বুধবার, ২২ মে ২০২৪, ০৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৩ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

অভ্যন্তরীণ

ফটিকছড়িতে ফসলি জমিতে ইটভাটা জ্বলছে বনের কাঠ নীরব কর্তৃপক্ষ

| প্রকাশের সময় : ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সৈয়দ জাহেদুল্লাহ কুরাইশী, ফটিকছড়ি (চট্টগ্রাম) থেকে : পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রবেশদ্বার চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি মিনি পর্বত হিসেবেই খ্যাত। এ ফটিকছড়িতে ৫৪টি ইটভাটায় দিনরাত নির্বিঘেœই জ্বলছে সমতল-পাহাড়ী জ্বালানি কাঠ। এতে করে বিরান হচ্ছে সমতল-পাহাড়, ধ্বংস হচ্ছে ধানি জমি, বন্ধ হচ্ছে চাষাবাদ। ফলে মহাবিপর্যয়ের কবলে পড়ছে মিনি পর্বত খ্যাত ফটিকছড়ি। এ যেন দেখেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নির্বিকার। জানা যায়, জনসংখ্যায় দেশের বৃহত্তম জনপদ ফটিকছড়ি উপজেলায় চলতি মৌসুমে ফটিকছড়ি পৌরসভাধীন রাঙ্গামাটিয়া ও নাজিরহাট পৌরসভাধীন মন্দাকীনি-সুয়াবিলে এবং ১২টি ইউনিয়নে সর্বমোট ৫৪টি ইটভাটায় এ বছর ইট পোড়ানো শুরু হয় গত নভেম্বর মাসে। এসব ইটভাটাগুলোয় জ্বালানির প্রধানতম যোগান হচ্ছে সমতল আর পাহাড়ী অঞ্চলের কাঠ। রাতের আঁধারে ‘ফায়ার উড’ প্রথার মাধ্যমে গাছ চোর-ইটভাটা মালিক-বন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে প্রতি রাতে সাপ্লাই দেয়া হয় লাখ লাখ মণ জ্বালানি কাঠ। চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি এবং ফেনী-রামগড় মহাসড়কযোগে ৩টি রেঞ্জ, ১৬টি বনবিট ও ৩টি বনজ দ্রব্য পরীক্ষণ ফাঁড়ির বন কর্মকর্তা গাছ চোর-ইটভাটা মালিক চক্র যোগসাজশে হাটহাজারীর অর্ধশতাধিক এবং ফটিকছড়িতে অবস্থিত ৫৪ ইটভাটায় চাঁদের গাড়িযোগে কাঠ পাচার করেই চলছে দেদার। এছাড়া লক্ষ্মীছড়ি-বর্মাছড়ি-খিরাম থেকে খিরাম বনবিটের সহায়তায় খিরাম রোড হয়ে বিনা বাধায় হাজারো মণ জ্বালানি কাঠবাহী চাঁদের গাড়ি পৌঁছে যায় নানুপুর ও ধর্মপুরে অবস্থিত ইটভাটাগুলোতে। অনুরূপভাবে ফটিকছড়ির পাইন্দং, ভূজপুর ও কাঞ্চননগর ইউপিতে অবস্থিত ইটভাটাগুলোতেও পার্শ্ববর্তী সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে চাঁদের গাড়িযোগে জ্বালানি কাঠ পৌঁছে যায় অনায়াসেই। জানা যায়, ২০১৩ সনের ইট প্রস্তুত ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনের ৪ ধারা মতে লাইসেন্স ব্যতীত ইট প্রস্তুত নিষিদ্ধ, ফটিকছড়িতে একটি ইটভাটাও লাইসেন্সকৃত নয়। ৫ ধারা মতে কৃষিজমি, পাহাড়-টিলা, মজা পুকুর, খাল-বিল, খাঁড়ি-দিঘী, নদ-নদী, হাওর-বাঁওড়, চরাঞ্চল, পতিত জমি থেকে মাটি কেটে ইট তৈরি করা যাবে না। ৬ ধারা মতে জ্বালানি কাঠ ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ এবং ৭ ধারা মতে সালফার, অ্যাশ, মারকারী বা অনুরূপ সম্বলিত কয়লাও জ্বালানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ৮ ধারা মতে আবাসিক, সংরক্ষিত, বাণিজ্যিক, সিটি-পৌর-উপজেলা সদর, সরকারি, ব্যক্তি মালিকানার বন, অভয়ারণ্য, বাগান, জলাভূমি, কৃষিজমি, প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় ইটভাটা স্থাপনে পরিবেশ অধিদপ্তর বা অন্য কোন সংস্থা লাইসেন্স বা ছাড়পত্র দিতেই পারবে না। কিন্তু আইনেই সব লিপিবদ্ধ; বাস্তবে কিছুই মানা হচ্ছে না। মূলত উর্বর জমির মাটি ও পাহাড় কেটে ইট তৈরি, ১২০ ফুটের নিচে চিমনি তৈরি এবং ইট পোড়ানোয় কয়লার স্থলে কাঠ জ্বালানো অপরাধযোগ্য হলেও ফটিকছড়িতে এর কোন তোয়াক্কাই করছে না ইটভাটা মালিকরা। এ ব্যাপারে এক ইটভাটা মালিক জানান, আমরা প্রতি মৌসুমের পূর্বেই ইউএনও-ওসির মাধ্যমে তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করে থাকি। ফলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নীরব থাকেন। পত্র-পত্রিকায় লেখা-লেখির কারণে যদি কোন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অভিযানে আসেন, অবশ্য তার পূর্বেই আমাদের কাছে ম্যাসেজ পাঠানো হয়। ফলে দ্রুত আমরা কাঠগুলো সরিয়ে ফেলি। তিনি আরো জানান, এখন আমরা আগের মতো নেই। ইটভাটায় আমরা জ্বালানি কাঠ রাখি না। আমাদের স্টক রূমে জমায়েত করি এবং সন্ধ্যা হলে জীপ-ট্রাকযোগে কাঠ ইটভাটায় নেয়া হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এসব তথ্য প্রদানকারী ইটভাটা মালিক সহাস্যে আরো বলেন, কোন সাংবাদিক লিখেও আর আমাদের কিছুই করতে পারবে না। কেননা প্রশাসন এবং সাংবাদিকদের ম্যানেজ করার জন্য ইতোমধ্যে ব্রিকফিল্ড সমিতির সভাপতিকে প্রতি ফিল্ড থেকে ৭০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের নীরবতা অবশ্য ইটভাটা মালিকদের বক্তব্যের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। কর্তৃপক্ষের এহেন নির্বিকার দৃষ্টিভঙ্গি এখাকার সচেতন মহল ও কৃষককূলকে হতবাক করে দিয়েছে। ইটভাটাগুলোর কারণে ধানী জমি গর্তে পরিণত হচ্ছে, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে চাষাবাদ, ফলবর্তী গাছে ধরছে না ফল, বনজ গাছ বাদামী রং ধারণ করতে বাধ্য হচ্ছে, গাছ তার বাড়ন্তি হারিয়ে ফেলছে; সেখানে মানুষ প্রতিকার পাবে কোথায়? ইট বানাতে মাটি খেকোরা সড়ক-মহাসড়কের পাশর্^ থেকে ১৫/২০ ফুট গর্ত করে মাটি খুঁড়ে নেয়ায় এখন সড়ক-মহাসড়কগুলোও মারাত্মকভাবে ধসে পড়ছে। সব মিলিয়ে মহাপরিবেশ বিপর্যয়ের কবলে পড়েছে ফটিকছড়ি। কিন্তু দেখার যেন কেউ নেই। যারাই দেখবে; তারাই নাকি ‘ম্যানেজ’ হয়ে আছে!

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন