মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

শিক্ষাব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলবাজি-বাণিজ্য ও অনৈতিক বৈষম্য রুখতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২১ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

জামালউদ্দিন বারী : দেশের শিক্ষাব্যবস্থা রীতিমত শিক্ষাবাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। প্রাক-প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার কোন স্তরই তার কাক্সিক্ষত মান অর্জন করতে পারছে না। শিক্ষাব্যবস্থার এই অবনমন ও অবক্ষয় কবে থেকে শুরু, কখন তা শেষ হয়ে জাতি একটি যথার্থ মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারবে, এ প্রশ্নের উত্তর কারো জানা নেই। সরকার শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কিছু সক্রিয় পরিকল্পনা, তৎপরতা ও উদ্যোগ গ্রহণ করছে বটে, এসব উদ্যোগ শিক্ষার কাক্সিক্ষত মানোন্নয়নের বদলে শিক্ষার নৈতিক মানে ধস নামিয়ে, বৈষম্য বাড়িয়ে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাকে আরো পশ্চাৎপদ করে তোলা হচ্ছে। ব্রিটিশ আমলে এদেশে রাজকর্ম পরিচালনার জন্য কেরানী এবং ব্রিটিশ ভাবধারার আমলা সৃষ্টির উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল। এর ফলে হিন্দু-মুসলমানের সাংস্কৃতিক ভাবধারা, ধর্মীয় ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের শিক্ষা থেকে জাতি পিছিয়ে পড়তে বাধ্য হয়। এর বিপরীতে উপনিবেশবাদী, ধনতান্ত্রিক ও ভোগবাদী সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষণের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠে। পাকিস্তান আমলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা কারিকুলামে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধ সম্পৃক্ত পাঠ্যসূচি গ্রহণ করা হলেও শিক্ষার আধুনিকায়ন ও যুগোপযোগীকরণের বাস্তব উদ্যোগ ছিল অপ্রতুল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একটি নবীন জাতিকে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যেতে প্রথমেই দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের দিকে নজর দেয়ার কথা থাকলেও স্বাধীনতা-উত্তর কোন সরকারই তা করেনি। অনেক দেরিতে হলেও বর্তমান সরকার একটি নতুন শিক্ষানীতির আলোকে শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুনভাবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিলেও এরই মধ্যে সরকারের নতুন শিক্ষানীতি এবং ইতিমধ্যে গৃহীত পদক্ষেপগুলো জাতির কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। প্রথমত শিক্ষার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর থেকে ইসলাম ও ধর্মীয় নৈতিক মূল্যবোধের সাথে সম্পর্কযুক্ত পাঠ্যসূচি পরিবর্তন করে তথাকথিত সেক্যুলার, ক্ষেত্র বিশেষে বিজাতীয় সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষণের অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তনের প্রত্যাশায় শিক্ষাকে বাণিজ্য ও বৈষম্যমুক্ত করার কথা থাকলেও নতুন নতুন পাবলিক পরীক্ষা প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে শিক্ষাকে প্রাথিমক স্তর থেকে ব্যয়বহুল সার্টিফিকেট সর্বস্ব করে তোলা হয়েছে। নতুন শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষাকে ৫ম শ্রেণী থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীত করা হলেও এখনো ৫ম শ্রেণীতে শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা চালু রাখার মধ্য দিয়ে শিক্ষাবাণিজ্য ও অনৈতিক প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। দেশে তথাকথিত নামিদামি স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তকমা গড়ে তোলা হয়েছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি থেকে শুরু করে টিউশন ফি ও কোচিংয়ের খরচ জুগিয়ে সন্তানদের পড়ালেখার পেছনে বেশীরভাগ অভিভাবককে তার আয়ের একটি বড় অংশই ব্যয় করতে হয়। অথচ আমাদের সংবিধান বিনামূল্যে সকলের জন্য মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার নিশ্চয়তা দিচ্ছে। একটি শিশুকে তথাকথিত নামি-দামি স্কুলে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণীতে ভর্তি করাতেও ভর্তি কোচিং, ভর্তি বাণিজ্যের শিকার হতে হয়। শিক্ষা নিয়ে তথাকথিত নামি-দামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর এই মুনাফা বাণিজ্য একটি শিশুর শিক্ষা জীবনের শুরু থেকে শেষপর্যন্ত অনৈতিক লেনদেনের সাথে সম্পৃক্ত করে তোলে।
ঢাকার নামি-দামি বেসরকারি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি প্রক্রিয়া এবং শিক্ষাবাণিজ্যের কথা আমরা জানি। তবে পাবলিক স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পেছনে জনগণের রাজস্ব থেকে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করার পরও কেন সেখানে শিক্ষামানের ক্রমাবনতি ঘটছে? এই প্রশ্ন এখন সচেতন জনগণের। মূলত দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তার কাক্সিক্ষত মান অর্জন করতে বা ধরে রাখতে ব্যর্থতার পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক সন্ত্রাস, শিক্ষক ও ছাত্রদের লেজুড়বৃত্তির দলবাজি, টেন্ডারবাজি ও নিয়োগ বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ার মধ্য দিয়েই আমাদের সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থা চলমান অবক্ষয়ের শিকার হয়েছে। সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দেশ ও জাতির হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য, চলমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা করে আগামী দিনের নেতৃত্ব ও নাগরিক সমাজের হাতে সঠিক দিক নির্দেশনা তুলে ধরাই দেশে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মূল লক্ষ্য। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলো আজ যে বিশ্বনেতৃত্ব গ্রহণ করেছে তার পেছনের মূল ভূমিকা পালন করছে সেসব দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও বিজ্ঞান গবেষণাগারগুলো। ষোল কোটি মানুষের বিশাল জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই তরুণ প্রজন্মের অন্তর্ভুক্ত। এই তরুণ প্রজন্মের কোটি কোটি সদস্যের বিচ্ছিন্ন ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশে উপযুক্ত কর্মসংস্থান না থাকায় লাখ লাখ বাংলাদেশী তরুণ কর্মসংস্থানের জন্য সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। এদের অনেকেই বিদেশেই স্থায়ী ঠিকানা গড়েছেন। শুধু অদক্ষ-স্বল্পদক্ষ শ্রমিক হিসাবেই নয় মেধাবী শিক্ষার্থী-শিক্ষকতা, সমাহকর্ম, রাজনীতিসহ বুদ্ধিবৃত্তিক ও হোয়াইট কলার পেশায়ও বাংলাদেশীরা বিদেশের মাটিতে যতটা সুনামের সাথে এগিয়ে চলেছে স্বদেশে সে সম্ভাবনার আংশিকও যদি বিকাশের পথ পেত, তাহলে বাংলাদেশ চীন-জাপানের সমকক্ষ একটি সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত হত।
চার বছর বয়সী বাংলাদেশী শিশু সুবর্ণ বারীকে নিয়ে সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্সের শিক্ষক চট্টগ্রামের রাশিদুল বারীর ছোট ছেলে সুবর্ণ এই বয়েসেই উচ্চতর গণিত ও বিজ্ঞানের জটিল সমস্যার সমাধান দিতে পারছে। পদার্থবিদ্যা ও রসায়নের পর্যায় সারণিগুলোর (পিরিয়ডিক টেবিল) সবকিছুই বলে দিতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানী ও গবেষকরা আইজাকের তীক্ষè মেধা ও প্রতিভা যাচাই করে বিস্ময় প্রকাশ করে ওকে ক্ষুদে আইনস্টাইন খেতাবে ভূষিত করেছেন। সেখানকার গণমাধ্যমও আইজাককে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আইজাক বারীকে হোয়াইট হাউজে আমন্ত্রণ জানিয়ে শিশুটিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যতের অমূল্য সম্পদ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এভাবেই আমাদের শিশুরা বিদেশে গিয়ে অমূল্য সম্পদে বিভূষিত হচ্ছে। এমন লাখ লাখ সুবর্ণ  বাংলাদেশে সঠিক শিক্ষা, সামাজিক-পারিবারিক পরিবেশ ও পরিচর্যার অভাবে বিকশিত হতে পারে না। এমনকি অনেক সম্ভাবনাময় শিশু ও তরুণ-তরুণী সামাজিক অবক্ষয় ও নির্মমতার শিকার হয়ে অকালে হারিয়ে যায়। আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র ও শিক্ষাব্যবস্থা এদের মেধা ও সৃষ্টিশীল প্রতিভা বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলতেই শুধু ব্যর্থ হচ্ছে না, সুস্থ, সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাও আমরা নিশ্চিত করতে পারছি না।
দেশের বাইরে গিয়ে কিছু প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আমাদের শিশু-কিশোর ও তরুণদের সৃষ্টিশীল প্রতিভা বিকশিত হওয়ার আরো অনেক উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পাঠ শেষ করতেই যেখানে জীবনের প্রথম ২৫ বছর পেরিয়ে যায়। চাকরি নামক সোনার হরিণ ধরতে আরো কয়েক বছর জুতার তলা ক্ষয় করে, বিসিএস গাইড বই মুখস্থ করে, লাখ লাখ টাকা ঢেলে তবেই চাকরির দেখা মেলে। অথবা পৈতৃক জমিজিরাত বিক্রি করে অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে বিদেশে পাড়ি জমানো। সেখানে লন্ডনে ১৯৯০ সালে জন্মগ্রহণকারী বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত সাবিরুল ইসলাম ১৭ বছর বয়েসেই সেলিব্রেটি লেখক, এন্ট্রেপেনার ও ট্রেইনার বক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। বিশ্বের অন্তত ২৫টি দেশে সাবিরুল লাখ লাখ তরুণকে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। তার লেখা বই স্বল্প সময়ে হাজার হাজার কপি নিঃশেষ হয়ে যায়, ১৫টি ভাষায় অনূদিত হয়। সাবিরুল আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রচ্ছদ শিরোনাম হয়। বিশ্বের সেরা শিল্পোদ্যোক্তাদের তালিকায় স্থান লাভ করে। একইভাবে ক্যালিফোর্নিয়ায় বসবাসকারী বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত তরুণী সুমাইয়া কাজীর কথা তুলে ধরা যায়, যিনি রয়টার্সের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০ জন তরুণ শিল্পোদ্যোক্তার তালিকায় ১৬ নম্বরে স্থান পেয়েছেন। কিশোরগঞ্জের মেয়ে মাহিয়া আবেদিন রাখি ২০১০ ও ২০১২ সালে ইতালীতে এসএসসি ও এইচএসসি সমমানের পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সকল বিষয়ে ১০০ থেকে ১০০ নম্বর পেয়ে সমগ্র ইতালীতে প্রথম হয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। ইতালীর প্রেসিডেন্ট রাখির প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে প্রেসিডেন্ট ভবনে আমন্ত্রণ জানিয়ে পুরস্কার দিয়েছিলেন। ঢাকার বুয়েট থেকে ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পাস করে কানাডার ক্যালগেরি ইউনিভার্সিটিতে স্তন ক্যান্সার গবেষণায় চাঞ্চল্যকর সাফল্য ও কৃতিত্বের জন্য শান্তনু বণিকের পুরস্কৃত হওয়ার গল্প। অথবা হলিউড সিনেমায় ফ্লুইড ডাইনামিক্সের কাজ করে অস্কার পুরস্কারে ভূষিত একমাত্র বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত তরুণ নাফিস বিন জাফরের কথা, বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের ভ্যাক্সিন ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত ডাক্তার আমজাদ হোসেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে খান একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত সালমান খান সেরা উদ্যোক্তা হিসেবে টাইম ম্যাগাজিনের সেরা ১০০ ব্যক্তিত্বের তালিকায় বারাক ওবামা, ওয়ারেন বাফেট ও হিলারি ক্লিন্টনদের পাশে স্থান পেয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও বিভিন্ন দেশে উদ্যোক্তা, উদ্ভাবনী প্রতিভা ও সমাজকর্মে বাংলাদেশী তারুণ্যের আরো অসংখ্য উজ্জ্বল উদাহরণ আছে।
গত রবিবার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর পক্ষ থেকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হতে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। এর আগেও কথা আছে, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের মতাদর্শের বাইরে অন্যদের টাকা দিয়েও নিয়োগ পাওয়ার সুযোগ নেই। তিনি যত মেধাবী ও সম্ভাবনাময় হোন না কেন। যেখানে বাংলাদেশি তরুণ-তরুণীরা অক্সফোর্ড, হারবার্ড, প্রিন্সটন, বোস্টন, এমআইটি, কেলগারিসহ পশ্চিমা দুনিয়ার বিভিন্ন নামি-দামি ইউনিভাসির্টিতে শিক্ষকতার সুযোগ পাচ্ছেন, সেখানে দেশে আমাদের মেধাবী তরুণরা রাজনৈতিক বৈষম্য দুর্নীতির শিকার হয়ে চরমভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন। কোন নীতিবান মেধাবী তরুণ লাখ লাখ টাকা খরচ করে শিক্ষকতার মত মহৎ পেশায় নিয়োগ লাভের চেষ্টা করবেন কিনা, এ বিষয়ে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে। অতএব লাখ লাখ টাকা খরচ করে নীতিহীন, মেধাহীন দলবাজ ব্যক্তিরাই কি এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার প্রতিযোগিতায় রয়েছেন? এটি কোন হাইপোথেটিক্যাল প্রশ্ন নয়। টিআইবির রিপোর্ট প্রকাশের অনেক আগে থেকেই আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান, শিক্ষার পরিবেশসহ সার্বিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে এই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। একদিকে সেক্যুলার, ধনতান্ত্রিক-বস্তুবাদী জীবন দর্শন অন্যদিকে রাজনৈতিক সন্ত্রাস-লুটপাট, দুর্নীতি ও লেজুড়বৃত্তি সর্বস্ব রাজনৈতিক নিয়োগনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা, অন্যদিকে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ভর্তি বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য ও সার্টিফিকেট বাণিজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা কায়েম করে জাতিকে একটি অতল অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। আমাদের সরকার ও রাজেনৈতিক নেতৃত্ব জাতির সামনে যতই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হিসাব-নিকাশ ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখান, শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাঙ্গনকে দলীয় রাজনৈতিক বলয়ে আবদ্ধ রেখে তা কখনো সম্ভব নয়।  
‘ভীড় করে ইমারত আকাশটা ঢেকে দিয়ে চুরি করে নিয়ে যায় সকালের সোনা রোদ/ ছোট ছোট শিশুদের শৈশব কেড়ে নিয়ে গ্রন্থকীটের দল বানায় নির্বোধ’ শিল্পী নচিকেতা চক্রবর্তীর গাওয়া ‘চোর’ শিরোনামের এই গানটি নব্বই দশকের শুরুতে দুই বাংলার তরুণদের মধ্যে বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। এ সময়ের সমাজবাস্তবতা নির্ভর গানটি এখনো বেশ জনপ্রিয়। আমাদের গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থা ও সামাজিক অবক্ষয়ের শিকার হওয়ার মধ্যে যে চিন্তাসূত্র নিহিত আছে, এই গান সেই চিত্রটিকেই ফুটিয়ে তুলেছে।  এখন ডিসেম্বর মাস শেষ হতে চলেছে। ঢাকাসহ সারাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি বাণিজ্যের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা শিশুদের এমন গ্রন্থকীটে পরিণত করছে, যে গ্রন্থ তাকে অমানবিক, অসৎ ও যেনতেন প্রকারে টাকা কামাইয়ের যন্ত্রে পরিণত করছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের উচ্চ আদালত শিশুদের কাঁধে বইয়ের বোঝা কমিয়ে দেয়ার নির্দেশনা জারি করেছেন। যে শিশুটি বাবা মা ভাইবোনদের হাত ধরে, বন্ধুদের সাথে শ্রেফ খেলাধুলা ও ঘুরে বেড়িয়ে সময় পার করার কথা, সে শিশুটির কাঁধে একগাদা বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দেয়ার পাশাপাশি স্কুলের বাইরের পুরো সময়টুকু নিরানন্দ ও ভীতিকর হোমওয়ার্ক ও সাপ্তাহিক-মাসিক-সেমিস্টার ও বার্ষিক পরীক্ষায় সদাব্যস্ত রাখা হচ্ছে। দেশের শিক্ষানীতি ও শিক্ষা কারিকুলামের প্রণেতাদের মধ্যে কি শিশু মনস্তত্ত্ব ও শিক্ষামনোবিজ্ঞানের কোন বিশেষজ্ঞ নেই। শিশুদের বইয়ের বোঝা কমাতে হাইকোর্টকে কেন নির্দেশনা জারি করতে হবে?
প্রতিটি শিশুই অপরিমেয় সম্ভাবনা নিয়ে জন্মায়। আমরা পিতা-মাতা, সমাজ এবং রাষ্ট্র তাদের একটি বাঁধাধরা ছাচে ফেলে নিজেদের মত নির্মাণ করতে গিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই সম্ভাবনাটুকু নষ্ট করে ফেলি। এভাবেই চুরি হয়ে যায় দিনবদলের আশা-প্রতিবাদের ভাষা। শিশুদের হাতে আগামী বিশ্বের নেতৃত্ব তুলে দেয়ার আগে তাকে অবশ্যই আধুনিক বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার যোগ্যতাসম্পন্ন দক্ষ-যোগ্য সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলতে হবে। মানবিক গুণাবলী, সততা, নিয়ম-নিষ্ঠা এবং দেশ ও জাতির প্রতি কমিটমেন্ট ও ত্যাগের শিক্ষাই একজন মানুষকে নেতৃত্বের যোগ্যকরে তুলতে পারে। শিক্ষা জীবনের শুরু থেকে শিক্ষকতার শুরু ও শেষ পর্যন্ত অনৈতিক লেনদেন বাণিজ্যের মধ্য দিয়ে যে নতুন প্রজন্ম গড়ে উঠছে তার একটি বড় অংশই সামাজিক, রাজনৈতিক ও পেশাগত জীবনে দুর্নীতি ও অনৈতিকতায় অভ্যস্থ হয়ে পড়ছে। অনৈতিক ও অমানবিক প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে কোন জাতি তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না। খ-িত ও দলীয় রাজনৈতিক চিন্তা পরিহার করে বৈষম্যমুক্ত একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার উপযুক্ত, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ সম্পৃক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়নের বাস্তবসম্মত উদ্যোগই জাতির সর্বোচ্চ প্রত্যাশিত অগ্রাধিকার।
bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন