রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

৩৫ বছরে হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে নিহত ৫৫

চরম নিরাপত্তাহীনতায় গারো পাহাড়ের মানুষ আহত ৭ শতাধিক, মারা পড়েছে ৩২টি হাতি

ঝিনাইগাতী (শেরপুর) উপজেলা সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ১২ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

ভারত সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ীর মানুষের বন্যহাতি এখন জীবন-মরণ সমস্যা। একদিকে হাতির আক্রমণ ও মানুষ মৃত্যুর আহাজারি, অপরদিকে নেই জানমালের কোনো নিরাপত্তা। ফলে দিশেহারা হয়ে পড়েছে গারো পাহাড়ের মানুষ।

গত ৬ জানুয়ারী শুক্রবারও নালিতাবাড়ী গারো পাহাড়ের দাওধারা কাটাবারি আ. কারিম মেম্বারের ছেলে শফিক মিয়া (২৫) বন্য হাতির আক্রমণে মারা গেছে। এ নিয়ে ৩৫ বছরে সরকারি হিসাবেই হাতির পায়ে পৃষ্টে মারা গেছে ৫৫ জন। আহত ৭ শতাধিক। হাতি মারা পড়েছে ৩২টি। তবে সেরকারী হিসেবে মৃতের সংখ্যা ও ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি বলে জানান পাহাড়ি অঞ্চলের লোকজন।

যতই দিন যাচ্ছে ততই বাড়ছে মানুষের মৃত্যুর মিছিল। ফলে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে গোটা গারো পাহাড়ে। জীবন বাঁচাতে কেউ এগিয়ে না আসায় দিশেহারা হয়ে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে হাজার হাজার পাহাড়ী হতদরিদ্র মানুষ। অপরদিকে মানুষ ও হাতি রক্ষায় দায়সারা গোছের সব ব্যবস্থাও ভেস্তে গেছে।

শেরপুর বন বিভাগের তথ্যানুযায়ী, ১৯৯৫ সাল থেকে হাতির আক্রমণে গত শুক্রবার ১ জনের মৃত্যু যোগ হয়ে ৫৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ৭ শতাধিক। হাতি মারা পড়েছে ৩২টি। প্রসঙ্গত. ২০১৪ সালের পর থেকে মানুষ-হাতি যুদ্ধে দু’পক্ষেরই মৃত্যুর মিছিল বড় হচ্ছে ক্রমাগতভাবে। ক’দিন আগেও নালিতাবাড়ীতে একজন ও ৫ নভেম্বর ঝিনাইগাতীতে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। গত ৪ নভেম্বর রাতেও ঝিনাইগাতী গারো পাহাড়ের ১টি বাড়ী ভাঙচুর করেছে হাতি। বিগত ৮ বছরেই হাতির আক্রমণে মারা গেছে ২৯ জন। হাতি মারা গেছে ২৮টি। তিন উপজেলার ২ হাজার একর জমির ফসল, ঘরবাড়ি, গাছপালাসহ কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট করছে ফি-বছর।
স্থানীয়দের দাবি মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি সরকারি হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি। বন বিভাগ জানায়, হাতির সংখ্যা শতাধিক। পাহাড়িদের মতে দুই শতাধিক। সীমান্তবর্তী ৮ হাজার ৩৭৬ একর বনভূমিজুড়ে হাতির আবাসস্থল। ১৯৯৫ সালে ২০ থেকে ২৫টি হাতি ভারতের মেঘালয় রাজ্য থেকে এ গারো পাহাড়ে আসে। কাঁটাতারের বেড়া ও (বিএসএফ)’র বাধার ফলে আবাসস্থল ভারতে ফিরতে পারেনি হাতির পাল। ধান ও কাঁঠালের মৌসুম ছাড়াও খাদ্যের সন্ধানে প্রায়শই লোকালয়ে নেমে এসে চালায় অস্বাভাবিক তাণ্ডব। কয়েক পালে বিভক্ত হয়ে ঝিনাইগাতী শ্রীবরদী, নালিতাবাড়ী থেকে শুরু করে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ৬০ কিলোমিটার সীমান্তজুড়ে তাণ্ডব চালিয়ে চষে বেড়ায়। ঘরের মাচার ধান, ক্ষেতের ফসল ও বাড়িঘর ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। জান-মাল বাড়ি-ঘর ও ফসল রক্ষায় পাহাড়ী লোকজন জীবন বাজি রেখে মশাল জ্বালিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে হই-হুল্লোড় করে হাতি তাড়ানোর চেষ্টা করেন। ঝিনাইগাতীর নওকুচি গ্রামের শ্রী ধীরেন্দ্র কোঁচ, জাগেন্দ্র কোঁচ ও যুগল কিশোর কোঁচ জানান, হাতি দুই-তিন পালে বিভক্ত হয়ে খাবারের সন্ধানে গোটা পাহাড় চষে বেড়ায় ও নির্মম তাণ্ডব চালায় লোকালয়ে। তাড়াতে গেলেই ঘটে দুর্ঘটনা-মহাদুর্ঘটনা। এ দিকে সরকার ২০১৪ সালে হাতি তাড়াতে সীমান্তে ১৩ কিলোমিটার সৌরবিদ্যুৎ সংযোগে বেড়া (বায়োলজিক্যাল ফেন্সিং) প্রকল্প গ্রহণ করে বন বিভাগ। ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলায় হাতির বিচরণক্ষেত্রে বেড়া ও নির্মাণ করে। ২০১৫ সালে ঝিনাইগাতীর তাওয়াকুচা ও কর্নঝুড়ায় ১০০ হেক্টর বনভূমিতে হাতি খাদ্যের বাগান করে। তাওয়াকুচা, ছোট গজনী, বড় গজনী, হালচাটি ও মায়াঘাসিতে ১৩ কিলোমিটারজুড়ে লেবু ও বেত বাগান করে। হাতি পর্যবেক্ষণে সীমান্তে ১৬টি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার নির্মাণ করে। পাহাড়ি গ্রামে চার্জার লাইট, টর্চলাইট ও জেনারেটর বিতরণ করে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে। অপরিকল্পিতভাবে এসব পরিকল্পনা গ্রহণ করে বন বিভাগের বাণিজ্য হলেও সব পরিকল্পনাই ভেস্তে যায়। পাহাড়ীরা বলেন, হাতির আক্রমণে মানুষ মরলে ৩ লাখ, আহত হলে ১ লাখ, ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হলে ৫০ হাজার টাকা অনুদান দেয় বন বিভাগ। এ টাকা একেবারেই কম।

অথচ বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে হাতি হত্যায় সর্বোচ্চ ৭ বছরের কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের আইন রয়েছে। পুনরাবৃত্তিতে সর্বোচ্চ ১২ বছর কারাদণ্ড ও ১৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। এই গত বছর ডিসেম্বরে শ্রীবরদী গারো পাহাড়ে সবজিবাগানে সংযোগের বৈদ্যুতিক জিআই তারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠে ১ হাতি মারা যায়। বন বিভাগ আদালতে মামলা করে। হাতি মৃত্যুতে এটাই অবশ্য প্রথম মামলা। এ প্রসঙ্গে বন বিভাগের ময়মনসিংহ, জামালপুর ও শেরপুরের দায়িত্বের সহকারী বন কর্মকর্তা আবু ইউসুফ বলেন, গত বছর থেকে এ পর্যন্ত ৪ হাতির মৃত্যু হয়েছে। একটি মামলা হয়েছে। বাকি ৩ হাতি মৃত্যুর আলামত পরীক্ষায় পাঠানো হয়েছে। হাতি মৃত্যুতে থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। ময়মনসিংহ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ কে এম রুহুল আমিন বলেন, হাতি রক্ষায় ও সমতলে আসতে বাধা দেওয়ায় বন বিভাগ বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। সীমান্তবর্তী মানুষের সচেতনতায় প্রচারণা চলছে। হাতি বনে থাকবে, সেই বনে মানুষ বসতি গড়ে হাতিকে প্রতিপক্ষ বানিয়েছে।

জানতে চাইলে ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ফারুক আল মাসুদ ইনকিলাবকে বলেন, সমস্যাটি দীর্ঘদিনের। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Harunur Rashid ১২ জানুয়ারি, ২০২৩, ৫:১০ এএম says : 0
Human shouldn't be there at the first place. Humans are very cruel toward animals in general.
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন