নিষিদ্ধ পলিথিনের যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। দিন দিন এর উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার বেড়েই চলছে। বাজারগুলোতে মুদি দোকান থেকে শুরু করে মাছ, মাংস, শাক-সবজি, ডিম, তরকারি, ফল ও মিষ্টির দোকানসহ যেকোনো পণ্য বিক্রিতে সঙ্গে দেয়া হচ্ছে পলিথিনের ব্যাগ। এতে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ, ক্ষতি হচ্ছে কৃষিজমির। এ ছাড়া পলিথিনে তলদেশ ভরাট হয়ে নদী হারাচ্ছে তার স্বাভাবিক প্রবাহ। পলিথিনের এ ভয়াবহ দূষণ বন্ধে প্রশাসনের নেই জোরালো কোনো উদ্যোগ।
পরিবেশ সংরক্ষণের স্বার্থে ২০০২ সালে পলিথিন শপিং ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে সরকার। এ ছাড়া পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী পলিথিনে তৈরি সব ধরনের শপিং ব্যাগ উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রি ও বিক্রির জন্য প্রদর্শন, মজুদ-বিতরণ নিষিদ্ধ। এর ব্যত্যয় হলে জেল-জরিমানার বিধান রয়েছে। অথচ এ আইন লঙ্ঘন করেই প্রশাসনের নাকের ডগায় বাজারগুলোতে অবলীলায় বিক্রি হচ্ছে পলিথিন ব্যাগ।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সারাদেশে অবৈধ পলিথিন তৈরির কারখানা রয়েছে কমপক্ষে ১৫০০। এরমধ্যে পুরান ঢাকা এবং বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে রয়েছে কমপক্ষে ৭ শতাধিক কারখানা। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে প্রতিদিন কোটি কোটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার শেষে ফেলে দেয়া হয়। ফেলে দেয়া পলিথিন ব্যাগের একটা বিরাট অংশ কোনো না কোনোভাবে নদীতে গিয়ে পড়ছে। দীর্ঘদিন ধরে নদীর তলদেশে পলিথিনের পুরু স্তর জমেছে। এতে নদী তার স্বাভাবিক প্রবাহ হারিয়ে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, অনেক দেশ আইন করে প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করেছ। কিন্তু আমাদের দেশে, স্থলের পর এবার নদী-সাগরকে বিষিয়ে তুলেছে বিষাক্ত পলিথিন ও প্লাস্টিক। তারপরও সচেতনতা বাড়ছে না। মানুষ, প্রাণি ও পরিবেশকে রক্ষা করতে পলিথিন ও ওয়ানটাইম প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। তারা বলছেন, পলিথিন নিষিদ্ধ হওয়ার পরও সারাদেশে চলছে এর অবাধ ব্যবহার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনেই রাজধানীসহ সারাদেশেই পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার চলছে। আবার পুরনো পলিথিন পুড়িয়ে তৈরি করা হচ্ছে নতুন পলিথিন। এতে মারাত্মকভাবে বায়ু দূষণ হচ্ছে। পলিথিন পোড়ালে কার্বন মনো-অক্সাইড তৈরি হয়ে বাতাস দূষিত করে। এদিকে পলিথিনের জন্য সমুদ্রের জীববৈচিত্র্যেও পরেছে ঝুঁকির মুখে।
এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) এক জরিপে দেখা গেছে, প্রতি বছর ৮৭ হাজার টন ওয়ানটাইম পলিথিন ও প্লাস্টিক বাংলাদেশে ব্যবহৃত হয়। একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের মধ্যে রয়েছে প্লাস্টিক স্ট্র, কটনবাড়, ফুড প্যাকেজিং, ফুড কনটেইনার, বোতল, প্লেট, প্লাস্টিক চামচ, কাপ, প্লাস্টিক ব্যাগ, পেস্ট, শ্যাম্পুর প্যাকেট ইত্যাদি। মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার ও বর্জ্য অব্যবস্থাপনার কারণে এসব প্লাস্টিক কৃষিজমি, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা, নদী-নালা, খাল-বিল ও সমুদ্রে পতিত হয়ে এসব পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থার মারাত্মক ক্ষতি করছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল ইনকিলাবকে বলেন, পলিথিন বন্ধে সরকার যথেষ্ট আন্তরিক নয়। সরকার যদি মনে করে পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধ করবে তাহলে সেটা সম্ভব। এর আগে পলিথিনের মহামারি থেকে দেশকে বাঁচাতে পরিবেশমন্ত্রী হিসাবে শাহজাহান সিরাজ সারাদেশে এর উৎপাদন, বিপনন এবং ব্যবহার প্রায় বন্ধ করতে সক্ষম হয়ে ছিলেন। কিন্তু সে সময়ের সরকার পরিবর্তনের পর পলিথিনের উদৎপাদন, বিপনন এবং ব্যবহার ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে। কালক্রমে পলিথিনের ব্যবহার আবারও মহামারিরূপ নিয়েছে। আমরা এর বিরুদ্ধে যতই চিৎকার চেঁচামেচি করি না কেন তাতে কোনো লাভ হবে না। আমরা সব সময়ই এসব নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছি, কিন্তু তারপরেও কাজ হয় না। কেননা নিষিদ্ধ এই পলিথিনের উৎপাদন ও বিপনন হচ্ছে পরিবেশ অধিদফতরের এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজসে। তাই সরকার যতদিন আন্তরিক না হবে, কঠোর না হবে ততদিন এই নিষিদ্ধ পলিথিনের উৎপাদন, বিপনন ও ব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব নয়।
সম্প্রতি রাজধানীর, খিলগাঁও রেলগেইট কাঁচাবজার, মালিবাগ, শান্তিনগর, রামপুরা, কাওরান বাজার, হাতিরপুল বাজার, নিউমার্কেট, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, যাত্রাবাড়িসহ অন্তত ২০ থেকে ২৫টি বাজার ঘুরে পলিথিন ব্যাগের ছড়াছড়ি দেখা গেছে। মাছ, মাংস, সবজি, ডিম, তরকারি, পান-সুপারি, ফল, মিষ্টি ও মনোহরি পণ্যসহ প্রায় সবই বিক্রি হচ্ছে পলিথিন ব্যাগে।
মহল্লার বা অলি-গলির দোকানপাট থেকে শুরু করে বড় বড় বাজারগুলোতে দেখা যায়, ক্রেতাদের অধিকাংশের হাতেই পলিথিন ব্যাগ। সবজি, মাছ, মাংস, ডাল যাই কিনছেন, তার প্রতিটিই আলাদা আলাদা পলিথিন ব্যাগে দেয়া হচ্ছে।
শান্তিনগর কাঁচাবাজারের সবজি বিক্রেতা মো. জাহেদ বলেন, কাস্টমাররা এখন আর বাজারে ব্যাগ নিয়ে আসেন না। বাধ্য হয়েই পলিথিন ব্যাগ দেয়া লাগে। কী করুম, ব্যাগ না দিলে তো আবার সদাই কিনতে চায় না।
তবে ক্রেতাদের দাবি, দোকানে পলিথিন ব্যাগ রাখা হয় বলেই তারা এর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। মো. কিবরিয়া নামের এক ক্রেতা বলছিলেন, কিছু কেনার সময় বিক্রেতারাই পলিথিন ব্যাগে ভরে দেয়। তাই আমরাও নেই। তারা বিক্রি বন্ধ করে দিলে আমরাও সচেতন হয়ে যাব।
পরিবেশ ও কৃষিজমির বারোটা
পরিবেশ নিয়ে কাজ করেন এমন ব্যক্তিরা বলছেন, নিষিদ্ধ এই পলিথিন একই সঙ্গে কৃষিজমি ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করে। এটি একটি অপচনশীল প্লাস্টিকজাতীয় পদার্থ, যা দীর্ঘদিন পর্যন্ত অপরিবর্তিত, অবিকৃত থেকে মাটি ও পানি দূষিত করে। এতে মাটির উর্বরতা শক্তি ও গুণ নষ্ট হয়ে ফলন কমে যায়। এর বাইরে যত্রতত্র পলিথিন পড়ে থাকা, আগুনে পোড়ালে বাতাস দূষিত করা এবং পয়োঃনিষ্কাশনে বাধা তৈরিসহ নানাভাবে পরিবেশকে দূষিত করে।
পলিথিনের ভয়াবহ দিক নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিকস অ্যান্ড প্ল্যান্ট ব্রিডিং বিভাগের অধ্যাপক মেহফুজ হাজান বলেন, পলিথিনের সংস্পর্শে এলে গাছ বা চারার শিকড় গজাতে পারে না। ফলে গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়ে সময়মতো ফলন হয় না বা হলেও প্রত্যাশা অনুযায়ী হয় না। পলিথিনের ক্ষতিকর রাসায়নিক গাছপালা, উদ্ভিদ ও মানবদেহের জন্যও ক্ষতিকর।
নেই প্রশাসনের জোরালো উদ্যোগ
রাজধানীর, খিলগাঁও রেলগেইট, মালিবাগ এবং শান্তিনগর কাঁচাবজারে ঘুরে অন্তত ১৫ থেকে ১৬ জন ক্রেতা-বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত দুই বছরে পলিথিন বিক্রির ওপর প্রশাসনের কোনো নজরদারি দেখেননি তারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে শান্তিনগর কাঁচাবাজারের এক ফল বিক্রেতা ইনকিলাবকে বলেন, গত ১০-১২ বছর ধরে এখানে ফল বিক্রি করি। কিন্তু পলিথিন ব্যাগ বিক্রির ব্যাপারে কেউ কিছু বলে নি। নিষেধও করে নি।
মালিবাগ কাঁচাবাজারের দোকানিরা জানান, সপ্তাহে একদিন কয়েকজন খুচরা বিক্রেতা এসে তাদের পলিথিন ব্যাগ দিয়ে যান। দোকানে দোকানে ঘুরে বিক্রি করেন এসব পলিথিন ব্যাগ। শুধু মালিবাগ কাঁচাবাজারেই প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে পাঁচ হাজার পলিথিন ব্যাগ বেচা-কেনা হয়।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কার্যকর উদ্যোগ নেই কথাটি পুরোপুরি ঠিক না। আমরা নিয়মিত পলিথিন তৈরির কারখানাগুলোতে অভিযান চালিয়ে পলিথিন জব্দ করছি, জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি দিচ্ছি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন