মোবায়েদুর রহমান : আজ নিউইয়র্কের সাবওয়ে বা পাতাল রেল সম্পর্কে আলোচনা করব। এই আলোচনায় দেখা যাবে যে যারা সেই পাতাল রেলের পরিকল্পনা করেছিলেন এবং সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছেন তারা কত দূরদর্শী ছিলেন। আরও দেখা যাবে যে আজ থেকে ১১২ বছর আগে তারা প্রযুক্তিতে কত অগ্রসর ছিলেন। আমি নিউইয়র্কে যে কয়বার গিয়েছি এবং থেকেছি, তার প্রতিটি বারই পাতাল রেল দেখে আমি এতটাই মুগ্ধ হয়েছি যে কাজ না থাকলেও আমি আমার সহধর্মীনিসহ সেই সাবওয়েতে উঠে বসেছি এবং ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়িয়েছি। যেহেতু এটি পাতাল রেল তাই বলার প্রয়োজন পড়ে না যে এই রেল লাইন মাটির নিচ দিয়ে গেছে। মাটির নিচে রয়েছে আরেকটি জগৎ, আরেকটি নিউইয়র্ক। সেই জগৎও আলো ঝলমলে। এখানে রয়েছে ৩৪টি লাইন। রেলওয়ে স্টেশন রয়েছে ৪৬৯টি। সামান্য কিছু স্কাই লাইন বাদে পুরোটাই আন্ডারগ্রাউন্ড অর্থাৎ মাটির নিচে। এসব রেল লাইনের মোট দৈর্ঘ্য ৩৭৫ কিলোমিটার। প্রতিদিন অর্ধ কোটিরও বেশি লোক এই সাবওয়ে দিয়ে যাতায়াত করেন। প্রতিটি স্টেশনেই দেখা যাবে সেই রেল লাইনটির নির্মাণকাল। অধিকাংশ স্টেশনেই দেখেছি, সেখানে ইংরেজীতে উৎকীর্ণ হয়ে আছে এই কথাটি, ‘১৯০৪ সালে স্থাপিত/নির্মিত’। অর্থাৎ সেই রেল লাইনটি নির্মিতই হয়েছে আজ থেকে ১১২ বছর আগে। এখন যদি সেই রেল লাইনের পরিকল্পনা নকসা ইত্যাদি ধরি তাহলে আরও চার বছর পিছিয়ে যেতে হয়। সেক্ষেত্রে যদি তারা ২০০০ সালেও এই সাবওয়ের চিন্তাভাবনা করে থাকে তাহলে আজ থেকে ১১৬ বছর আগে এই পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের কাজ তারা হাতে নিয়েছিল। ১১৬ বছর পরেও সারা নিউইয়র্ক শহরের মাটির নিচে দিবারাত্রি একে বেঁকে চলছে সেসব ট্রেন। যানজটের প্রশ্ন নাই, কারিগরি ত্রুটি হলেও যাত্রীদের নজরে আসে না, কারণ ট্রেনতো তার স্বাভাবিক গতিতেই চলে এবং কোনো বিলম্ব নাই। কোথাও ট্রেন বিকল হয়ে পড়ে নাই যে অন্যান্য ট্রেন এসে আটকে যাবে। অথচ এই ১১৬ বছরে নিউইয়র্ক শহর কত বড় হয়েছে, জনসংখ্যা কত বৃদ্ধি পেয়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য চাকরি-বাকরি বৃদ্ধি পেয়েছে, যাত্রী সংখ্যাও বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তারপরেও কোনো অরাজকতা নাই, কোনো নৈরাজ্য নাই, নাই কোনো অব্যবস্থাপনা।
তুলনা করুন বাংলাদেশের সাথে। মহাখালী ফ্লাইওভার। এইতো সেদিন তৈরি হল। এখনই কি প্রচ- যানজট। ফ্লাইওভারের নিচে তো বটেই, ওপরেও যানজট। এর অর্থ হল, আমরা যখন প্লানিং করি তখন দীর্ঘ মেয়াদকে সামনে রেখে প্লানিং করি না, করি স্বল্প মেয়াদে। না হলে রাস্তায় বাসে, ট্রেনে, স্টীমারে সর্বত্রই এমন ঠাসাঠাসি করে যাত্রীরা চলাচল করে কেনো?
এখন বাংলাদেশের কয়েক কোটি মানুষও ম্যানহাটানের নাম জানেন। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি অভ্রভেদী দালান কোঠা রয়েছে এই ম্যানহাটানে। ম্যানহাটান নিউইয়র্কের প্রাণকেন্দ্র। অনেকে বলতে চান যে ম্যানহাটানই হল নিউইয়র্ক। হয়ত এটি ওভার স্টেটমেন্ট। সে যাই হোক, নিউইয়র্কের সবগুলি রেল লাইন হল ম্যানহাটানভিত্তিক। আমি তো বিষয়টাকে এভাবে ব্যাখ্যা করি। সেটি আমি অতীতে ইনকিলাবে লিখেছিও। পৃথিবী নামক এই গ্রহটিকে যদি একটি দেশ বলা যায় তাহলে সেই দেশটির রাজধানী হল নিউইয়র্ক। আর নিউইয়র্ককে যদি একটি প্রদেশ বলা যায় তাহলে তার রাজধানী হল ম্যানহাটান। নিউইয়র্কের এক পাশে হল সেই বিখ্যাত হাডসন রিভার এবং পূবে ইস্ট রিভারের ইস্ট কোস্ট। বলা হয় New York never sleeps. আসলেও তাই। নিউইয়র্ক যেমন ব্যস্ত তেমনি তার চেয়ে বেশি ব্যস্ত হল ম্যানহাটান। নিউ ইয়র্কে রয়েছে ১২টি এভিনিউ। এর মধ্যে ৬টি এভিনিউতে রয়েছে বিভিন্ন রুটের ট্রেন। এই ৬টি এভিনিউ দিয়ে হাঁটতে গেলে ডানে বাঁয়ে সর্বত্রই আপনার চোখে পড়বে একটি না একটি সাবওয়ে স্টেশন।
॥ দুই ॥
নিউইয়র্ক শহরের প্রায় প্রতিটি পরিবারের প্রাইভেট কার রয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে কোনো কোনো পরিবারের একাধিক প্রাইভেট কার। এখন এই প্রবণতা ঢাকাতেও দেখা যাচ্ছে। বেশ কিছু পরিবারকে আমি জানি, যাদের একাধিক প্রাইভেট কার রয়েছে। বনানীর একাধিক এ্যাপার্টমেন্টে অনেক ফ্ল্যাট মালিকের রয়েছে একাধিক গ্যারাজ। তাদের একাধিক গাড়ি ঐ গ্যারাজে থাকে। বাংলাদেশে গাড়ি এক অর্থে অত্যাবশ্যকীয়। কারণ এখানে শহরের মধ্যে চলাচল করতে গেলে ট্রেনের কোনো ব্যবস্থা নাই। হয় প্রাইভেট কার না হলে রিকসা, সিএনজি বা বাস। কিন্তু নিউইয়র্কের কথা আলাদা। সেখানে প্রাইভেট কার না থাকলেও মানুষের নিত্যদিনের চলাফেরায় কোনো অসুবিধা হয় না। মহানগরীর বাস এবং পাতাল রেল মেট্রোপলিটন সিটির আন্ডারে। আপনি এত বড় মহানগরীর যেখানেই যেতে চান না কেনো, হয় বাস না হয় ট্রেন কানেকশন আপনি পাবেন। তবে কতগুলো বিশেষ সময় রয়েছে যেটিকে ঢাকার মত বলা হয় পিক আওয়ার, তখন এসব যানবাহনে এত বেশি ভিড় হয় যে দাঁড়িয়ে যেতে হয়। তাই বলে বাংলাদেশের পাদানীতেও যেমন বাদুড় ঝোলা হয়ে যেতে দেখা যায় সেখানে এই রকম দৃশ্য পাবেন না। ঐ রকম ঠাসাঠাসি এ্যালাউড নয়।
নিউইয়র্কের আরেকটি কমন সার্ভিস হলো ট্যাক্সি ক্যাব। বাংলাদেশে এখন ক্যাব বলতে গেলে উঠেই গেছে। যেটি আছে সেটি হল সিএনজি। সিএনজি আবার যেখানে সেখানে যায় না। তারা তাদের নিজের ইচ্ছেমত চলাচল করে। সরকার মিটার দিয়েছে, মিটারে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু সিএনজির ড্রাইভাররা মিটারের তোয়াক্কা করে না। তারা তাদের মর্জি মাফিক ভাড়া হাঁকে। মিটারে যদি ওঠে ১৩০ টাকা, ওরা দাবি করবে ২৫০ টাকা। মিটারে যদি ওঠে ১৮০ থেকে ২০০ টাকা তাহলে ওরা দাবি করবে ৩০০ টাকা। কিন্তু আমেরিকাতে ট্যাক্সিওয়ালাদের এই রকম দুঃসাহস হবে না। আপনি যেখানেই যেতে চাইবেন সেখানেই তারা যেতে বাধ্য থাকবে। মিটারে যে ভাড়া উঠবে তার এক পয়সা বেশি তারা দাবি করতে পারবে না। ভাড়া নিয়ে বা কোথাও যাওয়া নিয়ে তারা যদি গ্যাঞ্জাম করে তাহলে আপনি নিকটস্থ পুলিশকে ডাকবেন। পুলিশ সোজা তার জরিমানা করবে, অথবা ট্যাক্সি জব্দ করবে অথবা ক্ষেত্র বিশেষে এ্যারেস্ট করে নিয়ে যাবে।
ভার্জিনিয়াতে আমরা পড়েছিলাম দারুন মুশকিলে। সেখানে কোনো পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নেই। অর্থাৎ ট্রেন বাস ইত্যাদি নেই। আছে প্রাইভেট কার অথবা সাইকেল। ওই দেশে রিকসা বা সিএনজি নেই। আমার শ্যালক এবং তার স্ত্রী তাদের কাজে বেরিয়ে গেলে আমরা একদম একা হয়ে পড়তাম। আমাদের এই করুন এবং অসহায় অবস্থা দেখে সন্ধ্যায় ওরা ঘরে ফিরে আমাদেরকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ত। প্রায়শই আমরা ওয়ালমার্টের মত বিশাল স্টোরে ঘুরতে যেতাম। কেনাকাটা ছিল নেহাতই একটি বাহানা।
ফিরে আসছি আবার নিউইয়র্ক প্রসঙ্গে। অন্যান্য স্টেটের তুলনায় নিউইয়র্কে অনেকে সেটেল্ড করতে চান। কারণ এখানে যাতায়াত যেমন সহজ ও সস্তা তেমনি স্বাস্থ্য সেবাও অন্যান্য স্টেটের তুলনায় বেশি। নিউ ইয়র্কে বাস এবং মেট্রোরেল বা সাবওয়েতে মাসিক টিকেট কেনার ব্যবস্থা রয়েছে। সেদিন নিউইয়র্ক থেকে আসা এক মহিলা ব্যাংকার আমাকে বললেন যে, মাসিক মেট্রো রেল টিকেটের দাম ১২০ ডলার। আমরা ছিলাম কয়েক বছর আগে। তখন মান্থলি টিকেট কাটতাম ৮০ ডলারে। ম্যানহাটনে গাড়ির পার্কিং পাওয়া খুব কঠিন বিষয়। ক্ষেত্র বিশেষে ঘণ্টা প্রতি ১৫ থেকে ২০ ডলারও দিতে হয়। অনেক কোটিপতিকে দেখা গেছে পার্কিং না পেয়ে অন্তত এক কিলোমিটার দূরে গাড়ি রেখে তারা পায়ে হেঁটে তাদের গন্তব্যে যাচ্ছেন। আমার কাছে এই ধরনের গাড়ি পার্কিংকে অর্থহীন মনে হয়েছে। অবশ্য যারা এভাবে চলাফেরা করেন তারা হয়ত এর মধ্যে কোনো ইউটিলিটি খুঁজে পেতে পারেন।
॥ তিন ॥
নিউইয়র্কের পাতাল রেল সম্পর্কে আলোচনার জন্য নিউইয়র্ক শহরের প্রশাসনিক ব্যবস্থা সম্পর্কে দুটি কথা বলা দরকার। নিউইয়র্ক ৫টি বোরো বা প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত। এগুলো হল, ব্রঙ্কস্, ব্রকলীন, কুইন্স, ম্যানহাটান এবং স্ট্যাটেন আইল্যান্ড। ঢাকায় যেমন রয়েছে মিরপুর, মোহাম্মাদপুর ইত্যাদি। ম্যানহ্যাটনকে ব্রকলীন ও কুইন্সের সাথে যুক্ত রাখতে সব মিলিয়ে প্রায় ১২টি আন্ডারপাস ও ব্রিজ তৈরি করা হয়েছে যা দিয়ে ট্রেন এবং বাস, কার চলাচল করে। আন্ডারপাসগুলি সাগরের নীচ দিয়ে চলে গেছে। সাগরের নীচ দিয়ে ট্রেন গেছে, এটি আমরা বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কল্পনাই করতে পারি না। তবে কর্ণফুলী নদীর তল দিয়ে যদি কোনোদিন টানেল নির্মিত হয় তখন হয়ত বিষয়টি বুঝতে পারব। এখন নিউইয়র্কের আন্ডারপাসের কথা বলি। ওদের পাতাল রেলগুলোর নাম খুব সুন্দর। যেমন, E train, F train ইত্যাদি। আমি এফ ট্রেনে বেশি উঠতাম। এফ ট্রেন দিয়ে গেলে একটি স্টেশন পড়ে। সেটির নাম লেক্সিংটন-৬৩। আমার যতদূর মনে পড়ে, এই স্টেশনে নেমে আপনি যখন পাতাল থেকে ওপরে উঠবেন অর্থাৎ নিউইয়র্কের সার্ফেসে বা মাটিতে উঠবেন তখন আপনাকে অন্তত ২০টি তলা ওপরে উঠতে হবে। অবশ্য ওপরে ওঠার জন্য এস্ক্যালেটর, সিঁড়ি ইত্যাদি রয়েছে। চিন্তা করুন কম করে হলেও মাটির নিচে ২০ তলা বিল্ডিংয়ের সমান নি¤œতায় তারা স্টেশন বানিয়েছে আজ থেকে ১১২ বছর আগে এবং সেই সাথে এস্ক্যালেটর, সিঁড়ি ইত্যাদি বানিয়েছে।
শেষ করব একটি ঘটনা দিয়ে, যেটি সততার জলন্ত উদাহরণ। আমি স্বপরিবারে ৩৩ নম্বর স্টেশন থেকে এফ ট্রেনে উঠে এক জায়গায় যাব। এজন্য স্টেশনে ২০ ডলারের টিকেট কিনব। ডলার মেশিনে ঢুকালে সমমূল্যের টিকেট বেরিয়ে আসে। আমি ২০ ডলার ঢুকালাম। কিন্তু টিকেটও এলো না, টাকাও ফেরত এলো না। যিনি ঐ স্টেশনের দায়িত্বে ছিলেন তাকে বললাম। তিনি বললেন, আপনি কমপ্লেইন করুন। আমি একটি লিখিত কমপ্লেইন দিলাম। তারপর আর খবর নেই। ৭ দিন পর রেল কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে একটি চিঠি পেলাম। চিঠিতে বলা হয়েছে, ঐ দিন যত ডলারের টিকেট বিক্রি হয়েছে সেই টিকেট এবং ডলার মিলিয়ে দেখা গেল, বিশ ডলার বেশি, যার বিপরীতে কোনো টিকেট বিক্রি হয়নি। সুতরাং তোমার অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণিত হল। তাই তোমার কাছে এই পত্রের সাথে ২০ ডলারের একটি টিকেট পাঠালাম।
প্রিয় পাঠক, এমন সততা বাংলাদেশে কি আপনি কল্পনাও করতে পারেন?
Email: journalist15@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন