অন্যের লেখা চুরি, ভুল তথ্য, ইচ্ছকৃতভাবে ইতিহাস বিকৃতি, মুসলমানদের ইতিহাস-ঐতিহ্য বাদ দিয়ে হিন্দুত্ববাদকে অধিক গুরুত্ব দেয়া, বিতর্কিত তত্ত¡, ইসলামবিরোধী ছবি, লেখা দিয়েই প্রকাশ করা হয়েছে নতুন বই। দেশের আলেম-ওলামাদের আপত্তি, দাবি-দাওয়া উপেক্ষা করে এ বছর থেকে চালু হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম বিতর্কিত ছবি ও লেখা, ভুল তথ্য পৌঁছে দেয়া হয়েছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে। ফলে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হওয়ার পর থেকেই সারাদেশে চলছে তুমুল বিতর্ক। একে একে চোখে পড়ছে ভুল, বেরিয়ে আসছে লেখা চুরির ঘটনা, অসঙ্গতি, নীতি-নৈতিকতাহীন ও শিশুদের ইসলামবিরোধী কৃষ্টি-কালচার শেখানোর অপকৌশল। ফলে ক্ষোভে ফুঁসছেন দেশের আলেম-ওলামা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা। অথচ অন্যের লেখা চুরি করে বই লেখে তা শুধু স্বীকার করেই দায় সারছেন জাফর ইকবালরা। কোটি কোটি টাকা খরচ করে বিতর্কিত এসব বই ছাপিয়ে এখন শিক্ষামন্ত্রীসহ এনসিটিবির কর্তারা বলছেন আগামী বছর সংশোধন করা হবে। অনেকের প্রশ্ন তাহলে এত দীর্ঘ সময় নিয়ে এই কারিকুলাম নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অর্থ ব্যয় করে তাহলে কি করল শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবি? আর বছরজুড়ে যে ভুল ও বিতর্কিত বইয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা হবে তার দায় কে নেবে? শিক্ষার্থীদের ক্ষতির জন্যই বা দায়ী হবে কারা? শিক্ষাবিদরা বলছেন, মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবির শীর্ষ ব্যক্তিরা অযোগ্যদের দায়িত্ব দিয়ে শিক্ষা খাতকে শোচনীয় অবস্থায় নিয়ে গেছেন।
পাঠ্যবইয়ে ভুল তথ্য ও ভুল ইতিহাস লেখার বিষয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. কায়কোবাদ জানান, কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আমরা ভুল শিখাব এটা ভাবতেই পারি না। এই ভুল তথ্যের জন্য পাÐুলিপি লেখকদের কেউই দায় এড়াতে পারবেন না। আর এতে প্রমাণ হয় আমরা যোগ্য লোককে সঠিক দায়িত্ব দিতে পারছি না। যার কারণেই শিক্ষা সেক্টরের আজ এই অবস্থা। আগামীতে যোগ্য লোকদের দিয়ে পাঠ্যবইয়ের পাÐুলিপি দেখার দায়িত্ব দেয়ারও পরামর্শ দেন তিনি।
নতুন কারিকুলামে মাদরাসার ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বইগুলো প্রকাশের আগেই বিতর্কিত লেখা, ছবি বাদ দেয়ার দাবি জানিয়ে আসছিলেন দেশের আলেম-ওলামা ও মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এজন্য সারাদেশে স্মারকলিপি প্রদান, মানববন্ধন, সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছেন তারা। তাদের এসময় আশ্বস্তও করা হয়। কিন্তু তাদের সেই দাবির কোনো তোয়াক্কা না করেই পাঠ্যপুস্তকে ডারউইনের বিতর্কিত মতবাদ, হিন্দুত্ববাদ, হাজার হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী, নগ্ন ও অশ্লীল ছবি যুক্ত করা এবং বাংলাদেশের কৃষ্টিকালচার বিরোধী বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বিপদগামী করার চেষ্টা করছে।
সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হচ্ছে ষষ্ঠ শ্রেণির কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ডারউইনের তত্ত¡ শেখানো নিয়ে। ইসলামবিরোধী এই তত্ত¡ ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলনী বইয়ের ১১৪ ও ১১৫ পৃষ্ঠায় ছবির মাধ্যমে দেখানো হয়েছে মানুষ আগে বানর ছিল, আর সেখান থেকেই কালের বিবর্তনে ধাপে ধাপে মানুষে রূপান্তরিত হয়েছে। বইয়ের ১১৪ নং পৃষ্ঠায় শিরোনাম দেয়া হয়েছে ‘খুঁজে দেখি মানুষের বিবর্তনের ইতিহাস’ ঠিক তার পরের পৃষ্ঠায় অর্থাৎ ১১৫ পৃষ্ঠায় ‘বিভিন্ন সময়ের মানুষ’ শিরোনাম দিয়ে চারটি ছবির মাধ্যমে দেখানো হয়েছে মানুষ আগে মূলত বানর ছিল। আর তার পরেই কয়েকটি ধাপে বানর থেকেই মানুষের আকৃতি রূপান্তরিত হয়েছে।
ষষ্ঠ শ্রেণির বইয়ে ডারউইনের তত্ত¡ নিয়ে যে অধ্যায় লেখা হয়েছে সেখানে দেখানো হয়েছে বানর থেকেই মানুষের জন্ম। এই তত্তে¡র কোনো ইসলামিক ব্যাখ্যা বা সত্যতা নেই বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অভিভাবকরা। তারা বলেন, ইসলাম প্রধান দেশে এমন একটি বিতর্কিত বিষয়ে পাঠ্যবইয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে এটা মেনে নেয়ার মতো নয়। বিক্ষুব্ধ অভিভাবকরা দাবি করেন আগামী শিক্ষাবর্ষ নয় বরং চলতি বছরেই অবিলম্বে এই বিতর্কিত বিষয় পাঠ্য বই থেকে বাতিল করতে হবে।
পাঠ্য বইগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মাদরসার জন্য ছাপানো বইগুলোতে এদেশের মুসলমানদের তাহজীব-তামাদ্দুন, কৃষ্টি-কালচার বিশেষ করে মাদরাসা শিক্ষার উপযোগী নয়। মাদরাসার সাথে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৬ষ্ঠ শ্রেণির বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, গণিত, শিল্প সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও ধর্ম শিক্ষা এ নয়টি বিষয়ের কোথাও কোরআন সুন্নাহ, মুসলিম মনীষী, বিজ্ঞানী, গবেষকদের কোনো বাণী বা জীবনী থেকে কিছুই নেয়া হয়নি। বরং ৯১ শতাংশ মুসলমানের দেশে বিবর্তনবাদ, প্রাচীন সভ্যতার নামে মূর্তি, হিজাববিহীন মেয়েদের ছবি, গান-বাজনা, হারমোনিয়াম, তবলা, গিটার, খেলাধুলা, মোবাইল ব্যবহারের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। বিজ্ঞানের নামে নগ্ন অশ্লীল ছবি, কুকুরের ছবি, সভ্যতার নামে উলঙ্গ ও অর্ধউলঙ্গ মূর্তির ছবি ব্যাপবভাবে স্থান পেয়েছে। দেড় হাজার বছরের মুসলিম ঐতিহ্য, নীতি-নৈতিকতা, কবি সাহিত্যিকগণের অবদানের কোনো বিষয় নেই বললেই চলে। বাংলাদেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির আলোচনা খুবই কম। বইগুলোতে তিনশতাধিক মেয়ের ছবি পর্দাবিহীনভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে ডারউইনের বিবর্তনবাদ (মানুষ বানর থেকে সৃষ্টি), পৃথিবী সৃষ্টির ইতিহাস বর্ণনায় এমনসব বিষয় উপস্থাপিত হয়েছে যা কোরআন সুন্নাহ ও মুসলামানদের আকীদা বিশ্বাসের পরিপন্থি। প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস বর্ণনায় দেব-দেবীর নগ্ন ও অর্ধনগ্ন ছবি, মৃত্যু ও পরকালের দেবতা ‘আনুবিষ’, সূর্য দেবতা ‘রা’, স্বর্গীয় মাতা ‘আইসিস’, কৃষি দেবতা ‘ওসাইরিস’, যুদ্ধ দেবতা ইত্যাদি দেবতার বর্ণনা দিয়ে পৌত্তলিকতা শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেয়েদের উলঙ্গ ছবি, হিন্দুদের মন্দিরের ছবি দেয়া হয়েছে।
ইংরেজি বইয়ে ১২টি কুকুর ও ১৪টি নেকড়ে বাঘের ছবি দেয়া হয়েছে। যা ইউরোপীয় কুকুর সংস্কৃতিরই অংশ বিশেষ। সাহিত্য হিসেবে চরিত্র সৃষ্টি করার কোন ব্যবস্থা তাতে নেই। স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ে কিশোর-কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তন অত্যন্ত ন্যক্কারজনকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
জীবন ও জীবিকা গান শোনা, নাচ, বাঁশি, হারমোনিয়াম, তবলা, গিটার ইত্যাদি যন্ত্র ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের পাশ্চাত্য ও ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেয়েদের ফুটবল খেলা, টিভি দেখা, অনলাইনে কার্টুন দেখার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। ডিজিটাল প্রযুক্তি: অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলে প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি, খেলাধুলার প্রতি প্রবণতা সৃষ্টির ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভ্রমণের জন্য দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দিরে যেতে উৎসাহ দেয়া হয়েছে।
বাংলা বইয়ে গানের প্রতি আসক্তি, কাল্পনিক বিষয়ের কবিতা, ভ‚তের ভয়, ঝগড়া শেখানো এবং উদাহরণ হিসেবে গীতাঞ্জলির নাম উল্লেখ না করে কোরআন বা মুসলিম কোনো নাম ব্যবহার করা যেত। সাতভাই চম্পা গল্পে হিংসা ও চারিত্রিক অধঃপতনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ক্রিকেট খেলা ও টেলিভিশনের সামনে বসার আগ্রহ সৃষ্টির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
শিল্প ও সংস্কৃতি বইয়ে সংগীত, গান, নৃত্য, মাটির পুতুল, সার্কাস ও মঙ্গল শোভা যাত্রার প্রতি উৎসাহ সৃষ্টি করা হচ্ছে। ৯টি বইয়ে যে সব মানুষের নাম ব্যবহৃত হয়েছে একটি মুসলিম দেশে সত্যিই আপত্তিকর। যেমন: অনিকা, মিনা, লিটল র্যাড, প্লাবন, রতন, মেধা, দীপক, স্কট, রুপা, নন্দিনী, এস্তি, মিসেল, মিতা, রন, শেলী, নিনা, জয়া, সুবর্ণা, রায়, মনিকা চাকমা, রিনা গোমেজ, রাতুল, রমা, রবিন, শিশির, ডেবিড, প্রিয়াঙ্কা, অরবিন্দু চাকমা, মন্দিরা, শিশু, মিলি, সুনীল, মিনু চিনুক ইত্যাদি।
ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে মুসলিম সভ্যতার ইতিহাস ও সামাজিক মূল্যবোধ এবং বাংলাদেশের আত্মসামাজিক অবস্থা উপস্থাপন না করে মেসোপটেমিয় সভ্যতা, মিসরীয় সভ্যতা, সুমেরীয় সভ্যতা, গ্রিক সভ্যতা, রোমান সভ্যতা ও হরপপা সভ্যতা ইত্যাদি বিষয় যা অনার্স বা ডিগ্রি শ্রেণিতে পড়ানো হয়। ৬ষ্ঠ শ্রেণির কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।
এমন পাঠ্য বই নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলছে নানা সমালোচনা। ইফতেখার সিফাত নামে একজন লিখেছেন, এবারের পাঠ্যপুস্তকে ইসলামী যেকোনো নিদর্শনকেই মুছে ফেলা হয়েছে। এমনকি আলিয়া মাদরাসার পাঠ্যপুস্তক থেকে পর্যন্ত টুপি, পায়জামা, হিজাব ও সালামকে বিদায় জানানো হয়েছে। ইসলামবিদ্বেষ, পৌত্তলিকতা আর পশ্চিমা সংস্কৃতির সুস্পষ্ট উপস্থিতি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এসব বইয়ে। শেষবার যখন নতুন পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করা হয়েছিল, সেখানে ইসলামের বিভিন্ন নিদর্শন ও সংলাপযুক্ত করা হয়েছিল। এ সংস্করণ বিতরণের পর থেকেই কলকাতাকেন্দ্রিক বাম ও ব্রা²ণ্যবাদী কথিত বুদ্ধিজীবীদের আস্ফালন শুরু হয়ে যায়। তারা এর তীব্র সমালোচনা করে এবং পরিবর্তনের জোর দাবি তুলতে থাকে। তাদের সেই আস্ফালনের প্রভাবেই নতুন পাঠ্যসূচিতে ভয়াবহ পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। কিছুটা অনুমেয় ছিল যে, তারা পরিবর্তনের দাবি তুলে কিসব পাঠ সংযোজন করতে যাচ্ছে। কিন্তু সেই অনুমানকে ডিঙ্গিয়ে তারা আরো বেশি ভয়াবহ পাঠ অন্তর্ভুক্ত করেছে।
তিনি বলেন, এলজিবিটি ও ট্রান্সজেন্ডার মুভমেন্ট বাংলাদেশের সমাজে একটি ট্যাবু ও ঘৃণিত বিষয়। ইসলাম ধর্মেও এগুলো অত্যন্ত নিকৃষ্ট কাজ ও অভিশপ্ত হারাম বিষয়। পাঠ্যপুস্তকে সমকামিতা ও লিঙ্গ পরিবর্তনের ব্যাপারটিকে স্বাভাবিক হিসেবে কিশোরদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। আমাদের লক্ষ লক্ষ সন্তান এই পাঠ্যপুস্তকের অধীনে শিক্ষাগ্রহণ করছে। কিশোরমন হল গড়নের মন। এই সময়ে তাদের মনস্তত্ব ও মানসিকতা গড়ে উঠে, বিকশিত হয়। ঠিক এই সময়টাতে যদি, তাদের পড়ানো হয় পর্দা খারাপ জিনিস, মুসলিমদের শাসনব্যবস্থা বর্বর, সমতার ভিত্তিতে যৌন সম্পর্কে সমস্যা নেই, সমকামিতা স্বাভাবিক যৌনতা, লিঙ্গ পরিবর্তন করাও স্বাভাবিক প্রক্রিয়াÑ এসব পাঠ যদি তাদের কিশোর মনে পুশ করা হতে থাকে, তাহলে আমাদের আগামী প্রজন্মটা কেমন হতে যাচ্ছে?
আপনি ভাবছেন, তারা শুধু ধর্মীয় বোধ, বিশ্বাস ও জীবনাচার থেকে ছিটকে পড়বে। হ্যাঁ এটা অবশ্যই এই শিক্ষাক্রমের সবচেয়ে বড় সমস্যা। কিন্তু সমস্যা এখানেই সীমাবদ্ধ নয়, এটা আমাদের প্রজন্মের ভিতর যেই যৌন উচ্ছৃঙ্খলতা আর যৌন বিকৃতির প্রসার ঘটাবে, সেটা পুরো সামাজিক কাঠামোকে আঘাত করবে। যৌনতাকেন্দ্রিক উচ্ছৃঙ্খলতা আর বিকৃতির নেতিবাচক প্রভাব পড়বে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর, আমাদের সামাজিক নিরাপত্তার ওপর, আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক ও দাম্পত্য সম্পর্কের ওপর।
মুসলিমদের ইতিহাস বিকৃতি: নিম্ন মাধ্যমিকের ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণির ইতিহাস ও সমাজ বইয়ে বলা হয়েছে, বখতিয়ার খলজি অসংখ্য বিহার ও লাইব্রেরি ধ্বংস করেছেন। ষষ্ঠ শ্রেণির সামাজিক বিজ্ঞান ও সপ্তম শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়, সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তিতুমীর, হাজী শরীয়তুল্লাহ, ফরায়েজী আন্দোলনের ভ‚মিকা, বালাকোট, বেরেলভী, খেলাফত আন্দোলন, ফকির মজনু শাহের ভ‚মিকা বাদ দেয়া হয়েছে। প্রীতিলতা, সূর্যসেন, ক্ষুদিরাম, বাঘা যতিন- তিতুমীর আর দুদু মিয়া থেকে বড় হয়ে গেল। উইলিয়াম হান্টার বলছিল তিতুমীর এর যুদ্ধে ৫ হাজার মানুষ যোগ দিচ্ছিল। সেই একই ঐতিহাসিক বলেছিল, ফরায়েজী আন্দোলনের নেতৃত্বে দুদু মিয়া ছিল এবং তার ৫০ হাজারের বেশি সন্ন্যাসী ছিল। হান্টার এইটাও বলছিল, তার এই কৃষক আন্দোলন এত বড় ছিল যে, হিন্দুরাও এতে যোগ দিচ্ছিল। তিতুমীর এবং দুদু মিয়া দুইজনেই বাঙালি ছিলেন। দুদু মিয়ার নীল চাষিদের পক্ষে আন্দোলন যদি আন্দোলন না হয়, দুনিয়ার কোনো আন্দোলন পাঠ্যপুস্তক এ আসবে? এ ধরনের খÐিত ইতিহাস শুধু মানুষের মধ্যে বিভাজন ছাড়া আর কিছুই তৈরি করবে না। মানুষ আরো বেশি শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারাবে।
এসব বইয়ে মুসলিম শাসকদের উপস্থাপন করা হয় যে, সুলতানি শাসন ব্যবস্থা এদেশে কীভাবে উড়ে এসে জেঁকে বসেছিল, উপমহাদেশের ইতিহাসে সবসময়ে হিন্দু ও বৌদ্ধশাসন থাকলেও বর্ণবাদের শুরু হয় সুলতানি আমলে, ‘অমানবিক দাসপ্রথা’ সুলতানি আমলেই চালু হয়েছিল। সুলতানি আমলে নারীদের অবস্থা ছিল অনেক শোচনীয়। প্রাচীন হিন্দু ও বৌদ্ধ শাসনব্যবস্থার অর্থনৈতিক আমলের বিস্তারিত বর্ণনা থাকলেও সুলতানি আমলের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায় না। পুরো বইয়ের শতাধিক ছবি আছে। আছে কয়েক ডজন মন্দিরের ছবি, অনেক অনেক দেবদেবী, মূর্তি-প্রতিমার ছবি। মসজিদের ছবি আছে তিনটা। অত্যন্ত সুক্ষভাবে সুলতানি আমলের নামে মুসলিম বিদ্বেষ ঢোকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। হিন্দু ও বৌদ্ধ সভ্যতা ও ইতিহাসের প্রতি মুগ্ধতা সৃষ্টির চেষ্টা করানো হচ্ছে।
মারুফ মল্লিক নামে একজন লিখেছেন, আমি নিজে ইতিহাসের শিক্ষার্থী ছিলাম। কোনো বই বা আর্টিকেলে কখনো পড়িনি বখতিয়ার খলজি অসংখ্য বিহার ও লাইব্রেরি ধ্বংস করেছেন। ভারতীয় অধ্যাপক যেমন আরসি মজুমদার, রাখাল দাস বন্দোপাধ্যায়, প্রভাতাংশু মাইতি ও কিরণচন্দ্র চৌধুরীর বইয়ে বখতিয়ার খলজি কর্তৃক অসংখ্য বিহার ও লাইব্রেরি ধ্বংসের কোনো উল্লেখ নেই। নালন্দা বিহার ধ্বংসের জন্য স¤প্রতি একটি শ্রেণি বখতিয়ার খলজিকে দায়ী করেন। কিন্তু বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের মতে নালন্দা বিহার ধ্বংস করেছেন সেন বংশের প্রতিষ্ঠাতা হেমন্ত সেনের ছেলে বিজয় সেন। এদের বসতি ছিল রাজশাহীর গোদাগাড়ী এলাকায়। লিপিতাত্তি¡ক রাধাকৃষ্ণ চৌধুরী গোদাগাড়ির দেও পাড়াতে প্রাপ্ত স্তম্ভ লিপি বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত করেছেন, নালন্দা ধ্বংস করেছেন বিজয় সেন। রাধাকৃঞ্চ চেীধুরী নালন্দায় ১৯৬০-৭২ সাল পর্যন্ত পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতœতাত্তি¡ক খননের উপর ভিত্তি করে উল্লেখিত প্রবন্ধে পরিষ্কারভাবে দেখিয়েছেন যে বখতিয়ার খলজী›র বাংলা অভিযানের সাথে নালন্দার ধ্বংসের কোনো সম্পর্কই ছিলো না। বখতিয়ার খলজি সম্পর্কে যে ঐতিহাসিক বিবরণ পাঠ্য বইয়ে দেওয়া হয়েছে তা অনৈতিহাসিক, অসত্য ও বিভ্রান্তিকর। লেখকরা বইয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রও উল্লেখ করেননি। অনেকটা মনগড়া, নিজস্ব মতামত দিয়ে পাঠ্যপুস্তক রচনা করা হয়েছে। যা অনভিপ্রেত বলেই হচ্ছে। বিহার ও লাইব্রেরি ধ্বংস করা নিয়ে যদি বখতিয়ার খলজির ভূমিকা উল্লেখ করতেই হয় তাহলে এই অঞ্চলে বৌদ্ধদের সমুলে বিনাশ করতে বহিরাগত সেন রাজবংশের ভূমিকারও উল্লেখ করা প্রয়োজন ছিল। সেনদের নির্বিচারে বোধিবৃক্ষ নির্ধনের কথাও পাঠ্যবইয়ে লেখা দরকার ছিল।
এছাড়াও বইগুলোতে জমিদারী প্রথার প্রকারন্তরে গুনগানই করা হয়েছে। কৃষকের ভ‚মির মালিকানা হারানো ভূসামন্ত প্রথা কীভাবে সুবিধাজনক ছিল তা বোধগম্য হচ্ছে না।
মারুফ মল্লিক আরো বলেন, আমার কাছে মনে হয়েছে একদল অজ্ঞ লোকদিয়ে পাঠ্য পুস্তক রচনা করা হয়েছে। বড় বড় ডিগ্রি থাকলেই বিজ্ঞ হওয়া যায় না। বিজেপির দাবি করা ইতিহাস আর পাঠ্যপুস্তকের ইতিহাসের মধ্যে পার্থক্য থাকে। পাঠ্যপুস্তকের লেখকরা মনে হয় এই পার্থক্যটা ভুলে গেছিলেন। তাই ভারতের বিজেপিপন্থি লেখকদের দাবি করা তথ্য পাঠ্য বইয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছেন।
ষষ্ঠ শ্রেণির ইংরেজি বইয়ে ৪৮ ভুল : ষষ্ঠ শ্রেণির ইংরেজি বইয়ের নানা ভুলক্রুটি খুঁজে বের করেছেন মাসুম হাসান নামের একজন শিক্ষক। তিনি এতে ৪৮টি ভুল পেয়েছেন। এই বইয়ের ১৫ পৃষ্ঠায় ‘লিটল থিংস’ কবিতাটি দেয়া হয়েছে। কিন্তু এতে কবির নাম দেয়া হয়নি। অথচ এই বহুল প্রচলিত কবিতাটি লিখেছেন আমেরিকান কবি জুলিয়া অ্যাবিগেল ফ্লেচার কার্নি। একইভাবে ১০১ পৃষ্ঠায় ‘মাই বুকস’ কবিতাটিতেও কবির নাম নেই। এছাড়া এই শ্রেণির একাধিক বইয়ের অনেক জায়গায় একই শব্দের একেকভাবে লেখা হয়েছে। যেমনÑ কেন/কেনো, পড়/পড়ো, নিচে/নীচে, যে কোন/যেকোন ইত্যাদি। এছাড়া বইটির বিভিন্ন পৃষ্ঠায় বানান, বাক্য গঠন ও গ্রামারের ব্যবহারে অসংখ্য ভুল রয়েছে।
এর আগে সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ের একটি অংশে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এডুকেশনাল সাইট থেকে নিয়ে হুবহু চুরি আর অনুবাদ করে ব্যবহার করার দায় স্বীকার করেন বইটির রচনা ও সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত থাকা প্রফেসর মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও প্রফেসর হাসিনা খান। এছাড়া মাধ্যমিক স্তরের তিনটি বইয়ে ৯টি ভুলের সংশোধন করে এনসিটিবি।
জানতে চাইলে এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, ‘পাঠ্যবইয়ের কোথায় কোথায় ভুলক্রুটি আছে তা খুঁজতে ইতিমধ্যে একটি কমিটি কাজ শুরু করেছে। তাদের কাছ থেকে আগামী মাসেই আমরা একটা প্রাথমিক রিপোর্ট পাব। তারপর সেই সংশোধনের তালিকা স্কুলে স্কুলে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এছাড়া নতুন শিক্ষাক্রমের ব্যাপারে একাধিক কমিটি মার্চ মাসে স্কুলে স্কুলে ঘুরে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মতামত সংগ্রহ করবে। আগামী বছরের বই পরিমার্জনে তাদের মতামতকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হবে।’
এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, পাঠ্যপুস্তকের কোন বিষয়ে দ্বিমত, অস্বস্তি কিংবা আপত্তি থাকলে সেগুলো সংশোধন করা হবে। নতুন শিক্ষাক্রমের অধীনে প্রাথমিকের ১ম শ্রেণী ও মাধ্যমিকের ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণির জন্য পাঠানো বইগুলো পরীক্ষামূলক ছিল। আমরা মাধ্যমিকের ৩৩ হাজার প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষামূলক সংস্করণ বইগুলো দিয়েছি। আমরা প্রতিনিয়ত শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষাবিদদের কাছ থেকে ফিডব্যাক নেব এবং সে অনুযায়ী বছরব্যাপী আমরা এগুলোকে পরিমার্জন পরিশীলন করব। কাজেই এবার ৬ষ্ঠ, ৭ম ও ১ম শ্রেণিতে যে বইগুলো শিক্ষার্থীদের হাতে উঠেছে সেগুলোতে ভুল থাকতে পারে। বিষয়বস্তুর সাথে কারো দ্বিমত, অস্বস্তি কিংবা আপত্তি থাকতে পারে, সেগুলো আমাদের জানাবেন। আগামী বছরগুলোতে সেগুলো সংশোধন করব।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন