আবদুল আউয়াল ঠাকুর : দুনিয়াব্যাপী আজ মানুষের মুক্তির প্রসঙ্গ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। ব্যাপারটি কেবলমাত্র এখনই এমন দাঁড়িয়েছে তা না বলে বরং বলা যায়, অনেক দিন বা অনেক বর্ষ থেকেই এমনটা রয়েছে। সে কারণেই মানুষ ডান থেকে বামে আবার বাম থেকে ডানে ঝুঁকছে। ঠিক কেবলা নির্ধারণ করতে পারছে না। এই না পারার পেছনে চিন্তার দুর্বলতাই প্রধান ভূমিকা পালন করছে। এ সময়কে বলা হয়, আধুনিক যুগ। বিশ্লেষকরা বলে থাকেন, চিন্তা-চেতনা, মেধা-মননের এক উৎকৃষ্ট সময় এখন অতিবাহিত হচ্ছে। এই সময়ের আরো একটা বড় দিক হচ্ছে, মানুষের আবিষ্কার। গত এক শতাব্দীতে মানুষ এত কিছু আবিষ্কার করেছে যে, এখন কার্যত তার আর নতুন করে করার কিছু নেই। বোধকরি সে কারণেই লোহার মরিচার জন্য নোবেল দেয়া হয়েছে। এখনকার অধিকাংশ আবিষ্কারই মূলত সংযোজেন। সেদিক থেকে বলতে গেলে বলতে হবে মানুষের করণীয় এবং ভাবনার জগতে হয়তো সীমাবদ্ধতা বা এক ধরনের ঘূর্ণাবর্ত তৈরি হয়েছে। এর থেকে উত্তরণ অথবা একে মেনে নেয়া- কোনটি সঠিক এ নিয়ে আরো আলোচনা হতে পারে। বোধকরি এ কথা বলা যায়, মানুষের চিন্তার জগতে যে ঘুণপোকা বাসা বেঁধেছে তার বিরূপ প্রভাব-প্রতিক্রিয়া পড়তে শুরু করেছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। মানুষের আবিষ্কার আর চিন্তার সমন্বয়ের মাধ্যমে যে সভ্যতাকে রূপায়ণের চেষ্টা করা হয়েছে এতদিন, মূলত এই প্রক্রিয়া-প্রবণতার মধ্যেই আটকে পড়ে রয়েছে মানুষের মুক্তি। সোজা ভাষায় সভ্যতার উৎকর্ষের সূত্রেই মানুষ বন্দি হয়ে রয়েছে। সেই মুক্তির গানই এখন দুনিয়াজোড়া বিস্তৃত।
আধুনিক যুগের সূচনাকে যদি ইউরোপীয় রেনেসাঁ থেকে শুরু করা যায় তাহলে বলা যাবে, মানুষের মুক্তিই ছিল প্রধান বক্তব্য। সে কারণেই ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিক রুশোর জেনারেল উইলকে যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। সেখানে সাধারণের ইচ্ছা যাদের হাতে সমর্পণের কথা বলা হয়েছে মূলত সেটি বর্তমান গণতান্ত্রিক ধারার মূল সূত্র হিসেবে কাজ করছে। ফরাসি বিল্পবের ডামাডোল এখনো রয়েছে। এ বিপ্লবের সূত্র ধরে যে গণতন্ত্র এসেছে তার মধ্যেই ছিল শোষণের উপাদান। মানুষের আবিষ্কারকে পুঁজি করে ইউরোপে যে শিল্পায়ন হয়েছিল তার খেসারত দিতে হয়েছে সে সময়ের আফ্রিকার স্বাধীন মানুষদের। গণতন্ত্র তথা পুঁজির হুঙ্কার সামলাতে সেদিন ইতিহাসের ভুল পথে মানুষকে দাস বানানো হয়েছিল। এখানে অবশ্যই বলে রাখা দরকার, রাজায় রাজায় যুদ্ধের প্রক্রিয়ায় যে স্বাভাবিক দাস তৈরি হতো তাদের মুক্তিরও স্বাভাবিক একটা নিয়ম ছিল। উচ্চারণে দাস বলা হলেও এরা মূলত মানবসৃষ্ট সভ্যতার তলানী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল। সে বিবেচনায় দেখা যায়, যে গণতন্ত্র বা রেনেসাঁকে মানুষের মুক্তি তথা কল্যাণের বিজয় গাঁথা হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছে সময়ের বিবেচনায় সেটিই মূলত মানুষের গলার কাঁটা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। গণতন্ত্র হচ্ছে ডানপন্থি বিপ্লব। এই ডানপন্থি বিপ্লবের মধ্যেই মানুষ তার মুক্তির খোঁজ করছিল। এরপর পরিস্থিতি অনেক দূর এগিয়েছে। নিজস্ব মেধা-মননে এই কালো মানুষেরাই প্রমাণ করেছে, তারা সাদাবর্ণের অধিকারী তথাকথিত আভিজাত্যের ধবজাধারীদের চেয়ে অনেক উন্নত চিন্ত-চেতনা ও সংস্কৃতির অধিকারী ছিল। সে কারণেই সেখানে নতুন বিপ্লব স্থান করে নিয়েছিল। এই বিদ্রোহ ছিল মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা তথা মুক্তির আন্দোলন। ব্যাপারটি শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, যুক্তরাজ্যেই হয়েছিল তা তো নয়, এটি ছিল ওই সভ্যতার প্রচার-প্রপাগান্ডাকারীদের বিরুদ্ধে এক বিদ্রোহ। যেহেতু শিল্পায়নের অধিক সুবিধা যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রই নিয়েছিল সে কারণে সেখানেই বিষয়টি বড় আকারে দেখা দিয়েছিল। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কোনো উন্নত শিক্ষা বা সংস্কৃতির দ্বারা নয়, বরং মানুষের আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়েই মানুষকে মানুষের অধীন করা হয়েছিল। এ কারণেই দুনিয়াব্যাপী মানুষের মুক্তির যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তার পেছনেও ছিল বুদ্ধি খেলা। আপাত দৃষ্টিতে সে লড়াইয়ের অবসান হলেও এখন পর্যন্ত প্রকৃতপক্ষে সে লড়াইয়ের অবসান হয়েছে বা মানুষে মানুষে বৈষম্য তিরোহিত হয়েছে তা জোর দিয়ে বলা যাবে না। তবে এটা জোর দিয়েই বলা যায় রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায় এ বৈষম্যের অবসান হয়েছে। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্র অনেক যতœ করছে এই বৈষম্য নিরসনের। তা সত্ত্বেও পাশ্চাত্য দুনিয়ায় পরিস্থিতির সার্বিক উন্নতি হয়েছে তা বোধহয় বলা যাবে না। এখনো সেখানে ধর্মের নামে বর্ণের নামে, মানুষের প্রতি মানুষের অবিচার অব্যাহত রয়েছে। যে ফরাসি দেশকে বর্তমান সময়ে মানুষের মুক্তির সূতিকাগার বলে প্রচার ও দাবি করা হয় সেই দেশটিতেই ইসলাম ও ইসলামের অনুসারীদের ওপর নির্বিচারে অন্যায় আচরণ করা হচ্ছে। যার পেছনে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিও রয়েছে। এটা কেন হচ্ছে বা এ ধরনের প্রবণতা মানুষের মুক্তির কতটা অন্তরায় তা নিয়ে কিন্তু তারা ভাবছে না। সে অর্থে এটা বলা যায়, তাদের চিন্তা একটি বিশেষ ধারণা বা কূপম-ূকতায় সীমাবদ্ধ। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে আসার পরও যেহেতু এই অন্ধত্বের অবসান হয়নি তাই বলা যায়, এটাই হয়তো ওই চিন্তার মূল উপাদান ছিল। সে দেশে এখনো সাদা-কালোর লড়াইয়ের চেয়েও মানুষের ধর্ম পালনের অধিকারের লড়াই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। সঙ্গত প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষের মুক্তি কি ধর্মীয় স্বাধীনতার বাইরে নাকি ধর্মপালন স্বাধীনতার অংশ নয় অথবা ব্যাপারটি এরকম কিনা যে ধর্ম পালন না করার স্বাধীনতাই ছিল সেই স্বাধীনতার মূল সূত্র।
রেনেসাঁর সূত্র ধরে সে সময়ের বিশ্ব যে গণতন্ত্র তথা ব্যক্তিস্বাধীনতার সনদ পেয়েছিল তার জের ধরে যে শিল্পায়ন হয়েছিল সেখানেই জন্ম নিয়েছিল বামপন্থি মুক্তির ধারা সমাজতন্ত্র। তাত্ত্বিক ভাষায় পুঁজিবাদের গর্ভেই জন্ম নেয় সমাজতন্ত্র। এখানে মানুষের মুক্তির জন্য মানুষের স্বাভাবিক তথা জৈবিক চাহিদার দিকেই নজর দেয়া হয়েছিল। অন্ন-বস্ত্র-চিকিৎসা-বাসস্থানের নিশ্চয়তার স্লোগান দিয়ে যে নতুন তত্ত্বের জন্ম দেয়া হয়েছিল তার প্রথম প্রয়োগ হয়েছিল সেভিয়েত ইউনিয়নে। দু-দুটি কৃত্রিম বিশ্বযুদ্ধে সেময়ের মানুষ যখন মানসিক ও শারীরিকভাবে ক্লান্ত ঠিক তখনই বিশ্বব্যাপী মুক্তির এই বড়ি গিলিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়েছিল। ব্যাপারটি তখনকার মানুষকে নিঃসন্দেহে আকৃষ্ট করেছে, ব্যাপকভাবে নাড়া দিয়েছে। শিল্পায়নের ধাবমান ঘোড়ার খুরে পিষ্ট এবং বর্ণবাদের নিগড়ে আটকেপড়া বিশ্বের মানুষের কাছে তখন মুক্তির উপায় হিসেবে এই তত্ত্বের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। এর অন্যতম কারণ ছিল, মানুষের বাকরুদ্ধহীন পরিবেশ সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। তখনকার মানুষের হয়তো এটাই প্রধান বিবেচ্য ছিল। শোষণের বিরুদ্ধে অবস্থান। কারণ, মানুষ চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিল কীভাবে কেবলমাত্র শ্রমের কারণে সে বিভাজনের শিকার, যা আজো বিদ্যমান। সম্পদ, বিত্ত-বৈভব মানুষকে কীভাবে শৃঙ্খলিত করে রেখেছে। আবিষ্কারকে কেন্দ্র করে একশ্রেণির মানুষ কীভাবে অন্যদের অধীন করে রেখেছে। মানবিক মূল্যবোধ কীভাবে মার খাচ্ছে সম্পদের কাছে। যে মানুষের জন্য সভ্যতা সেই মানুষের মধ্যে সৃষ্ট বিভাজন সঙ্গত বিবেচনা থেকেই মানুষকে মুক্তিপাগল করে তুলেছিল। সে কারণেই ওই বড়ি মানুষকে ধরে রাখতে পারেনি। তার জন্মগত অধিকার প্রয়োগের বিবেচনায় সে আপন থেকেই বিদ্রোহী হয়ে উঠে। প্রমাণ করে কেবল ভাত-কাপড়ের নিশ্চয়তাই শেষ কথা নয়। মানুষ আরো কিছু চায়। সে স্বাধীনভাবে তার মতও প্রকাশ করতে চায়। এই যে সমন্বয়ের আকাক্সক্ষা এটাও কিন্তু পরবর্তীতে পাশ্চাত্যের গণতন্ত্রে করা হয়েছে। মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক উপাদানের সাথেই তার বাক-স্বাধীনতাকে যুক্ত করে দিয়ে গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা হচ্ছে। তবে গণতন্ত্র যখন সমাজতন্ত্রের মতো রপ্তানি পণ্যে পরিণত হয় বা হয়েছে তখনই এর সংকট ঘনীভূত হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে সে আলোচনাই আজো গণতন্ত্রকে কালিমাযুক্ত করে রেখেছে। আফগানিস্তানে সমাজতন্ত্র রফতানি করতে গিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন যেমনি বিশ্ববিবেকের নিন্দা কুড়িয়েছে ঠিক তেমনি খোদ মার্কিন জনগণই ধিক্কার জানিয়েছে যখন গণতন্ত্র রফতানির নিমিত্তে ইরাক-আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালানো হয়েছে। এখানে অবশ্যই বিবেচ্য হচ্ছে, মস্কো যখন আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালিয়েছে তখন সে দেশের জনগণের পক্ষে তার প্রতিবাদ করা সম্ভব হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সেটি সম্ভব হয়েছে। এমনকি ভোটের মাধ্যমে ঘৃণা প্রকাশেরও সুযোগ তারা নিয়েছে। এর অর্থ অবশ্য কোনো বিবেচনাতেই এটা নয় যে, তারা যা করেছে সেটি সঙ্গত ছিল। অন্যায় যুদ্ধ পরিচালনার জন্য তারা আজ পর্যন্ত ক্ষমা চায়নি। যখন এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, সে সময়ের সরকার প্রধান নিজের ইচ্ছানুযায়ী রিপোর্ট তৈরি করিয়ে নিয়েছিলেন তখনই এটি বিচারযোগ্য হয়েছে। অন্যভাবে বলা যায়, সে সময়ের মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ যখন প্রচার করেছিলেন তাদের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে এবং সে কারণেই তারা বিশ্বজনমত উপেক্ষা করে আগ্রাসনের অধিকার রাখে সে যুক্তিতেই এখন যখন প্রমাণিত হয়েছে এটা ছিল ইচ্ছাকৃত ভুল, তখনই কার্যত যারা এই ইচ্ছাকৃত হত্যার সাথে জড়িত তাদের বিচারের দাবি যৌক্তিক হয়ে দেখা দিয়েছে। এটি গণতান্ত্রিক অধিকারের অংশ। বৈষম্য নিরসনের জন্যই এর বিচার হওয়া প্রয়োজন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সূত্র ধরে মিয়ানমারে নরপশুরা যা করছে এটা যদি গণতান্ত্রিক অধিকার এবং গণতন্ত্র সমর্থিত হয় তাহলে কোন বিবেচনায় বলা যাবে গণতন্ত্র মানুষের মুক্তির মাইলস্টোন। প্রতিবেশী ভারতের কথাই ধরুন, সেখানে গণতন্ত্রের নামে নির্বিচারে মুসলিম নিধন চলছে। সেটি যদি কথিত গণতান্ত্রিক বিশ্ব সমর্থন করে তাহলে যে বিবেচনা থেকে আব্রাহাম লিংকন গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন আজকের প্রেক্ষিতে অবশ্যই তার নতুন করে আলোচনা উঠতে পারে। গণতন্ত্র যদি প্রকৃত বিবেচনায় মানুষের মুক্তির গ্যারান্টার হয়ে থাকে তাহলে দুনিয়াব্যাপী এই ব্যবস্থাপনায় মানুষ নিগৃহীত হচ্ছে কেন? এই কেনর জবাব আজ মানুষের মুক্তির বিবেচনা থেকেই খোঁজা জরুরি হয়ে উঠেছে। অবশ্যই এখানে উল্লেখ করা দরকার, অন্য দেশের ক্ষেত্রে যাইহোক নিজ দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্য মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট যতœবান। এটাও গণতন্ত্রের দ্বিমুখী নীতির অংশ।
বিশ্বের দেশে দেশে মানুষের মুক্তির যে আন্দোলন চলছে তাতে প্রকৃতিগত তারতম্য থাকলে এটা বোধহয় বলা যায়, প্রকৃত প্রস্তাবেই শাসকদের এক ধরনের ব্রুটালিটির বিরুদ্ধেই তা পরিচালিত হচ্ছে। যখন আমরা ফিলিস্তিনের কথা বলি তখন আমাদের বিবেচনায় চলে আসে কীভাবে আন্তর্জাতিক মোড়লদের কারসাজিতে নিজ বাসভূমে তারা অসহায়। সেখানকার মানুষ স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে পারছে না। অথচ ইসরাইল দাবি করে সে একটি গণতান্ত্রিক দেশ। এখন গণতন্ত্র যদি এমন হয় যে কেবল তা নিজ দেশের জন্য শান্তির আর অন্যদের জন্য অশান্তির তাহলে তা নিঃসন্দেহে টিকে থাকার উপাদানশূন্য হয়ে পড়েছে। এটি বিশ্বব্যাপী যারা গণতন্ত্র নিয়ে কাজ করছেন অথবা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সভ্যতার জন্য নিরাপদ ট্যাবলেট হিসেবে সেবন করাতে চাচ্ছেন তাদেরও ভাবতে হবে। বিশ্বের অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশগুলো যত যা কিছুই করুক নিজ দেশে এক ধরনের ব্যবস্থা করে রেখেছে। সেখানে নাগরিক অধিকার নিয়ে খুব একটা প্রশ্ন নেই। গুরুতর কিছু দেখা দিলে আদালতের শরণাপন্ন হলে মোটামুটি একটা সুরাহা পাওয়া যায়। আমাদের দেশের অবস্থা দুই দিক থেকেই নাজুক। একদিকে গণতন্ত্রের কথা বলা হচ্ছে অথচ ভোটাধিকার দেয়া হচ্ছে না। অন্যদিকে স্বাধীনতা অর্জনের কথা বলা হলেও নাগরিক অধিকারের অবস্থা উপনিবেশিক আমলের চেয়েও নাজুক। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল চাবিকাঠি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা বললেই মহা অপরাধ হয়ে যাচ্ছে গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা বলা যদি অপরাধী হয়, তাহলে অপরাধের যে সংজ্ঞা রয়েছে তা পাল্টাতে হবে।। এখানেও মৌলিক প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে মানুষের জন্য কোনটা শ্রেয় সে কি কেবল মুখ বুজে সরকারি বড়ি সেবন করবে নাকি নিজের প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের কথাটাও বলবে? পৃথিবীর কোথাও কোথাও একদিকে গণতন্ত্র, অন্যদিকে স্বেচ্ছাতন্ত্রের ব্যাপারটি রয়েছে। আগেও ছিল না তা নয়। এর অনেক উদাহরণ ও পরিণতির বিবরণ রয়েছে। এগুলো হলো মূলত আবিষ্কারহীন পৃথিবীতে লোহার মরিচার জন্য নোবেল দেয়ার মতোই। জনগণকে আইওয়াশ করার নানা ভ্রান্ত প্রক্রিয়া। আদতে এসবে কোনো ফায়দা নেই। বস্তুতান্ত্রিকতার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা তছনচ হয়ে যাবার পর মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় মত দলন দমনের ব্যাপারটি নিতান্তই হাস্যকর হিসেবে প্রমাণিত।
আধুনিক সভ্যতায় আমরা নাম লিখিয়েছি। নিজেদের সভ্য হিসেবেও দাবি করি। অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথাও জোরেশোরে প্রকাশ করছি অথচ বাস্তব হচ্ছে, গণতন্ত্র তো নেই প্রায় আর নাগরিক অধিকারের প্রশ্নে চলছে এক মহাবৈশম্য। চাকরি-বাকরি এমনকি শিক্ষার্থীদের বেলাতেও তাদের বাবা-মায়ের নামের তালিকা পরখ করছে দেশের গোয়েন্দারা অথচ টিআইবির রিপোর্ট বলছে, মেধা-মনন নয় বরং বাসাবাড়িতে কাজকর্ম করা ফুট-ফরমায়েশ খাটা দলবাজি করাই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আর এসবই নাকি হচ্ছে ক্ষমতার প্রভাব বলয়ের কারণেই। ভাববার রয়েছে, কোনটি প্রয়োজনীয়, প্রতিভা নষ্ট করা নাকি লালন করা। প্রতিদিন অর্থনৈতিক উন্নয়নের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শোনা যাচ্ছে অথচ বাস্তবতা হচ্ছে একসময়ে যে দাস প্রথার বিরুদ্ধে মানুষ বিদ্রোহ করেছে সেই দাস হবার জন্য আমাদের স্বাধীন দেশের নাগরিকরা জীবনপণ করে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। সবকিছুর পরেও খেয়ে-না খেয়ে শ্রম দিয়ে মজুরি পেয়ে না পেয়ে দেশে যারা থাকছে তারা যে মানবেতর জীবন-যাপন করছে তা দেখার কেউ নেই। দলের কিছু লোকের তৃপ্তির ঢেকুরই যেন সব টেনশনের সমাধান করে দিচ্ছে। সত্যি কথা বলতে কি, আধুনিক বিশ্ব মানুষের মুক্তির জন্য যতটুকু করেছে আমরা তার প্রাথমিক পর্যায়েও নেই। সমাজে, ব্যভিচার, ঘুষ, দুর্নীতি-দুর্বৃৃত্তায়ন এমন এক মাত্রায় উন্নীত হয়েছে যে এখানে আইন প্রশাসন সবকিছুই অসহায়। নিরঙ্কুশ দলীয়করণ সবকিছু তছনছ করে দিচ্ছে। সে কারণে বিশ্বজুড়ে মানুষের মুক্তির আকাক্সক্ষা আর বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি লড়াই অভিন্ন মাত্রায় নয়। মানুষের মুক্তির কোনো বিকল্প নেই। মানুষের চিন্তাই মানুষকে মুক্তির পথে নিয়ে যাবে। পূর্ব থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে বা রাজনৈতিক দলের অনুবর্তী হয়ে মুক্তির সৈনিকেরা মিছিলে যুক্ত হননা। তাদের বোধ-বিশ্বাস, চেতনা, মেধা-মননই তাদের দিয়েছে বিশ্বজুড়ে স্বীকৃতি। সবসময়ই যে পরিচিতজনেরাই এগিয়ে আসবে তেমনটা নাও ঘটতে পারে। মানুষ এগিয়ে এলে নেতা তারাই নির্বাচন করে নেয়। যাইহোক, এ কথাই ঠিক যে, মানুষ মুক্তি খুঁজছে এবং সঙ্গতভাবেই সে তার নেতাও খুঁজে নেবে। এটা মনে রাখতে হবে, বৃত্ত-বলয় তৈরি করে মানুষকে আটকে রাখা যায় না। বৃত্তের বাইরে বেরুবার কৌশল মানুষই বের করে।
awalthakur@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন