দেশ এখন কালো টাকার মালিকদের নিয়ন্ত্রণে। সব আইনকানুন কালো টাকার মালিক, ব্যবসায়ীদের অনুকূলে। কারণ, সংসদে তাঁদেরই আধিপত্য। সরকার ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে কালো টাকার মালিকদের সুযোগ করে দিচ্ছে। উন্নয়নের নামে গত ৫০ বছরে বৈষম্য বেড়েছে। মেগা প্রকল্পের নামে বিদেশে টাকা পাচার হয়েছে। এই পরিস্থিতি বদলাতে সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সবার আগে করতে হবে জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত। তবে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন শুধু একটি প্রক্রিয়া মাত্র। কিন্তু নানা কারণে নিরপেক্ষ নির্বাচন এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছে। তবে সেটাই বর্তমান সংকটের কিছুটা সমাধান দিতে পারে। এসব কথা বলেছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। গতকাল শনিবার রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আয়োজনে ‘জনশুনানি: জাতীয় উন্নয়ন ও স্থানীয় বাস্তবতা’ শীর্ষক সেমিনারে তারা নিজেদের এসব বক্তব্য তুলে ধরেন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। এ সময় দেশের অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক, সংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্ব সংসদ সদস্য ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা আলোচনায় অংশ নিয়ে আরো বলেছেন, জাতীয় উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে হলে দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের কাছে উন্নয়নের ধারা পৌঁছে দিতে হবে, তাহলেই দেশের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব। সেমিনারে আলোচনায় অংশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, দেশে বৈষম্যমূলক উন্নয়ন হচ্ছে। গত ৫০ বছরে উন্নয়নের পাশাপাশি বৈষম্য বেড়েছে। এই পরিস্থিতি বদলাতে সামাজিক বিপ্লব প্রয়োজন। প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এর মধ্যে নির্বাচন শুধু একটি প্রক্রিয়া মাত্র। তিনি আরো বলেন, বর্তমান ব্যবস্থায় নির্বাচন হলেও প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। সমাজে সুযোগ ও অধিকারের সমতা, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং সর্বস্তরে যোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বর্তমানে সংস্কৃতির চর্চা নেই বললেই চলে। আদর্শ সংস্কৃতির চর্চা করতে হবে।
দেশের ক্ষমতা কালোটাকার মালিকদের হাতে চলে গেছে বলে মন্তব্য করে নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ বলেন, প্রশাসনের কোথাও ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ হয় না। সব আইনকানুন কালোটাকার মালিক, ব্যবসায়ীদের অনুকূলে। কারণ, সংসদে তাঁদেরই আধিপত্য। তিনি আরো বলেন, দেশটা চলে গেছে টাকার কাছে, কালোটাকা মালিকদের কাছে। সরকার নিজের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে কালোটাকার মালিকদের নানান আইনের মাধ্যমে সুযোগ করে দিচ্ছে। নির্বাচনে মনোনয়ন পেতেও বাণিজ্য হচ্ছে। ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার (সদস্য) মনোনয়নেও টাকা লাগে। সেই টাকা ৫ বছরে জনগণের কাছ থেকেই আদায় করা হয়।
মেগা প্রকল্পের নামে দুর্নীতির মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে এবং উন্নয়নের ভাগ জনগণ পাচ্ছে না মন্তব্য করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, একটি গোষ্ঠী সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার মধ্য দিয়ে হাজার কোটি টাকা লোপাট করে নিচ্ছে। এই উন্নয়ন মেগা প্রকল্প জনগণের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যত প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, তত বন উজাড় হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, সরকারের মধ্যে অস্বীকারের সংস্কৃতি রয়েছে। দ্রব্যমূল্যের দাম অনিয়ন্ত্রিত, কিন্তু সরকার বলছে সব ঠিক আছে। সামাজিকভাবে কেউ অন্যায়ের প্রতিরোধ করতে গেলেই তার বিরুদ্ধে হামলা, মামলা হয়। ফেসবুকে দুই লাইন লিখলেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা, গ্রেপ্তার হয়, কিন্তু খুন-ধর্ষণের আসামি ঘুরে বেড়ায় প্রকাশ্যে। তাদের প্রতি সরকারের আনুকুল্য।
প্রবীণ ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক রেহমান সোবহান গত এক যুগে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা ও উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে বলেন, গত এক দশকে দেশ বেশ উন্নতি করেছে, সেটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবে, মাঠ পর্যায় থেকে যে আলোচনা আসছে বা যে সমস্যার কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো ঠিক সমাধানের পথ তৈরি হচ্ছে না। এই অর্থনীতিবিদ প্রান্তিক মানুষের জীবনমান উন্নয়নের উপর জোর দিয়ে বলেন, সরকারের যেসব ক্ষেত্রে অবদানের কথা মন্ত্রী বলছেন, আর প্রান্তিকের মানুষ আজ যে সমস্যাগুলোর কথা বলছেন, সেগুলো কী করে সমাধান করা যায় সেগুলো নিয়ে অলোচনা হওয়া উচিত। মাঠ থেকে ক্ষুধার্ত মানুষের কাছ থেকে যে শব্দ আসে, সেগুলো তো সমাধান হচ্ছে না। সাঁওতালদের সমস্যা, চা শ্রমিকদের সমস্যা, গার্মেন্টস শ্রমিকদের সমস্যা এতো বছরেও কেন সমাধান হচ্ছে না? আমি বলতে চাই, সমস্যাগুলো সবই আমরা জানি, তাহলে বছরের পর বছর এসব সমস্যা সমাধান হচ্ছে না কেন? আমাদের অর্থনৈতিক গ্রোথ হচ্ছে, অবকাঠামো উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু মানুষের যে সমস্যা ছিল সেগুলো আগে যেমন ছিল ঠিক তেমনই আছে। প্রান্তিক পর্যায়ের সমস্যা সমাধানের বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে রেহমান সোবহান বলেন, যেসব সমস্যার কথা উঠছে সেগুলো সব লোকাল গভর্মেন্ট। এই ধরনের শুনানি জেলা পরিষদে হলে ভালো হতো, তাহলে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানসহ স্থানীয় প্রশাসনের লোকজন অংশগ্রহণ করতে পারতো। তাহলে সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। তিনি বলেন, আদিবাসী বা সংখ্যালঘু সংখ্যায় অনেক ছিল, দিনে দিনে তাদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে, তাদের ভূমি সমস্যর কোনো সমাধান হচ্ছে না। লোকাল মাস্তানরা তাদের সম্পদ দখল করে ফেলছে, এসব তো সমাধান হওয়া প্রয়োজন। সরকারে আইন আছে, নীতি আছে এবং কমিটমেন্টও আছে, তাহলে এসব সমস্যা কেন সমাধান হচ্ছে না? এসব বিষয়ে মন্ত্রী যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন বলে আমি মনে করি।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, আমরা শতভাগ সফল তা বলবো না। তবে আমার সরকারের সফলতা অনেক। আজ থেকে ১৪ বছর আগে আমাদের দল যখন ক্ষমতায় এসেছে তখন মাথাপিছু আয় ছিল ৭০০ ডলার, এখন সেটা ২৮৫৩ ডলার। সবক্ষেত্রেই আমরা উন্নতি করেছি। আমাদের ফরেন রেমিটেন্স বেড়েছে, বেড়েছে রিজার্ভ। বর্তমান সংকটের কথা স্বীকার করে তাজুল ইসলাম বলেন, এখন সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। এই মন্দা উত্তরণে আমরা কাজ করছি। আমাদের সরকার জনগণের কাছে সব ধরনের সুবিধা পৌঁছে দিতে কাজ কাজ করে যাচ্ছে। দেশের বড় বড় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হয়েছে, হচ্ছে। পদ্মা সেতু তৈরির মাধ্যমে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবনমান ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সামগ্রিকভাবে আমাদের উন্নয়ন হচ্ছে। প্রান্তিকে চলে যাচ্ছে উন্নয়ন সেবা। সেটাকে আরও বেগবান করার কাজ চলছে।
বিএনপির সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিষ্টার রুমিন ফারহানা বলেন, দেশের রাজনীতি অসুস্থ ধারায় চলছে। নিজের চারপাশে দেখি বনখেকো, ব্যাংকখেকো, জমিখেকো, টাকা পাচারকারী, মাদক ব্যবসায়ীরাই রাজনীতিবিদ। আগে দেশে সুস্থ ধারার রাজনীতিতে ফেরাতে হবে। রাজনীতি সুস্থ থাকলে দেশ, জাতি, মানুষ সুস্থ থাকে। রাজনীতি অসুস্থ হলে দেশের আর কিছুই ভালো থাকে না। উচ্চপর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত অসুস্থ রাজনীতির এই চিত্র। বিরোধীরা এখন সার্বক্ষণিক আতঙ্কে থাকে। এখন উন্নয়ন নিয়ে অনেক আলাপ হয়। কিন্তু উন্নয়নের সংজ্ঞাকে সংকুচিত করে কয়েক গুণ বেশি ব্যয়ে নির্মিত অবকাঠামোতে আবদ্ধ করা হয়েছে। কারণ, অবকাঠামোতে বড় লুটপাট করা যায়। সব খেয়ে ফেলার এই রাজনীতি থেকে বের হতে হবে।
সাবেক মন্ত্রী আওয়ামী লীগের এমপি আসাদুজ্জামান নুর বলেন, আমি নীলফামারীর মানুষ। আমাদের অঞ্চলে একটি কথা প্রচলিত আছে সেটা হলো ‘হাতি ঠেলা যায় কিন্তু কার্তিক ঠেলা যায় না’ এর মানে মংগায় কার্তিক মাসসহ তিনমাস কোনো কাজ থাকতো না। মানুষের হাতে পয়সা থাকতো না। মানুষ না খেতে পেরে মারা যেতো। ২০০৪ সালেও খাবারের অভাবে মানুষ মারা গেছে, এখন মানুষ না খেয়ে মরে না। মংগা শব্দটি জাদুঘরে চলে গেছে।
অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্য পাঠ করেন সিপিডির সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক ড. দেবব্রত ভট্টাচার্য। অন্যান্যের মধ্যে আরো বক্তৃতা করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারে উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, সিপিডির ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারে উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী, সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, জাতীয় মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, বাংলদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক প্রমুখ। ##
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন