পথশিশুকে অপহরণ করে বিক্রির চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গৃহকর্মী হিসেবে চার বছর ধরে নির্মম নির্যাতন। এমন একজন অপহরণকারীকে গ্রেপ্তার ও গৃহকর্মী হিসেবে নির্মম নির্যাতনের শিকার এক অসহায় পথশিশুকে উদ্ধার এবং অপহরণকারীকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-৩।
রোববার রাতে রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে চার তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের নাম- মো. আব্দুল্লাহ (৩৯)
র্যাব বলছে, গ্রেপ্তার আব্দুল্লাহ ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে গুলশান আজাদ মসজিদ এলাকায় ১২ বছরের শিশুকে ফুল ও কাগজের স্টিকার বিক্রি করতে দেখে। পরে নানা প্রলোভন দেখিয়ে অপহরণ করে খিলগাঁও স্টিলের কারখানায় আটকে রাখে। পরে গৃহপরিচারিকা হিসেবে ২০ হাজার টাকায় বিক্রির চেষ্টা করে। কিন্তু আটকে রাখার কারণে মেয়েটি অসুস্থ হয়ে পড়ায় দালাল চক্র কিনতে অস্বীকৃত জানায়। পরে আব্দুল্লাহ নিজ বাসায় মেয়েটিকে নিয়ে গৃহকর্মী হিসেবে নির্মণ নির্যাতন চালায়।
সোমবার দুপুরে রাজধানীর টিকাটুলি নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এসব তথ্য জানান র্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ।
র্যাব জানায়, ২০১৮ সালে এক হতদরিদ্র দিনমজুরের কন্যা সন্তান জীবিকার তাগিদে রাস্তায় ফুল ও কাগজের স্টিকার বিক্রি শুরু করে। প্রতিদিনের মতো ভিকটিম ফুল বিক্রি করতে রাস্তায় যায় এবং দিন শেষে সে আর বাসায় আসেনি। মেয়েকে বাসায় আসতে না দেখে ভিকটিমের পিতা মাতা হন্যে হয়ে বিভিন্ন জায়গায় তার সন্ধান করতে থাকে।
সন্তানকে খুঁজে না পেয়ে গুলশান থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরী করে। ডায়েরী করার ৪ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরেও কোন খোঁজ না পেয়ে তারা র্যাব-৩ এ একটি অভিযোগ করে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এবং গুলশান থানায় নিখোঁজ ডায়েরীর ভিত্তিতে র্যাব-৩ ছায়া তদন্ত শুরু করে জানতে পারে যে, তাদের মেয়েকে অপহরণ করে গ্রেপ্তার আসামী নিজ বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে আটকে রেখে বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন করে আসছে।
গ্রেপ্তার আসামী জিজ্ঞাসাবাদে র্যাব-৩ এর অধিনায়ক জানায়, ২০১৮ সালে সেপ্টেম্বর মাসে গুলশান এলাকার আজাদ মসজিদের সামনে ফুটপাতে পথশিশু ভিকটিমকে ফুল ও কাগজের স্টীকার বিক্রি করা অবস্থায় দেখতে পায়। সেখান থেকেই অপহরণকারী তাকে টার্গেট করে এবং বেশ কয়েকদিন তাকে অনুসরণ করতে থাকে। এরপর একদিন বিকেলে ফুল বিক্রি করার সময় অপহরণকারী ভিকটিমকে ডেকে তার নাম জিজ্ঞেস করে এবং তার ছেঁড়া জামা কাপড় দেখে নতুন জামা কাপড় কিনে দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ভিকটিম শিশুটিকে একটি মার্কেটে নিয়ে যায়।
লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, নতুন জামা কাপড়সহ বিভিন্ন ধরনের খেলনা কিনে দিয়ে ভিকটিমকে অপহরণকারী তার স্টীলের কারখানায় নিয়ে যায়। কারখানায় নিয়ে শিশুটিকে ৭/৮ দিন রাখার পর তাকে স্থানীয় এক দালালের কাছে গৃহ পরিচারিকা হিসেবে ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে বিক্রির জন্য বায়নাপত্র করা হয়। কিন্তু কারখানায় থাকার ফলে খাবার এবং পর্যাপ্ত আলো বাতাসের অভাবে শিশুটি অসুস্থ হয়ে গেলে তার অবস্থা দেখে উক্ত দালাল শিশুটিকে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। শিশুটি অতিমাত্রায় অসুস্থ হয়ে পড়লে একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে আব্দুল্লাহ শিশুটিকে তার নিজ বাসায় নিয়ে যায় এবং তাকে দিয়ে গৃহপরিচারিকার সকল কাজকর্ম করাতে থাকে।
গ্রেপ্তার আব্দুল্লাহ র্যাবকে আরও জানায়, সে মূলত অর্থের লোভে শিশুটিকে চড়ামূল্যে বিক্রির আশায় অপহরণ করেছিল। কিন্তু আশানুরুপমূল্যে বিক্রি করতে না পারায় তার নিজ বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজে ভিকটিমকে নিয়োজিত করে।
র্যাব কর্মকর্তা আরিফ মহিউদ্দিন আরও বলেন, অপহরণের পর আটক থাকাকালীন শিশুটি বাবা মার কাছে যাওয়ার জন্য আব্দুল্লাহর কাছে অনেক কাকুতি মিনতি করলেও তাতে কোন কাজ হয় না। যতদিন যায় শিশুটি তার বাবা মার কাছে যাওয়ার জন্য প্রতিনিয়তই কান্নাকাটি করে এবং তাদের বাসায় যারা নিয়মিত যাতায়াত করত তাদের অনেকের কাছেই শিশুটি তার বাবা মার বস্তির ঠিকানা দিয়ে সেই ঠিকানায় তাকে পৌঁছে দেয়ার জন্য অনুরোধ করত।
এসব দেখে আব্দুল্লাহ এবং তার স্ত্রী শিশুটিকে বিভিন্ন ধরনের হুমকি ধামকি এবং ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। যখনই সে তার বাবা মায়ের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করত তার উপর অমানসিক নির্যাতনের পরিমাণ বেড়ে যেত। এভাবেই দুঃখ কষ্টে নির্যাতনের শিকার হয়ে গ্রেপ্তার আব্দুল্লাহর গৃহ পরিচারিকা হিসেবে ভিকটিম ৪ বছর কাটিয়ে দেয়।
গ্রেপ্তার আব্দুল্লাহ ২০০২ সাল থেকে খিলগাঁও এলাকায় স্টীলের ব্যবসায়ী হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। তার দুই সন্তান (০১ ছেলে ও ০১ মেয়ে) রয়েছে। সে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে এবং এরপর প্রথমে স্টীলের দোকানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করত। পরবর্তীতে সে নিজস্ব একটি স্টীলের কারখানা প্রতিষ্ঠা করে স্টীলের ব্যবসা পরিচালনা করে আসছিল।
উদ্ধারকৃত ভিকটিম ৪ বছর আগে অপহৃত হওয়ার সময় ১২ বছরের এক নাবালিকা শিশু ছিল। বর্তমানে তার বয়স ১৬ বছর। সে ১০ বছর বয়স থেকে গুলশানের বিভিন্ন রাস্তায় ফুল ও কাগজের স্টীকার বিক্রি করে বাবা মায়ের অভাব অনটনের সংসারে আর্থিকভাবে সহায়তা করত বলেও জানান র্যাবের এই কর্মকর্তা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন