাতারে।

যেকোনো গবেষণা ও মূল্যায়নে শান্তিচুক্তির ইতিবাচক প্রভাব পার্বত্য-উপজাতি এবং পার্বত্য-বাঙালির সমাজজীবনে তাৎপর্যপূর্ণ বলে প্রমাণিত হয়েছে। শান্তিচুক্তির অধিকাংশ ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, হাসপাতালসহ মানবিক অধিকারের প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রগুলো গতিশীল হয়েছে। যদিও পাহাড়ে আঞ্চলিকতাবাদী কতিপয় নেতা ও কয়েকটি সন্ত্রাসী সংগঠন শান্তির বিরুদ্ধে সরব এবং পার্বত্য-বাঙালি জনগোষ্ঠী সমঅধিকারের দাবিতে সোচ্চার, তথাপি মোটের উপর সেখানে শান্তি, স¤প্রীতি ও উন্নয়ন অব্যাহত রয়েছে।

গবেষণার তথ্যে শান্তিচুক্তির ২৫ বছরে পার্বত্যাঞ্চলে ধর্মীয় রূপান্তরের একটি গুরুত্বপূর্ণ চিত্র পরিস্ফুট হয়েছে। সাধারণভাবে একটি ঢালাও প্রোপাগান্ডা করা হয় যে, ‘পাহাড়ে ইসলামীকরণ’ করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তব তথ্যে এই অভিযোগ সর্বৈব মিথ্যা, উদ্দেশ্যমূলক ও অবাস্তব বলে প্রতীয়মান হয়। ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে উস্কানিমূলক এমন প্রচারণার সঙ্গে পার্বত্যাঞ্চলের প্রকৃত চিত্রে বিন্দুমাত্র মিল নেই। বরং বিদ্যমান বাস্তবতা ও তথ্যের আলোকে পার্বত্যাঞ্চলে ধর্মীয় রূপান্তরের ভিন্ন চিত্রই দেখা যায়, যা পাহাড়ে বসবাসকারী উপজাতি ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর জন্য উদ্বেগের বিষয়।

সর্বশেষ প্রাপ্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পার্বত্যাঞ্চলে শান্তিচুক্তির আগে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত সময়কালে মুসলমানদের মসজিদ ছিল ৭৫৬টি। হিন্দুদের মন্দির ছিল ২৭০টি। বৌদ্ধদের কিয়াং ছিল ১১১৯টি এবং খ্রিস্টানদের গির্জা ছিল ২৭৪টি। কিন্তু শান্তিচুক্তির পর এসব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের তথ্য-পরিসংখ্যানগত বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। যেমন মসজিদ নির্মিত হয়েছে ৬৭৫টি, মন্দির ১৭৬টি, কিয়াং ৫৪১টি এবং গির্জা ৪৪০টি। এসব তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বর্তমানে পার্বত্যাঞ্চলে সর্বমোট মসজিদর সংখ্যা ১৪৩৪টি, মন্দির ৪৪৬টি, কিয়াং ১৬৬০টি এবং গির্জা রয়েছে ৭১৪টি। অর্থাৎ, শান্তিচুক্তির পর মসজিদ, মন্দির, কিয়াং মোটামুটিভাবে সংখ্যাগত দিক থেকে দ্বিগুণ হলেও গির্জার বৃদ্ধি হয়েছে চারগুণ। স্পষ্টই, গির্জার সংখ্যা বৃদ্ধির হার পার্বত্যাঞ্চলে খ্রিস্টান জনগোষ্ঠী বৃদ্ধির তথ্যকে প্রমাণ করে, যা সেখানে ‘ইসলামীকরণ’-এর প্রচারণাকে মিথ্যা এবং ‘খ্রিস্টানকরণ’-এর তথ্যকে সত্য বলে প্রতিপন্ন করে।

গবেষণাকালে আরও জানা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি বৌদ্ধ ধর্মীয় স¤প্রদায়ের চাকমা, মারমা, বম, খুমি ও চাক এবং হিন্দু ত্রিপুরাদের অনেকেই স্বধর্ম ছেড়ে ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হচ্ছে। যে কারণে তাদের জন্য অধিক ধর্মস্থান তথা গির্জার প্রয়োজন হচ্ছে এবং সেগুলো তৈরি করাও হচ্ছে। একটি তথ্যানুযায়ী, শান্তিচুক্তির পর ১৯৯৮ সাল হতে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৪৩৪৪ জন খ্রিস্টান হয়েছে বৌদ্ধ এবং হিন্দু ধর্ম হতে। অপর দিকে মাত্র ৪৫০ জন হয়েছে মুসলিম। হিন্দু হয়েছে ৭৬ জন। যে তথ্যটি দৈনিক জনকণ্ঠ ২৪ এপ্রিল ২০২১ সালে প্রকাশ করে।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পার্বত্যাঞ্চলে ব্যাপক হারে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার তথ্য আদমশুমারি থেকেও প্রমাণিত হয়। উল্লেখ্য, ৩০ বছরে অর্থাৎ ১৯৯১ সাল হতে ২০১১ সাল পর্যন্ত সরকারি আদমশুমারি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে খ্রিস্টান ধর্মান্তকরণের হার সর্বাধিক। খ্রিস্টান মিশনারি, খ্রিস্টান চ্যারিটি, এনজিও’র সংখ্যা ও তৎপরতা সবচেয়ে বেশি।

শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের ১৩টি পার্বত্য-উপজাতি গোষ্ঠীর মধ্যেই নয় বাংলাদেশের অন্যত্র বসবাসকারী সমতল-উপজাতি গোষ্ঠীর মধ্যেও খ্রিস্টানকরণ অব্যাহত গতিতে চলছে। গারো, সাঁওতাল, হাজং, মুন্ডা, মনিপুরী ইত্যাদি উপজাতি গোষ্ঠীতে বর্তমানে খ্রিস্টান প্রধান ধর্ম।

আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, পার্বত্যাঞ্চলে ধর্মীয় রূপান্তরের প্রকৃত চিত্র বলতে গেলে চাপা পড়ে আছে। সন্তর্পণে সেখানে যে ধর্মান্তরকরণ চলছে, তার সম্পর্কে নীতিনির্ধারক ও সংশ্লিষ্টরা নিশ্চুপ। উপজাতিদের রাজনৈতিক নেতৃত্বও বিষয়টিকে ভুল ব্যাখ্যা করছে। তারা উগ্র বাঙালি-বিদ্বেষ ও ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে ‘পার্বত্যাঞ্চলে ইসলামীকরণ’ হচ্ছে বলে অপপ্রচার চালাচ্ছে। এর ফলে প্রকৃত সত্য উন্মোচিত হয়ে সকলের সামনে আসতে পারছে না।

তদুপরি, উপজাতি নেতাদের উগ্র জাতিগত বিদ্বেষ ও রাজনৈতিক স্বার্থান্ধতার কবলে নিপতিত হয়ে ধর্মীয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যগণ। কারণ, ‘ইসলামীকরণ’-এর অপপ্রচার ও নেতাদের প্ররোচনার ফলে উপজাতিরা ইসলাম ও বাঙালিদের প্রতি সন্দেহ পোষণ করে। আর এই সুযোগে দেশি-বিদেশি মিশনারি ও এনজিও অবাধে খ্রিস্টানকরণ করে চলেছে।

উপজাতি নেতৃত্ব হিংসার রাজনীতির কারণে ও আর্থিক লালসার বশবর্তী হয়ে স্বজাতি ও স¤প্রদায়ের আরও ভয়ানক ক্ষতি করছে। নেতাদের প্রত্যেকেরই একাধিক সাইনবোর্ড সর্বস্ব এনজিও রয়েছে, যারা বিদেশি সংস্থা ও এনজিও’র কাছ থেকে অগাধ অর্থ সাহায্য পেয়ে ধর্মান্তরকরণের সুযোগ করে দিচ্ছে। এদেরকে আশ্রয় করে খ্রিস্টান ধর্মীয় মনোভাবাপন্ন এনজিও এবং মিশনারির প্রচুর লোক পার্বত্যাঞ্চলের অতি প্রত্যন্ত ও গহীন অঞ্চলে প্রবেশ করেছে। তারা আর্থিক প্রণোদনা, উন্নত জীবনের লোভ ও অন্যবিধ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে দরিদ্র উপজাতি গোষ্ঠীসমূহের সদস্যদের ব্যাপকভাবে ধর্মান্তরকরণ করছে।

অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় এটাই যে, ভূকৌশলগত ও নিরাপত্তার নিরিখে অত্যন্ত স্পর্শকাতর, সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তার প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও জনশক্তির বিরুদ্ধে উপজাতি নেতৃত্ব কথা বললেও ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক নিরাপত্তা বিঘœকারী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে কখনোই কিছু বলে না। উপজাতি নেতৃত্বের এহেন রহস্যজনক ও উদ্দেশ্যমূলক নীরবতার কারণ অনুধাবন করতে অসুবিধা হয় না।
পার্বত্যাঞ্চলে প্রাপ্তি ও অগ্রগতি নিয়ে অনেক পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন নিশ্চয় হবে। চলমান শান্তি, স¤প্রীতি ও উন্নয়নের ফলে অর্জনসমূহ যেমনভাবে চিহ্নিত করা হবে, তেমনিভাবে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত প্রতিবন্ধকতা নিয়েও অনুসন্ধান করা হবে। তবে পার্বত্যাঞ্চলে ধর্মীয় রূপান্তরের ফলে যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভারসাম্যহীনতা ও বিভেদের সৃষ্টি হচ্ছে, সে সম্পর্কে বেখেয়াল থাকার অবকাশ নেই। কারণ, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত ঝুঁকির চেয়ে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সঙ্কট কম বিপদজনক নয়।

লেখক: অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন