এক আলেম বন্ধু অনুযোগের সুরে বললেন, আমার ছেলেটাকে মাদরাসা থেকে দাখিল পাশ করার পর কলেজে নিয়ে গেছি। সে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইন্সের একটি সাবজেক্টে লেখাপড়া করছে। এ জন্যে পরিচিতজনেরা সমালোচনা করছে, আলেম হয়ে নিজের ছেলেটাকে কলেজ-ভার্সিটিতে নিয়ে গেল। এক্কেবারে দুনিয়াদার আলেম। জানতে চাইলেন, এভাবে পড়ানোটা শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে নাজায়েয বা আপত্তিকর কিনা।
বললাম, আমাদের সমাজ ইসলামকে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করতে অভ্যস্ত। প্রত্যেকে মনে করে, আমি যা করছি, বুঝি, সেটিই ইসলাম। তার বাইরে অন্য কোনো ধরনের ইসলাম গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এক সময় এ ধরনের সমালোচকরা মেয়েদেরকে তিন চার কেলাসের বেশি লেখাপড়া করানো জায়েয মনে করতেন না। চিন্তার এই বন্ধ্যাত্ব থেকে আফগানিস্তানের তালেবান এখনো বেরিয়ে আসতে পারছেন না বলে শোনা যায়। খোঁজ নিয়ে দেখেন, সময়ের ব্যবধানে অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। আমাদের দেশের সমালোচকরাই ভেতরে ভেতরে মেয়েদের উচ্চশিক্ষিত করছেন। এমনকি মহিলা মাদরাসার আদলে মেয়েদের হাফেয বানাচ্ছেন, দাওরায়ে হাদিস পাশ করাচ্ছেন।
ইসলাম কেবল নামায-রোযা-হজ্জ-যাকাতের মতো কতক আনুষ্ঠানিকতার নাম নয়; বরং মানব জীবনের সকল দিক-বিভাগের সুন্দর ব্যবস্থাপনা ও নির্দেশনা ইসলাম দিয়েছে। কাজেই জীবন ধারনের জন্য যা কিছু দরকার সবকিছুর জ্ঞান অর্জন ও চর্চা করা ইসলামে বৈধ ও ফরজ। আমাদের ধর্মকর্ম পরিপালন বা কুরআন হাদীস বুঝার জন্য যে জ্ঞান ও পান্ডিত্যের প্রয়োজন তা আমরা ধর্মীয় জ্ঞান বলে বিশ্বাস করি। কিন্তু গোটা জীবন পরিচালনা, সমাজ ও রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনার জন্য ঐটুকু মাসআলা জানাই যথেষ্ট নয়। ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার জন্য কিতাবুল বুয়ু বা ব্যবসা অধ্যায় রয়েছে ফিকাহ শাস্ত্রে। প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থাও এ অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত। রাস্তা-ঘাট নির্মাণ, কলকারখানা স্থাপন ও পরিচালনা, দালান-কোঠা-অবকাঠামো তৈরি, যুদ্ধবিগ্রহ, সন্ধি, পররাষ্ট্রনীতি প্রভৃতি বিষয় তো মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য অপরিহার্য। কাজেই এগুলোও ধর্মীয় জ্ঞান এবং এসব বিষয়ে প্রাথমিক পর্যায়ের জ্ঞানার্জন সবার জন্য ফরজ এবং নির্দিষ্ট বিষয়ে উচ্চতর বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের জ্ঞানার্জন ফরযে কেফায়া। সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজনীয় প্রত্যেক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তৈরি না করলে পুরো মুসলিম সমাজকে ফরয ত্যাগের কারণে গোনাহে কবিরার জন্য দায়ী হতে হবে।
মাদরাসা নিয়ে আমাদের চিন্তার ভ্রান্তি : আমরা কয়েক দিক থেকে চিন্তার বিভ্রান্তির শিকার। নামীদামি আলেম বা ইসলাম নিয়ে চিন্তাশীলরাও মনে করেন, ইসলামী শিক্ষা বলতে কেবল মাদরাসার দ্বীনি শিক্ষাকে বুঝায়। এর বাইরে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ইসলাম বিরোধী। কারণ, জেনারেল শিক্ষা ইংরেজরা প্রবর্তন করেছে। উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজদের অধীনে কতক চাকরিজীবি বা ছাঁচাছোলা কথায় চাকর সৃষ্টি করা, যারা গায়ের চামড়ার দিক দিয়ে এদেশীয় হলেও চিন্তায়-চেতনায়-আচরণে পশ্চিমাদের সেবাদাস হবে। তাদের বক্তব্য ও যুক্তি আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু বাস্তবতা বলে একটি কথা আছে। ডিজিটাল যুগে রেডিও, টিভি, ফ্রিজ, মোবাইল জীবনের বাস্তবতা। এক সময় এক শ্রেণির আলেম মাইকের আওয়াজে শয়তান আছে বলে ভয় করতেন। অথচ মাইকের ব্যবহার এখন মসজিদেই বেশি। অবশ্য এ জাতীয় কিছু কুপমন্ডুক এখনো যে নেই তা নয়। তাবলিগি এজতেমায় লাখো মানুষ নামায পড়ে, তারা ওয়াজ মাইকে করলেও নামাযে মাইক বন্ধ রাখেন। সারা দুনিয়া একদিকে তারা একদিকে। যার ফলে বড় জামাতে রুকু সিজদার তাল ঠিক থাকে না, কাতারগুলোও এলোমেলো হয়ে যায়। এরপরও অনেকে তাবলিগের এই ভুলটি ধরিয়ে দেওয়াকে ভুল মনে করে। তারা যুগের বাস্তবতাকে অস্বীকার করেন। ফলে সমাজ সংগঠন ও রাষ্ট্রীয় জীবনের জন্য তাদের কোনো আবেদন নেই।
বিদ্যমান বাস্তবতা বলতে যা বুঝায় তাকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। যুদ্ধক্ষেত্রে গোলা বারুদের ব্যবহার আগেকার যুগে ছিল না। এখন যদি বলেন, আমি জিহাদ করব, ঢাল তলোয়ার নিয়ে। তাহলে বাস্তবতাকে অস্বীকার করা হবে। পাকিস্তান আমলে এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শুরুর দিকে মাদরাসা শিক্ষার মাধ্যম ছিল উর্দু। ১৯৭৫ পর্যন্ত আলিয়া নেসাবের মাদরাসাগুলোতে এ অবস্থা বলবৎ ছিল। ক্রমান্বয়ে উর্দুর স্থানটি দখল করেছে বাংলা। আরো অনেক পরে কওমী মাদরাসাসমূহে ইদানিং উর্দুর স্থলে বাংলার চর্চা হচ্ছে। এখন এটিই বাস্তবতা, স্বতঃসিদ্ধ, বদিহিয়্যাত। একে অবশ্যই মেনে নিতে হবে। কেউ এখন দাবি করতে পারবেন না যে, আমাদের কিতাবগুলো উর্দুতে পড়তে, বুঝাতে ও পরীক্ষায় উত্তর লেখার ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। মাদরাসা শিক্ষায় এই বাস্তবতা মেনে নেয়ার সুফল হয়েছে সুদূর প্রসারি।
স্বাধীনতায় সবচে সুবিধাভোগী আলেম সমাজ : আমি একাধিক লেখায় বলেছি যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ফলে এককভাবে কোনো সম্প্রদায় বা জনগোষ্ঠী যদি লাভবান হয়ে থাকে তারা হচ্ছেন আলেম সমাজ। মাদরাসা শিক্ষার মাধ্যম বাংলা হওয়া এবং বাংলা চর্চার বদৌলতে মসজিদসমূহে জুমার খুতবার পূর্বে বাংলায় গঠনমূলক আলোচনায় আলেম সমাজ বেশ দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পারছেন। আগে ইসলামী সাহিত্য বলতে বুঝাত মকসুদুল মুমেনিন ও বার চাঁদের ফযিলত জাতীয় বাংলা বাজারের কিছু বইপুস্তক। এখন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কল্যাণে দুনিয়ার বুকে এমন কোনো মৌলিক ইসলামী বই নেই, যেগুলো বাংলায় অনুবাদ হয়নি বা অনুবাদের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। শিক্ষার মাধ্যম বাংলা হওয়ার ফলে মাদরাসার ছাত্ররা সরকারী চাকরি বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকতায় অনেকদূর এগিয়ে। সাহিত্যচর্চা, সাংবাদিকতা, প্রকাশনা শিল্প ও মিডিয়াতেও তাদের পদচারণা উৎসাহব্যঞ্জক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন