শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মুক্তাঙ্গন

দেশে গরিবের ভাত নাই

| প্রকাশের সময় : ২১ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

রায়হান রাশেদ : গরিব কৃষক। কোনো রকম খেয়ে পড়ে বেঁচে আছে। কাজ করে সিলেটের চা বাগানে। নি¤œ শ্রেণির শ্রমিক। সিলেট থেকে যাত্রা করেছে আজিমপুর। আজিমপুরে যাত্রা বিরতি টানবে।
কালনী ট্রেনে ওঠে পোহাতে হলো অভাবনীয় দুর্ভোগ। ধরা পড়ল টি.টি. ও অ্যাটেন্টম্যানের হাতে। গুণতে হলো ডবল ভাড়া। অশিক্ষিত মানুষ টি.টি’র সব উপদেশ ঘাড় পেতে মেনে জরিমানা দিল। কৃষকের দোষ টিকেট কাটেনি। অথচ গরিব অশিক্ষিত ভীতু লোকটি ট্রেনে ওঠেছে দৌঁড়ে। সে কি আর টাইম জানে? তার হাতেই বা ইলেক্ট্রিক যন্ত্রপাতি আছে কই?
জরিমানাসহ ভাড়া দিয়ে লোকটি অসহায় নয়নে তাকিয়ে আছে ট্রেনের দেয়ালের দিকে। ঠোঁট কাঁপছে। চোখে পানির ঝাপসা কুয়াশা। ট্রেনের দেয়ালে হয়তো সে হিসাব কষছে হাত থেকে চলে যাওয়া টাকার। এই টাকায় হয়তো আদরের মেয়ের জন্য একটা পুরাতন শীত বস্ত্র কেনা যেত।
ঘণ্টা দুয়েক পর আবারও টি.টি ভাড়া দিতে বলল। এবার গরীব চেঁচিয়ে উঠল। টি.টি’র ঝাঁঝাল কণ্ঠ- ‘আজিমপুর থেকে ভৈরব যাচ্ছেন ভাড়া দিবেন না’? ‘দিতাম না। দিতাম না। দিতাম না’। সে ভুলে ভৈরব চলে এসেছে। চিন্তার সমুদ্দুর হতে উত্তলন হতে পারেনি বলে ট্রেন তাকে নিয়ে এসেছে ভৈরব।
টি.টি কপাল ভাঁজ করে মোবাইল টিপছে। গরিব লোক নামতেই ধরা পড়ল টি.সি’র হাতে। টি.টি হয়তো মোবাইলে টি.সি-কে এসএমএস করেছিল। সে কাচুমাচু করছে। অনুরোধে বারবার ঘাড় কাত করছে। ফল নেই। ওরা এমনই। পাশের একজন বলল ‘আহ্, আবারও লোকটির জরিমানা। হালার শিক্ষিত মানুষরে’। দ-ায়মান জীর্ণ পোশাকের আরেকজন লোক বলল ‘দেশে গরিবের ভাত নাই’।
গাড়িতে চড়ছি। বড় রাস্তায়। বন্ধুর বোনকে রক্ত দিতে। সদ্য জন্ম নেওয়া মতিউর নগর বরাবর এসে গাড়ি থেমে গেল। ঢুকে পড়ল মাটির রাস্তায়। ড্রাইভারকে বললাম- ‘আরে ভাই ভেতরে যাচ্ছ কেন? ভৈরবে যাবে না’? ‘শুনেন নাই, সামনে পুলিশ আছে। ধরা পড়লে তো পাঁচ ছয় হাজার টাকা দিতে অইব। মাসে কামাই করি কত? আমার তো আর নেতা-হেতা নাই। ফোন দিলে ছাইড়া দিবে। গরিব হইয়া কেন বা জন্মাইলাম। বাবার জমি বেইচ্চা গাড়ি  কিননা রোডে চালাইতে পারি না। গরিব হইয়া মরছি। ভাই, দেশে গরিবের ভাত নাই’।
গ্রামের পঞ্চান্ন বছরের বৃদ্ধ লোকটির ৮ শতাংশের ৪ শতাংশই পার্টির নেতার দখলে। নেতা বৃদ্ধের জায়গায় ইমারত নির্মাণ করেছেন। বৃদ্ধ জেলে অন্য নেতাদের দোয়ারে দোয়ারে হাজিরা দিতে দিতে পায়ের নিচের শুভ্র চামড়ায় ছোট ছোট ফুটো হয়ে গেছে। কোন ফল হয় না। তার পাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার কেউ নেই। বেশি কিছু বলতে গেলে ভিটা বাড়িটাও হারাবার আশঙ্কা। পৈতৃক জমি পরের দখলে। হায়! গ্লানি। হায়! অসহায়ত্ব। টাকা-বৈভবের অভাব তাকে নুইয়ে ফেলেছে। সেও হতাশায় ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে দীর্ঘশ্বাসে উচ্চারণ করে ‘দেশে গরিবের ভাত নাই’।
দেশে গরিবের ভাত নেই। তার মানে গরিব কি না খেয়ে সব মারা যাচ্ছে? না, না খেয়ে মারা যাচ্ছে বিষয়টি এমন নয়। তারা বেঁচেও মরে আছে।
গরিব মানুষ। তারা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত। পাওনা থেকে বঞ্চিত। সঠিক বিচার পাওয়া তাদের অধিকারে পড়ে না। টাকার মালিক, বংশীয় দাম্ভিকতা, গায়ের জোর, রাজনৈতিক নেতাদের কবলে অত্যাচারিত। নিপীড়িত। গরিবের ভাঙা কিস্তিকেও তলিয়ে দিতে চায় আজকের সুশীল সমাজ ও অর্থান্বেষণে মরিয়া ধূর্তরা। তাদেরকে শিকলে আবদ্ধ রেখে শোষণ করতে চায়।
গরিব সে তো স্বাধীন বাংলার মানুষ। এ মাটির সন্তান। তার বাবাদের হাতে এ দেশ স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। মুক্তির লাল সূর্য দেখতে পেরেছে জাতি। যে অধিকার রক্ষার জন্য বাঙালি জাতি নিজের তাজা খুন জমিনে ঢেলে দিয়েছে। জীবন উৎসর্গ করেছে। বুলেটের সামনে উদোম বুক পেতেছে। মা-বোন ধর্ষিতা হয়েছে। নিজ মূল্যবান সম্পদ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে সোপর্দ করেছে সে অধিকার কি রক্ষা হয়েছে?  তাদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে আমরা কতটুকু সম্মান জানাতে পারছি। কতটুকুই বা শান্তি পৌঁছাতে পারছি তাদের আত্মায়।
এক সাগর রক্তে অর্জিত স্বাধীন দেশে কেন গরিব অসহায় হয়ে তার অধিকার হারাবে? পদে পদে লাঞ্ছিত ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে? কেন সঠিক বিচারের জন্য নেতাদের দুয়ারে-দুয়ারে ঘুরে বেড়াবে? স্বাধীন দেশের সন্তানরা কেন কলিজার ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাসে উচ্চারণ করবে ‘দেশে গরিবের ভাত নাই’?
ষ লেখক : সমাজ গবেষক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন