পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের ১২০তম জন্ম বার্ষিকী আজ (১ জানুয়ারি)। ১৯০৩ সালে এই দিনে নানাবাড়ি ফরিদপুরের তাম্বুলখানা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
মোহাম্মাদ জসীম উদ্দীন মোল্লা তার পূর্ণ নাম হলেও তিনি জসীম উদ্দীন নামেই পরিচিত। তার বাবার বাড়ি ছিল একই জেলার গোবিন্দপুর গ্রামে।
পল্লীকবির জন্মদিন উপলক্ষে রোববার (১ জানুয়ারি) কবির নিজ জেলা ফরিদপুরের অম্বিকাপুরের গোবিন্দপুরে তার কবরে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন জেলা প্রশাসক ও জসীম ফাউন্ডেশনের সভাপতি কামরুল আহসান তালুকদার, পুলিশ সুপার মো. শাহজাহান, জসিম ফাউন্ডেশন, আনছার উচ্চ বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা। পরে কবির বাড়ির আঙ্গিনায় আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোসা. তাসলিমা আলীর সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন, জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান তালুকদার, পুলিশ সুপার মো. শাহজাহান, সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর শাহজাহান, মুক্তিযোদ্ধা আবুল ফয়েজ শাহ নেওয়াজসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল আহসান বলেন, কবির বাড়ির প্রাঙ্গণে মাঠের সংস্কার ও সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি এবং সংলগ্ন কুমার নদের তীর সংরক্ষণের কাজ চলমান থাকায় এবছর যথাসময়ে জসীম পল্লী মেলা শুরু করা যায়নি। আশা করছি শিগগিরই পক্ষকালব্যাপী হলেও এ মেলার আয়োজন করা সম্ভব হবে।
বাংলা কবিতার প্রাণপুরুষ কবি জসীম উদ্দীনের বাবা আনসার উদ্দীন মোল্যা একজন স্কুলশিক্ষক ছিলেন। মায়ের নাম আমিনা খাতুন। জসীম উদ্দীন একজন আধুনিক মানের শক্তিশালী কবি। তবে গ্রাম-বাংলার মাটি ও মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনাকে কেন্দ্র করে দরদি কবিতা, ছড়া, গীতিকবিতা ও উপন্যাসসহ সাহিত্য রচনা করায় তাকে পল্লীকবি বলা হয়।
সাহিত্যবিশারদদের মতে, ‘পল্লীকবি’ উপাধিতে ভূষিত জসীম উদ্দীন আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে লালিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ আধুনিক কবি। ঐতিহ্যবাহী বাংলা কবিতার মূল ধারাটিকে নগরসভায় নিয়ে আসার কৃতিত্ব জসীম উদ্দীনের। তার ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ ও ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ বাংলা ভাষার গীতিময় কবিতার উৎকৃষ্টতম নিদর্শনগুলোর অন্যতম। তার কবিতা বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তার লেখা অসংখ্য পল্লিগীতি এখনো গ্রাম বাংলার মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়। যেমন- ‘আমার হার কালা করলাম রে’, ‘আমায় ভাসাইলি রে’, ‘বন্ধু কাজল ভ্রমরা রে’ ইত্যাদি।
জসীম উদ্দীন প্রথমে ফরিদপুর ওয়েলফেয়ার স্কুল ও পরবর্তীতে ফরিদপুর জেলা স্কুলে (বর্তমানে ফরিদপুর জিলা স্কুল) পড়ালেখা করেন। সেখান থেকে তিনি ১৯২১ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় বিএ এবং এমএ পাস করেন যথাক্রমে ১৯২৯ এবং ১৯৩১ সালে। এমএ পাস করার পর জসীম উদ্দীন ১৯৩৩ সনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. দীনেশচন্দ্র সেনের অধীনে রামতনু লাহিড়ী গবেষণা সহকারী পদে যোগ দেন। এরপর ১৯৩৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। সেখানে ৫ বছর শিক্ষকতার পর ১৯৪৪ সালে তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক সরকার এবং পরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রচার বিভাগে কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬২ সালে অবসর গ্রহণের আগ পর্যন্ত তিনি সেখানে ডেপুটি ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। ।
জসীম উদ্দীন ছিলেন প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার একজন দৃঢ় সমর্থক। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধাও ছিলেন।
পল্লীকবি জসীম উদ্দীন প্রেসিডেন্ট প্রাইড অব পারফরমেন্স পুরস্কার (১৯৫৮), বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদক (১৯৭৬) ও স্বাধীনতা পুরস্কারে (মরণোত্তর, ১৯৭৮) ভূষিত হন। তিনি ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৭৬ সালে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন বাংলা সাহিত্যের এই খ্যাতিমান কবি।
মৃত্যুর পর কবির স্মৃতিকে সংরক্ষণ করতে তার বাড়ির অদূরে অম্বিকাপুরে গণপূর্ত অধিদপ্তরের অধীনে ও বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের অর্থায়নে ১১ কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রায় ৪ একর জমিতে নির্মাণ করা হয়েছে পল্লীকবি জসীম উদ্দীন সংগ্রহশালা। নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হওয়ার প্রায় তিন বছর পর ২০১৭ সালের ২৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে এর উদ্বোধন করেন।
তবে, কবির জন্মবার্ষিকীতে এ বছর এখনো ‘জসীম পল্লীমেলা’ আয়োজনের দিনক্ষণ নির্ধারণ হয়নি। মাঠের সংস্কার কাজ চলায় মেলা আয়োজনে বিলম্ব হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা । নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে অম্বিকাপুরে কবির বাড়ির প্রাঙ্গণে কুমার নদীর তীরে মাসব্যাপী জসীম মেলার আয়োজন শুরু হয়। তবে দীর্ঘবছর চলার পর ২০১৮ সাল থেকে এই মেলা আয়োজনে ছন্দপতন ঘটে।
চার বছর বিরতির পর গত বছর মেলা আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও করোনার কারণে ১ জানুয়ারির পরিবর্তে ১৫ মে থেকে পক্ষকালব্যাপী এ মেলার আয়োজন করা হয়। মেলায় চারু ও কারুপণ্য ছাড়াও আসবাবপত্র ও বিভিন্ন গৃহস্থালী পণ্যের সামাহার ঘটে। নির্মল বিনোদনের জন্য নাগরদোলা, সার্কাস এমনকি প্রথমদিকে আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী যাত্রাও মঞ্চস্থ হতো। তবে পরবর্তীতে অশ্লীলতার কারণে যাত্রাপালা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এছাড়া প্রতিদিন মেলার মাঠ প্রাঙ্গণে জসীম মঞ্চে গান, নাচ, নাটকসহ বিভিন্ন লোকজ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। ফরিদপুর ছাড়াও এ অঞ্চলের মানুষের মাঝে জসীম মেলার বিশেষ আবেদন রয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন