আবদুল আউয়াল ঠাকুর : বছরের অন্য সময়গুলোতে যাই হোক ডিসেম্বর আর মার্চ মাস এলে স্বাধীনতার কথা আর ফেব্রুয়ারি এলে ভাষার কথা বেশ শোনা যায়। এবার ডিসেম্বরেও তার কোন ব্যত্যয় ঘটেনি। বিষয়টি সংগত বিবেচনা থেকেই হয়ত উঠে আসে। এর ফলে জনজীবনে এ সম্পর্কে সতেচনতা সৃষ্টি হয়। মতের সম্মিলন হয়। নতুন বংশধরেরা ধারনালাভ করতে পারে। এটা যে শুধু আমাদের দেশেই হয় বা হয়ে আসছে তা নয় বরং পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এ প্রবণতা রয়েছে। এখানে অবশ্যই বিবেচ্য যেসব দেশ উপনিবেশিকতার নাগপাশ থেকে মুক্তি পায়নি তাদের হয়ত ব্যাপরটি এ রকম নেই। তাদের দেশে অন্য গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বোধ সঞ্চারি দিন তারিখ পালিত হয়। সে বিচেনায় একেক দেশে একেকদিন তারিখ রয়েছে। যাই হোক প্রকৃতিতে যতই আলাদা হোক বা থাকুক এটাই সত্যি যে জাতীয় জীবনে এমন কতগুলো দিন তারিখ রয়েছে যা থেকে জাতি উজ্জীবিত হয় বা প্রেরণা পায়, পায় নতুন দিকনির্দেশনা। আসলে এসবের মধ্যেই রয়েছে মানুষের বেঁচে থাকার উপাদান।
ফরাসি বিপ্লবের হাত ধরে আধুনিক গনতন্ত্রের সূচনাকাল ধরা যায়। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত। স্বাধীনতাকে যদি রাজনৈতিক অর্থে ব্যবহার করা যায় তাহলে এর সংজ্ঞার মধ্যে গণতন্ত্র অঙ্গিভূত হয়ে আছে। মুক্তির স্বাদ অর্থহীন মনে হবে যদি সেখানে গণতন্ত্র না থাকে। কথাটা আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হয় ফরাসি বিপ্লব বা পাশ্চাত্তের রেনেসাঁয় যে মানবাধিকারের কথা বলা হয়েছে সেটি যে পূর্ণাঙ্গ ধারণা ছিল না তা প্রমাণিত হয়েছে মার্র্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিভিল ওয়ারে। আজকের গণতন্ত্র যে আব্রাহাম লিংকনের সংজ্ঞায় বিবেচনা করা হয়ে থাকে সেই লিংকনের দেশের কথাই বলা হচ্ছে। দেশটি স্বাধীনতা লাভ করেছিল ব্রিটিশদের কাছ থেকে। এটা ছিল রাজনৈতিক স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা আমেরিকার সকল নাগরিককে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেনি। আরো অনেকটা সময় কেটে গেছে। মার্কিন নাগরিকদের সাম্য স্বাধীনতা তথা মুক্তির দাবী উঠেছিল বর্ণবাদের অবসানের আহ্বানের মধ্য দিয়ে। আর সেই সমঝোতাই করা হয়েছে আব্রাহাম লিংকনের আধুনিক গণতন্ত্রের সংজ্ঞায়। তিনি সেখানে মার্কিন নাগরিকদের মুক্তি নির্ধারণ করে বলেছিলেন, গণতন্ত্র হচ্ছে প্রকৃতই জনগণের সরকার। বোধকরি একটি শক্তিশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গড়ে তুলতে গণতন্ত্রের এই সংজ্ঞা অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছিল। বলা যায় মানুষের অধিকার বিবেচনায় এটি ছিল সে সময়ের বড় ডক্টট্রিন। যদিও একথা বলে রাখা দরকার গণতন্ত্রের জন্ম ও বিকাশের সাথে মানুষের মুক্তির ঘোষণা থাকলেও এটি চূড়ান্ত বিবেচনায় নিরঙ্কুশ বলে বিবেচিত না হলেও মন্দের ভাল হিসেবে এখনো এক ধরনের ভারসাম্য রক্ষা করে চলছে। ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনে স্বাধীনতার প্রাণ হিসেবে বিবেচিত গণতন্ত্র- এই প্রেক্ষিত সামনে রেখে যদি বাংলাদেশের বিগত সময়কে বিবেচনায় আনা যায় তাহলে আবশ্যই ভেবে দেখার বিষয় রয়েছে আমাদের এগিয়ে চলা অথবা পিছিয়ে পড়ার অন্তর্নিহিত সূত্র কি? বলার অপেক্ষা রাখে না। সেই ৬ষ্ঠ শতক থেকে ভৌগোলিক স্বাধীনতার একটি রূপরেখা নানাভাবে ঘুরপাক খাচ্ছিল। ব্রাহ্মণ্যবাদের নির্যাতনে নিষ্পেষিত এদেশের বৌদ্ধ সমাজ যখন হয় নিহত, বাস্তুচ্যুত অথবা নির্বাসিত হয়েছে তখন থেকে ধর্মীয় আস্থার সঙ্কট এই অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে নতুন ভাবনা উদয় হয়েছিল। ঠিক সুস্পষ্ট করে কোন ভৌগোলিক সীমারেখা তখন না থাকলেও মনের ভূগোলে যে ম্যাপ তৈরী হয়েছিল সেটাই ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় এগুতে থাকে। ধর্মীয় আস্থার সঙ্কটের মুক্তি ঘটে এদেশে মুসলমানের আগমনের মধ্য দিয়ে। এ অঞ্চলে মুসলমানদের আগমন নিয়ে ইতিহাসের নানা অধ্যায় রয়েছে। সবকিছু আমরা বিবেচনা না নিলেও আজকের প্রেক্ষাপটে এটুকু উল্লেখ করা জরুরি যে, সেই সমাজের মানুষ তাদের অধ্যাত্মিক, মানসিক তথা সামগ্রিক মুক্তি ও কল্যাণের উপায় হিসেবে ইসলামকে গ্রহণ করেছিল। জীবনবোধ ও সংস্কৃতি লালনে ইসলাম অপরিহার্য হয়ে উঠার কারণে রাষ্ট্র চিন্তা ও সক্রিয়তা অর্জনের এক বিশেষ ভূমিকা রেখেছে ইসলাম ধর্ম। এরপর অনেকটা পথ অতিক্রান্ত হয়েছে। বাংলায় মুসলমান শাসনের অবসান ঘটে ব্রিটিশ বেনিয়াদের চক্রান্তের মধ্য দিয়ে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা যাই বলা হোক, ১৭৫৭ সালে ভাগীরথির তীরে পলাশীর আ¤্রকাননে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার নির্মম পরাজয়ের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের স্বাধীনতার অবসান ঘটে। সেই সাথে সর্বশেষ স্বাধীন রাজ্য বাংলা বিহার, উড়িস্যার ম্যাপ একীভূত হয়ে যায়। বলে রাখা ভাল একটা ম্যাপ এখানে ছিল। এটাও এখানে উল্লেখ করা দরকার সুবে বাংলার রাজধানী ছিল ঢাকা। নানা প্রক্রিয়ায় বাংলার রাজধানী পরিবর্তন করা হয় মুর্শিদাবাদে আর সেখানে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। ইতিহাসের বিবরণ অনুযায়ী এই বাংলা থেকেই প্রথম ব্রিটিশ বিরোধী ফকির ও সন্ন্যাস বিদ্রোহের জন্ম হয়েছিল। ব্রিটিশরা তাদের দখলিয়াত বজায় রাখতে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ করেছিল। পূর্ববঙ্গ ও আসামকে নিয়ে করা নতুন প্রদেশের রাজধানী ছিল ঢাকা। প্রায় পৌনে দুইশ বছর ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়। মূলত সংস্কৃতি কৃষ্টি চিন্তা চেতনা মনন ও মেধায় ভারতের হিন্দু মুসলমানরা যে আলাদা ধাচের তারই স্বীকৃতি ছিল ভারত বিভক্তিতে। ’৪৭-এর স্বাধীনতার আগে ৪০-এর লাহোর প্রস্তাবে স্টেইসের মধ্য দিয়ে আমাদের আলাদা অস্তিত্ব স্বীকৃত হলেও বাস্তবে তা পরিণিতি লাভ করেনি। পূর্ববাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তান এক হাজার মাইলের ব্যবধানে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হয়ে থাকছিল। রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিবেচনায় ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় এই রাজনৈতিক স্বাধীনতা এ অঞ্চলের মানুষের মুক্তির স্বাদকে পরিপূর্ণতা দানে ব্যর্থ হয়। মায়ের ভাষায় কথা বলার দাবীর মধ্য দিয়ে মূলত যে মুক্তির কথা উঠেছিল সেটাই ছিল গণতন্ত্রের কথা। রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে অর্থপূর্ণ করতে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতাকে সম্পৃক্ত করা হয়েছিল আর সে কারণে মা মাটি মানুষ একাকার হয়ে গিয়েছিল। মায়ের সম্ভ্রম, মাটির উর্বরতা রক্ষায় মানুষের ঐক্যবদ্ধতায় জীবনপন সশস্ত্র সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হওয়ার মূল প্রেরণা ছিল গণতন্ত্র। রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত বিজয়ের পর রচিত বাংলাদেশের সংবিধানে অন্যতম মৌলিক স্তম্ভ হিসেবে স্থান পায় গণতন্ত্র। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, সেই গণতন্ত্র এদেশের মুক্তির প্রেরণা হিসেবে সম্পৃক্ত হয়ে থাকলেও সেই গণতন্ত্র কখনো সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কখনো বুটের অথবা স্যান্ডেলের তলায় নিস্পিষ্ট হতে থাকল।
ইতিহাসের বিশ্লেষণে এটা খুব সুস্পষ্ট করে বলা যায় আমাদের সংবিধানে যে বাধাহীন অবাধ প্রবাহের গণতন্ত্রের পক্ষে বলা হয়েছিল সেটি বাধাগ্রস্ত হয় বাকশাল গঠনের মধ্য দিয়ে। এটা বলে রাখা ভাল, যে সংসদে বাকশাল গঠিত হয়েছিল সেই ’৭৩-এর নির্বাচন ছিল ত্রুটিপূর্ণ। ঐ নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। তখনকার রাজনীতিতে প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে জাসদ সারা দেশে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। ঐ নির্বাচনে জাসদের সভাপতি মুক্তিযুদ্ধের নবম সেক্টর কমান্ডার আলোচিত ব্যক্তিত্ব মেজর (অব) এম.এ. জলিলসহ আরো অনেককে কারচুপির মাধ্যমে পরাজিত করা হয়েছিল বলে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। ’৭০-এর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে নতুন দেশ গড়ার যে ম্যান্ডেট অর্জিত হয়েছিল স্বাধীনতার পরের প্রথম নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় সরকার পরিবর্তনের একমাত্র পদ্ধতি নির্বাচনের গায়ে কলঙ্কের তিলক পড়ল। মানুষের মুক্তির একেবারে প্রাথমিক যে অধিকার তাতে গুরুতর আঘাত এলো। রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের এই কলঙ্ক বোঝা আজো অপনোদিত হয়েছে সে কথা বলা যাবে না বরং ২০১৪ সালে অগ্রণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যেন সেই তিলকই আরো পূর্ণতা পেল। বাকশাল গঠনের মধ্য দিয়ে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার যে মারাত্মক আঘাত হানা হয়েছিল তার স্বীকৃতি রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক সে সময়ের সংসদ থেকে বাকশাল গঠনের বিরোধিতা করে পদত্যাগকারী সংসদ সদস্য জেনারেল (অব.) এমএজি ওসমানীর ভাষায়। নির্বাচনী ইশতিহারে বাকশাল গঠনের কথা না বলে সংসদে একদলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তনকে সম্পূর্ণ গণতন্ত্রবিরোধী মনে করে তিনি তার রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও সংসদ সদস্য পদ থেকে একযোগে পদত্যাগ করেছিলেন। সে সময় তিনি একা নন আরো কয়েকজন সংসদ সদস্য একই কারণে পদত্যাগ করেছিলেন। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে সংসদীয় রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক চর্চায় মূলত ব্যত্যয় সৃষ্টি হল। শাসক দল গণতান্ত্রিক চর্চা থেকে বেরিয়ে গেলেও জনগণ গণতান্ত্রিক ধারাতেই সম্পৃক্ত থাকল। বাকশাল পতনের পরে সরকারদলীয় স্পিকার আবদুল মালেক উকিল লন্ডন হিথ্রো বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন বাংলাদেশে ফেরাউনের পতন হয়েছে। মিশরের রাজা ফেরাও যারা পরবর্তীকালের ফেরাউন বলে পরিচিত ছিল তাদের সাথে সংঘর্ষ হয়েছিল হযরত মুসা (আঃ) এর। ফেরাউনের অত্যাচারে নিপীড়নে হযরত মুসা (আঃ) নীলনদ অতিক্রম করে গেলেও আর তাঁর পশ্চাদে তাড়াকারি ফেরাউন নীলনদে ডুবে মারা গিয়েছিল। মালেক উকিল যেভাবেই ব্যাখ্যা করেন না কেন প্রকৃতপক্ষে ধর্ম ও গণতন্ত্র এখানে এক সমীকরণে দাঁড়িয়েছে।
যে মুক্তির লড়াই দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয়েছিল সেই ধারা এখনও সমতালে চলমান। ইতিহাসের পথপরিক্রমায় বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির প্রবক্তা হিসেবে আমরা দেখতে পাই শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে-যেই কণ্ঠ থেকে জনগণ শুনেছিল স্বাধীনতার আহ্বান। সেই কণ্ঠ থেকেই ঘোষিত হয়েছিল মানুষের মুক্তি তথা বহুদলীয় গণতন্ত্রের ঘোষণা। ৭ নভেম্বরের সিপাহী জনতার নারায়ে-তাকবির ধ্বণীর মধ্য দিয়ে ঘোষিত হয়েছিল মুক্তি পাগল শৃঙ্খলিত মানুষের মুক্তির শ্লোগান। সে থেকে শুরু হয়েছিল স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সম্মিলন। সাক্ষ্য দেয়, ঘাতকের বুলেটে শাহদাতের আগ পর্যন্ত এই মহান রাষ্ট্রনায়ক এদেশে নারী-পুরুষ শিশুসহ সকলের সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় ছিলেন আপসহীন। কণ্ঠ ভোটে পিষ্ট গণতন্ত্রকে করেছিলেন রাহুমুক্ত। এ অঞ্চল তো বটেই হয়তো ইতিহাসের সেই দু’একজনের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন যিনি প্রমাণ করেছিলেন নির্মোহ ন্যায়ভিত্তিক সুসম সমাজ প্রতিষ্ঠা করলে ক্ষমতা জনগণের সহায়তা পায়। আর সে কারণেই তিনি এ যাবৎকালের বাংলাদেশের একমাত্র ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট যার জনপ্রিয়তা এখনও ঈর্ষণীয় সূচকে রয়েছে- যার অর্থ হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি তথা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সূচকে তিনি রয়েছেন এক ভিন্ন উচ্চতায়। এর পরের ইতিহাস লজ্জার, কলঙ্কের এবং ঘৃণার। একটি নির্বাচিত সরকারকে উচ্ছেদ করে সেনাপ্রধান জেনারেল এইচএম এরশাদ সামরিক শাসন জারি করেছিলেন ১৯৮২ সালের ২৩ মার্চ। পরবর্তী ৯ বছর এদেশে যে গণতান্ত্রিক আন্দোলন চলেছে সে ধারায় গণতন্ত্র স্বাধীনতা ও মানুষের মুক্তির স্বপক্ষে আপসহীন ভূমিকায় ছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। সেই আন্দোলনের তিন জোটের ঐক্যবদ্ধ ম্যান্ডে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখার ভিত্তিতে ’৯০-এর ৬ ডিসেম্বর পদত্যাগে বাধ্য হন গণতন্ত্র হত্যাকারী এইচএম এরশাদ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখার মধ্যে মূলত বাকশালের মাধ্যমে হারিয়ে যাওয়া সংসদীয় পদ্ধতির পুনঃপ্রবর্তন ও নির্বাচনী ব্যবস্থায় সংস্কার সাধন করা হয়েছিল। এভাবেই সরকার পরিবর্তন চলছিল ২০০৭ পর্যন্ত। বিএনপি জোট সরকার যথাযথ সময়ে নির্বাচনের তারিখ ও সিডিউল ঘোষণা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য সকল রাজনৈতিক দল মনোনয়নপত্র দাখিল করার পর এক অজ্ঞাত কারণে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা একযোগে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করার মাধ্যমে নির্বাচনী ব্যবস্থা তথা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে নতুন ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়। আর এই সুযোগ নিয়ে পুনরায় অগণতান্ত্রিক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। এর পরের আলোচনা সংক্ষিপ্ত। অদ্যাবধি দেশের জনগণ গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলনে অকাতরে প্রাণ দিয়ে যাচ্ছে। শাসকদল গণতন্ত্রের পরিবর্তে উন্নয়নে বড়ি জনগণকে খাওয়াতে চাচ্ছে। ২০১৪ সালের অগ্রহণযোগ্য একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে যেভাবে সংক্কচিত করা হয়েছে তার সাথে যুক্ত ছিল ভারতের কংগ্রেস সরকার। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবীতে দেশের জনগণ যখন প্রাণপণ লড়াই করছে তখন বাস্তব অবস্থা হচ্ছে গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়েছে। সে কারণে মানুষের মুক্তি এবং দেশের মুক্তি সমান্তরাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমরা শুরুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ টেনে বলার চেষ্টা করেছি কেবলমাত্র রাজনৈতিক স্বাধীনতা চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হতে পারে না যদি না মানুষের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা না যায়। হাজার বছরের পথপরিক্রমায় অগণিত দেশপ্রেমিকের রক্ত-ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে যে রাজনৈতিক অধিকার অর্জিত হয়েছে তার যথাযথ সংরক্ষণ সম্ভব নয় যদি এই ভূখন্ডের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চিন্তাচেতনা মেধা-মননের স্বাধীনতা অর্জিত না হয়। বারবার এদেশের মানুষের মুক্তির যে লড়াই চলছে তার ইতিবাচক ও স্থায়ী সমাধান অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। সে বিবেচনায় প্রেসিডেন্ট যে সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছেন তা ব্যর্থ হবার কোন সুযোগ নেই। তিনি শুরু করছেন বিএনপিকে দিয়ে। গতকাল বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক একাধিকবারের প্রধানমন্ত্রী ২০-দলীয় জোট তথা গণতন্ত্রের আপসহীন নেতা বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন টিমের সাথে প্রেসিডেন্টের সংলাপ হয়েছে। অনেক বিশ্লেষক একে অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে নতুন কিছু দেখছেন না। একজন সাবেক নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, আইন ছাড়া প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠনে সরকারের বড় ধরনের প্রভাব থাকার সুযোগ থাকে। তিনি সেই সাথে মনে করেন, আইন যখন নেই তখন সর্বসম্মতিতে একটি সিদ্ধান্ত হলে তা গ্রহণযোগ্য। বিএনপির পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই প্রেসিডেন্টের কাছে দলের চেয়ারপারসনের এ সংক্রান্ত প্রস্তাবাবলী পৌঁছে দেয়া হয়েছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আশাকরি সকলের মতামতের ভিত্তিতে একটি নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করা সম্ভব হবে। বাজারে অনেক কথা আছে। অনেকেই মনে করেন ক্ষমতা হাতছাড়া হতে পারে এমন ন্যূনতম ঝুঁকিও সরকার নেবে না। সেসবে কান দিয়ে লাভ নেই। বাস্তব অবস্থা হচ্ছে মানুষের মুক্তি না ঘটাতে পারলে প্রকৃতই স্বাধীনতাকে অর্থবহ করা যাবে না। সে অর্থে স্বাধীনত বা বিজয় দিবস পালন হবে কেবল আনুষ্ঠানিকতা।
awalthakur@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন