ছাত্রী হলের প্রভোস্টের পদত্যাগ দাবি আন্দোলনে নিজ ক্যাম্পাসেই গত বছরের ১৬ জানুয়ারি পুলিশি হামলা শিকার হয়েছিলেন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সেদিন রাত থেকেই প্রভোস্ট পদত্যাগের দাবির সুর পাল্টে ‘সৌরাচারী’ উপাধি দিয়ে ভাইস চ্যান্সেলরের পদত্যাগের আন্দোলন গড়ে তুলে আমরণ অনশনে বসেন তারা। অনশন ভেঙ্গে আলোচনার শর্তে একাধিকবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ ও শিক্ষামন্ত্রীর প্রস্তাব ফিরিয়ে সবশেষে প্রফেসর ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল দম্পতির আশ্বাসে স্থগিত করা হয় আন্দোলন। এর পর ১বছর পেরিয়ে গেলেও ভিসি প্রফেসর ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বহাল রয়েছেন স্বপদে।
বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রভোস্ট বডির অসদাচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে আবাসিক ছাত্রীদের আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এবং ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালকের উপস্থিতিতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হামলার পর ছাত্রীদের আন্দোলন সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে রূপ নেয়। পরদিন আন্দোলনকারীদের দ্বারা ভিসি অবরোদ্ধ হলে সেখানে পুলিশের ক্রাইসিস রেসপন্স টিমের স্পেশাল ফোর্স আন্দোলনকারীদের ওপর লাঠিচার্জ, ককটেল, টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এতে প্রায় অর্ধশতাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থী আহত হয়। সেদিন রাত থেকে প্রভোস্টের পদত্যাগ দাবির আন্দোলন থেকে ভিসি বিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠে। ভিসির পদত্যাগ না হওয়া পর্যন্ত আমরণ অনশন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে ১৯ জানুয়ারি থেকে অনশন পালন করেন ২৮শিক্ষার্থী। এরই মাঝে সরকারের প্রতিনিধি রাজনীতিবিদ ও শিক্ষামন্ত্রীর সাথে ভার্চুয়াল মিটিং কোনো কিছুতেই অনশন ভেঙে আলোচনায় রাজি হন নি তারা। তবে সরকারের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ‘ভিসিকে সরিয়ে নেয়া হবে’ এমন আশ্বাসের বাহক হিসেবে সাবেক প্রফেসর ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও ইয়াসমিন হক দম্পতি ২৬ জানুয়ারি ২৮ শিক্ষার্থীর ১৬৩ ঘন্টার অনশন ভাঙান। পরবর্তীতে ১১ ফেব্রুয়ারি শিক্ষামন্ত্রীর আশ্বাসে আন্দোলন থেকে সরে আসেন তারা।
প্রফেসর ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও শিক্ষামন্ত্রীর আশ্বাসের পর সাময়িক সময়ের মধ্যে শিক্ষামন্ত্রীর নিকট উত্থাপিত ‘প্রক্টর ও ছাত্র উপদেষ্টা অপসারণের দাবি’ মানা হলেও এখনো পুলিশি হামলার ঘটনায় শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা অজ্ঞাতনামা মামলা প্রত্যাহার করা হয়নি। এছাড়া পুলিশি হামলায় ৭০ এর অধিক স্প্লিন্টারবিদ্ধ হয়ে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন তৎকালীন ক্যাফেটেরিয়ার দায়িত্বে থাকা সজল কুন্ডু। প্রথমে আন্দোলনের সাথে তার কোনো সম্পর্ক না থাকলেও আহত হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের দাবির সাথে একাত্মতা পোষণ করায় তার কাছ থেকে ক্যাফেটেরিয়া ছিনিয়ে নেয় কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীতে আন্দোলনকারীদের দাবির প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে ঢাকায় উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিতের পর চিকিৎসা বাবদ আনুষঙ্গিক খরচ বিশ্ববিদ্যালয়ের বহনের কথা থাকলেও তার কোনো খোঁজ রাখেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন; বরং এর পর থেকে তার চিকিৎসা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বলে সজল এবং আন্দোলনের মুখোপাত্র রাজ জানান। পরে ক্যাফেটেরিয়া ফিরে পেতে অস্থিতিশীল শারীরিক অবস্থা নিয়ে সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান সজল। এর কিছুদিন পর আন্দোলনে আর্থিক সহায়তা প্রদানে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার করা হয়। তবে অজ্ঞাতনামা মামলা প্রত্যাহার না হওয়ায় নিজেই সে মামলায় ফেঁসে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সজল। এছাড়া গত ১ বছরে এক আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীকে আজীবন বহিষ্কারের সুপারিশ জানানো এবং এক বিএনসিসির ক্যাডেটের ক্যাডেটশিপ কেড়ে নেয়াসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আন্দোলনকারীদের একাডেমিক ও প্রশাসনিকভাবে হেনস্থা করে আসছে বলে জানা যায়।
ভিসি বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম মুখপাত্র মোহাইমিনুল বাশার রাজসহ আরও অনেকেই জানান ভিসির পদত্যাগের বিষয়ে যখনই জাফর ইকবালের সাথে যোগাযোগ করা হয় তিনি বলেন, ‘‘আমি যখনই কথা বলি ওরা (উর্ধ্বতন কর্মকর্তা) বলে যে ওরা কাজ করছে (পদত্যাগের বিষয়ে), হয়ে যাবে। আমি দেখি তারপরও ওরা আবার একই কথা বলে।’’
রাজ বলেন, “ অনশন ভাঙ্গার পর ২৭ জানুয়ারি আমরা জাফর স্যারের সিলেটের বাসায় বসি। সেখানে ইয়াসমিন ম্যাম ছিলেন, একটি গোয়েন্দা সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ছিলেন। সেখানে আমরা কয়েকজন ভিসিকে কিভাবে সরানো হবে এ বিষয়ে খুঁটিনাটি সবকিছু জিজ্ঞাসা করছিলাম। তখন আমাদের সামনে বসেই জাফর স্যার শিক্ষামন্ত্রীর সাথে ফোনে কথা বলেন। শিক্ষামন্ত্রী তখন এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারছিলেন না। তখন গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা স্যারের কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীকে বলেন, “তাকে (ভিসিকে) কী প্রক্রিয়ায় সরানো হবে সে ব্যাপারে আমাদের আলোচনা হয়েছে।” তখন তিনি ( গোয়েন্দা কর্মকর্তা) গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে সরানোর উদাহরণ দেন এবং আমাদের এভাবে বোঝান যে, বিষয়টাকে একটা উইন উইন সিচুয়েশনে রাখতে হবে সরকারের জন্য। সরকার চায় না এখনই ভিসিকে সরাতে। উনি বললেন, “আমরা বুঝতে পেরেছি যে তোমাদের আন্দোলন যৌক্তিক। সেহেতু একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাকে (ভিসিকে) আমরা সরাবো। ৩-৪ মাস লাগবে।” এছাড়া রাজ জানান, “শিক্ষার্থীরা যেন ভিসির পদত্যাগের ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে ওঠে, সেজন্য ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা শিক্ষামন্ত্রীকে সংবাদ সম্মেলনে সেভাবে কথা বলার পরামর্শ দেন। এরপর থেকে প্রতিনিয়ত ‘পরের মাসে হয়ে যাবে, তার পরের মাসে হয়ে যাবে’ আশ্বস্থ করা হলেও এখন পর্যন্ত তাঁকে (ভিসি) সরানো হয়নি।”
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের হয়রানির ও হেনস্থার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালক প্রফেসর আমিনা পারভীনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “কোনো ছাত্র এরকম কোনো বিষয় আমাকে অবগত করেনি, তাই এ বিষয়ে আমার মন্তব্য করার কিছু নেই। আন্দোলনের পর প্রথম দিকে কিছু অস্বাভাবিকতা ছিল। কিন্তু এখন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যকার সম্পর্ক পুরোপুরি স্বাভাবিক আছে।”
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন