আমাদের দেশ থেকে ইসলামী শিক্ষা তুলে দেয়ার জন্য অনেক আগে থেকে গভীর ষড়যন্ত্র হচ্ছিল এবং এটা বর্তমানে বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নের জন্য আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং এটা আমাদেরও দাবি ছিল। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, যেটা কুষ্টিয়ায় আছে, সেটাও গোটা জাতির, দেশের ও আলেম সমাজের শত বছরের স্বপ্ন ছিল, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখন হয়তো মানুষ মনে করতে পারে কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং ফাযিল কামিলের মান দেয়ার জন্য ঢাকায় ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, আর কী চাই? প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে, ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স খোলার জন্য অনেক মাদরাসায় পারমিশন দেয়া হয়েছে সত্য; কিন্তু আনুষাঙ্গিক প্রয়োজনীয় বিষয়ে চরম উদাসীনতা লক্ষ্যণীয়। যেসব প্রতিষ্ঠানকে অনার্স চালু করার জন্য পারমিশন দেয়া হয়েছে, অনার্স খোলার ও পড়ার জন্য কত টাকা-পয়সা খরচ করতে হয়, কত ঝুঁকি তাদের নিতে হয়, যারা ভুক্তভোগী শুধু তারাই ভালো জানেন। অনার্স খুলেছে, ক্লাসও শুরু হয়েছে; কিন্তু সরকারিভাবে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয় নাই। মনে করুন, ছাত্ররা আলিম পাশ করে যে মাদরাসায় অর্নাস আছে সেখানে অনার্সে ভর্তি হলো; কিন্তু সেখানে তো পড়া নাই। কারণ, শিক্ষক নাই। আর প্রতিষ্ঠান-ওয়ালারা কী করে, ফাযিল বা অন্য শিক্ষকদের দ্বারা প্রক্সি দিয়ে ক্লাস নেয়াচ্ছে। অনার্সে পড়াশোনার জন্য যদি নির্দিষ্ট শিক্ষক না থাকে তাহলে প্রক্সি দিয়ে কী হয়? অথচ এ প্রক্সি এখন প্রচলন হয়ে গেছে। আর তারা বলছে, আমরা ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছি, অনার্স চালু করেছি, তার জন্য বাহবা চায়। কিন্তু শিক্ষক যে নাই সে কথায় কেউ নেই। ছাত্ররা তো বোকা না। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে তারা তো বোকা না। তারা জীবনের মূল্যবান সময় অনর্থক কাটিয়ে দিতে পারে না। কাজেই যেখানে সুযোগ পায় সেখানে গিয়ে অনার্সে ভর্তি হয়। আবার অনেকেই, যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাচ্ছে, সেখানে ভর্তি হচ্ছে। অনেকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে। মাদরাসায় শুধু নামকা-ওয়াস্তে ভর্তি দেখায়।
মাদরাসায় ছাত্র আসে ইবতেদায়ী মাদরাসা থেকে বা প্রাইমারী স্তর থেকে। প্রাইমারী স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের ইনসেন্টিভ দেয়া হয়। উপবৃত্তি দেয়া হয়; এমনকি নানান প্রণোদনা দেয়া হয়। কিন্তু ইবতেদায়ীতে কোনো কিছু দেয়া হয় না। ইবতেদায়ী স্তর এবং স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসাগুলোতে যেসব শিক্ষকরা আছেন, তাদেরও কোনো মূল্যায়ন নেই এবং তেমন বেতনও পান না। অর্থাৎ মাদরাসার নিচের লেবেল থেকে যে ছাত্র আসার কথা, সে ছাত্র নিচের ইবতেদায়ী থেকে আসছে না। প্রাইমারীতে চলে যাচ্ছে। কারণ প্রাইমারীতে সব সুযোগ-সুবিধা দিয়ে রাখা হয়েছে। অথচ, মাদরাসার প্রাইমারী বা ইবতেদায়ীর জন্য সেই সুযোগ-সুবিধা নাই। কাজেই প্রকারান্তরে মাদরাসা শিক্ষার শিকড় গোড়া থেকে কেটে দেয়া হচ্ছে। কারণ, ইবতেদায়ীই তো মূল স্তর। এখান থেকে উপরে আসছে না। মাদরাসায় ছাত্রশূন্যতার এটি একটি প্রধান কারণ।
অন্যদিকে দাখিল পাশ করে কলেজে যাওয়ার সুযোগ-সুবিধা আছে, আলিম পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব দরজা খোলা আছে; কিন্তু স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে মাদরাসায় আসার কোনো সুযোগ-সুবিধা নাই। এইচএসসি পাশ করেও একই অবস্থা। অবস্থা হয়েছে, নিচে ইবতেদায়ী লেভেলে ছাত্র পাওয়া যাচ্ছে না, আবার মাঝখানে যারা আছে তারাও বিভিন্ন দিকে ছুটে চলে যাচ্ছে। দেখা যায়, দাখিলে পরীক্ষা দেয় দেড় লাখ ছাত্র-ছাত্রী। কিন্তু আলিমে পরীক্ষা দেয় মাত্র পঞ্চাশ হাজার। তার মানে, মাঝখান থেকে এক লাখ বা সিংহভাগ ছাত্র-ছাত্রী কলেজে চলে যায়। তারপরও যারা ফাযিল বা কামিলে লেখাপড়ার জন্য থেকে যায় তাদের জন্য শিক্ষক নাই। সরকারিভাবে শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ। তার মানে, অবস্থা হচ্ছে উপরে নামে উচ্চতর লেভেল, অনার্স-মাস্টার্স; কিন্তু ভিতরে কিছু নাই। কথায় বলে বাইরে ফিটফাট, ভিতরে সদরঘাট। এখন যদি সরকার বলে আমরা লক্ষ লক্ষ টাকা দিচ্ছি মাদরাসায়, আপনারা কয়জন ছাত্র পড়াচ্ছেন? দাখিলে যদি ৩০ জন ছাত্র পাশ না করে তাহলে আপনার মাদরাসা রাখবো না। এটা যৌক্তিক এবং আইনগত কথা। আর এ আইন যদি প্রয়োগ করা হয় তাহলে কয়টা মাদরাসা থাকবে? পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে যে কোনো সময় কাজটা তারা করবে। বর্তমানে জনমতের ভয়ে এ কাজটা করছে না। কিন্তু আসলেই শিক্ষাদীক্ষা শেষ। সিলেবাসের যে বারোটা বাজানো হয়েছে, তাতে মাদরাসা থেকে আলেম হওয়া, আরবী শিখা, আরবী ভাষায় বিশেষজ্ঞ হওয়ার কোনো সুযোগ নাই। ছাত্ররা কীভাবে কলেজে ভর্তি হতে পারবে, কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে সেই চিন্তায় ব্যস্ত। সে যোগ্যতা অর্জন করার জন্য মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে যারা কাজ করছেন তারাও সিলেবাস সংশোধন করতে করতে আরবী কমানোর জন্য তাদের চেষ্টার ত্রুটি নেই। তারা কলেজ বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি প্রতিযোগিতায় ইংরেজি যোগ্যতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ফিকহ, কুরআন, হাদীসসহ বিভিন্ন বিষয়ে পরীক্ষায় নম্বর কমানোর জন্য অনেক কষ্ট করছেন।
এটা শুধু আমি আলিয়া মাদরাসার কথা বললাম। এ ধরনেরই একটি পরিকল্পনা কওমী মাদরাসার জন্যও বাস্তবায়িত হতে চলেছে। তার উদ্দেশ্য হলো, এ দেশ থেকে ইসলামী শিক্ষা তুলে দেয়া। আপনি বলবেন, না। এটা কি সম্ভব? আমরা তো বলি, আল্লাহর দ্বীন আল্লাহ হেফাজত করবে। কেননা আল্লাহতা’আলা বলেছেন, আমি কুরআন নাযিল করেছি আর আমি এর হেফাজত করবো। একথা তো সত্য। কিন্তু আল্লাহতা’আলা আমাদের মতো উদাসীন আত্মভোলাদের হাতে, আমাদের দিয়ে হেফাজত করবে না। কুরআন শরীফে বলা হয়েছে, তোমরা যদি দ্বীনের দায়িত্বপালন না করো তাহলে আমি তোমাদেরকে পরিবর্তন করে দেব, অন্য কওমকে পরিবর্তন করে নিয়ে আসব। তারা তোমাদের মতো হবে না। অর্থাৎ তারা আল্লাহ তা’আলার দ্বীনকে আঁকড়ে ধরবে। আলিয়া নেসাবের এক হাজারের বেশি নিউ স্কীম মাদরাসা কীভাবে স্কুল কলেজে রূপান্তরিত হয়েছে সে ইতিহাসও বাস্তব সাক্ষী কি আমাদের সামনে নেই? মিয়ানমারের মুসলমানদের অবস্থা কী? ভারতবর্ষ ৮০০ বছর মুসলমানরা শাসন করেছে, এখন কী অবস্থা? এগুলো তো বাস্তবতা। আমি মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে মোট চারটা বই লিখেছি। অতীতে মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কাজ করতে উৎসাহ পেতাম। যদি বলেন এখন মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে চিন্তা করেন না? বলবো, চিন্তা করি কিনা, তাও আমি জানি না।
কারণ, যাদের নিয়ে চিন্তা করি, লেখালেখি করি তারা এগুলো বুঝতে চান না, এমনকি বুঝার চেষ্টাও করেন না। ইসলামী শিক্ষা নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা-ফিকির নাই। তারা শুধু ইনক্রিমেন্ট, বেতন, অবসরভাতা নিয়েই নাকি সলাপরামর্শে ব্যস্ত থাকেন। কওমী মাদরাসার লোকেরা আমার কথা হয়তো সহজে গ্রহণ করবে না। তাদের নেতারা হেসে হেসে ফাঁসির রশি গলায় পরছেন। আলিয়া মাদরাসার অভিজ্ঞতা সামনে থাকার পরও সে পথেই পা বাড়াচ্ছেন। একটি কথা বলি, কওমী মাদরাসার সূতিকাগার ছিল দেওবন্দ মাদরাসা। আমাদের দেশের কওমী অঙ্গনের সবাই নিজেদেরকে দেওবন্দি পরিচয় দিতে উৎসাহ বোধ করেন। দেওবন্দ মাদরাসা প্রতিষ্ঠার ফিলসফি বা দর্শন কী ছিল? দর্শন ছিল ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ার পর বৃটিশের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানগত যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া, সরকারি সাহায্য গ্রহণ না করা। এ জন্যেই তাদের নাম কওমী। কাজেই তারা যদি সরকারি সাহায্য গ্রহণ করেন বা সরকারি নিয়ন্ত্রণের শিকল গলায় পরেন তাহলে নিজের অস্তিত্বের দর্শনকে অস্বীকার করা হবে। নিজের প্রতিষ্ঠা লাভের দর্শন অস্বীকারের পরিণতি তো আত্মহত্যা ও নিজেদের বিলুপ্তি ছাড়া আর কিছু হতে পার না।
আমার কথাগুলো কওমী অঙ্গনের বন্ধুরা ভুলভাবে নিতে পারেন। কারণ, আমি কওমী ঘরানার নই। যদিও দুই মাস পটিয়া মাদরাসায় থাকতে মওলানা সুলতান যওক ছাহেব হুজুরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলাম। মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (র.)-যিনি ছদর সাহেব হুজুর নামে পরিচিত, তার একটা বই এর নাম ‘শত্রু থেকে হুঁশিয়ার থাক!’ ইংরেজরা মিশর দখল করার পর ২৫ বছর চেষ্টা করে কীভাবে সে দেশ থেকে ইসলামী শিক্ষা তুলে দিয়েছিল তার বর্ণনা এ বইয়ের মধ্যে আছে। বইটি মূলত ফিলিস্তিনের তৎকালীন গ্রান্ড মুফতি আমিমুল হুসাইনির একটি বক্তৃতা। তিনি করাচির দারুল উলুম মাদরাসায় একটা বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সে বক্তৃতা মওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী (র.) বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে ছেপেছিলেন। প্রকাশক ছিল খাদেমুল ইসলাম জামাত। যারা কওমী অঙ্গনে আছেন, যারা কওমী মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক, যারা কওমী পরিচয় দিতে উৎসাহ বোধ করেন তাদের আমি বলব, এ বইটা অন্তত পড়েন; আমার লেখা বই পড়ার দরকার নাই। এ বইটা পড়লে বুঝতে পারবেন, আমাদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যারা শিক্ষা নিয়ে কাজ করেন তাদের এরকম ছোট-খাটো বইগুলো পড়া উচিত। মাদরাসা শিক্ষার ভবিষ্যত নিয়ে এই আতঙ্কের পাশাপাশি ভয়াবহ খবর হলো, এসএসসি সিলেবাস থেকে ইসলামিয়াত তুলে দেয়া হয়েছে। বৃটিশ আমল থেকে যুগ যুগ ধরে স্কুলের দশম শ্রেণির পাবলিক পরীক্ষায় ১০০ নম্বরের ইসলামিয়াত পরীক্ষা বাধ্যতামূলক ছিল। শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ ছেলেমেয়ে স্কুল কলেজে বা জেনারেল লাইনে পড়ে। তারা এসএসসি ১০০ নম্বরের পরীক্ষায় পাশ হতে গিয়ে কিছুটা হলেও নিজের ধর্ম, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে জ্ঞান হাসিল করত। নতুন শিক্ষা আইন পাশ হলে সুকৌশলে সেই ১০০ নম্বরের পরীক্ষা উঠে যাবে। আমি একাধিক লেখায় বলেছি যে, এমনটি হলে তা হবে আমাদের মুসলিম জাতিসত্তার উপর কয়েক ডিভিশন সৈন্য নিয়ে আগ্রাসন চালানোর চেয়েও মারাত্মক। এর আগে ১৯৯৬ সালে কলেজ লেভেলে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে সকল বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য যেটুকু ইসলামিয়াত শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল খুব সন্তর্পণে তা তুলে দেয়া হয়েছে, যা নিয়ে আমাদের অনেকে বেখবর। সকলে যেন নীরবে সয়ে গেছে। এর পেছনে আমাদের ছেলেমেয়েদের নাস্তিক বা ধর্মবিদ্বেষী হিসেবে গড়ে তোলা ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলে আমার মনে হয় না।
২০১০ সালে একটা শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়েছিল। তখন শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন নুরুল ইসলাম নাহিদ। এটা যখন ফাইনাল হয় তখন সমালোচনা এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়েছিল। এটা ফাইনাল হয় ২০১২ সালে। এই শিক্ষানীতিতে ইসলাম শিক্ষা এ দেশ থেকে উৎখাত করার একটা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়েছে; কিন্তু বাস্তবায়ন করা হয়নি। যেমন এদেশে মুসলমান ঘরের শতকার ৯০ জন ছেলেমেয়ে স্কুলে পড়ে। আর ১০ জন ছেলেমেয়ে পড়ে মাদরাসায়। অথচ, স্কুলে নবম ও দশম শ্রেণিতে ১০০ নম্বরের ইসলামিয়াত পরীক্ষা তুলে দেয়া হয়েছে। কীভাবে দেখুন, তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ কৌশল করে ইসলাম শিক্ষা কথা পরিবর্তন করে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা নাম দিয়েছেন। ‘ও’ মানে কী। যদি বলি খালেদ ও ওমর । তার মানে খালেদ এক লোক, ওমর আরেক লোক। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এক জিনিস। এখানে দুটোর মাঝে যদি ‘ও’ বসানো হয় তাহলে দুটো ভিন্ন জিনিস বুঝাবে। অর্থাৎ নাহিদ সাহেব প্রকারান্তরে কৌশলে বুঝিয়েছেন, ধর্মের মধ্যে নৈতিকতা নাই। সুতরাং ধর্মও শিখাবো, নৈতিকতাও শিখাবো। অতএব, ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা নামকরণ করে ইসলামের মধ্যে নৈতিকতা নাই এটাই বুঝাতে চেয়েছেন। এরা নাস্তিক, সারাজীবন কমিউনিজম করেছেন। নাস্তিকরা আদর্শিক মার খেতে খেতে যখন আর কোনো শক্তি নাই তখন খুব কৌশলে, সন্তর্পণে আওয়ামী লীগের উপর সওয়ার হয়েছে। মন্ত্রিত্ব বাগিয়েছে। আওয়ামী লীগের সাইনবোর্ড ব্যবহার করেছে; আওয়ামী লীগের লোকজন জানে না যে, এই কুচক্রী মহলটা এরকম ষড়যন্ত্র করছে। তারা স্কুলের নবম-দশম শ্রেণি থেকে ইসলাম শিক্ষা বাদ দিয়ে দিয়েছে। আপনারা যারা শিক্ষক আছেন তারা বলবেন, কই আমরা তো এখনও পড়াই? আমি বলব, পড়ান ঠিকই; কিন্তু ২০১২ সালের আগের নিয়মে। ২০১২ সালে যে শিক্ষানীতি হয়েছে তা খুলে দেখেন, সেখানে নবম-দশম শ্রেণির জন্য ইসলাম শিক্ষা তো দূরের কথা; নৈতিক শিক্ষা বলতেও কিছু নাই। ২০২২ সালের যে কারিকুলাম করা হয়েছে তা তো ২০১২ সালের শিক্ষানীতির আলোকেই করা হয়েছে। এখন ইসলাম শিক্ষা নাই, তারা একথাটা বলতে চাচ্ছে না। বলতে চাচ্ছে কি? বলতে চাচ্ছে ইসলাম শিক্ষা আছে; কিন্তু সেটা পরীক্ষা দেয়া লাগবে না। স্থানীয় পরীক্ষায় মূল্যায়ন করা হবে; ফাইনাল তথা বোর্ড পরীক্ষায় মূল্যায়ন করা হবে না। যদি ফাইনাল পরীক্ষায় মূল্যায়ন না করা হয় বা নম্বর যোগ না করা হয় তাহলে ছেলেমেয়েরা কোন দুঃখে তা পড়বে?
তারা মানুষকে বুঝাতে চাচ্ছে আমরা বাদ দেইনি। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হচ্ছে মেট্রিক থেকে ইসলাম শিক্ষা বাদ দিয়ে জাতিকে নাস্তিক বানানোর চেষ্টা চূড়ান্ত করেছে। খুব ভয়াবহ অবস্থা! এখন যদি দেশের মুসলমানরা, ভিন্ন ধর্মের ধার্মিক লোকেরাও যদি সচেতন না হয় তার পরিণতি হবে খুব ভয়াবহ। আজ জনগণকে সচেতন করার দায়িত্ব বর্তমান প্রজন্মের উপর অর্পিত। ফেইসবুকের মাধ্যমে, লেখালেখির মাধ্যমে, তবে ভুল তথ্যের ভিত্তিতে নয়। সরকারের লোকেরাও যদি জানে; তারাও তো তাদের বাচ্চাদের মাদরাসায় না পড়ালেও কুরআন শরীফ পড়ায়। তারাও তো নামাজ পড়ে। বিধর্মীরাও তো চায় না আমাদের বাচ্চারা ধর্মকর্ম ছেড়ে নাস্তিক হয়ে বের হোক। কিন্তু কৌশলে চক্রান্তকারী নাস্তিক শ্রেণির লোকেরা সবার চোখে ধুলা দিয়ে এ কাজটা করছে। এসব বিষয়ে মানুষকে সতর্ক করতে হবে, সচেতন করতে হবে। আপনারা লেখালেখির সময় যদি বলেন, সরকার এটা করেছে ওটা করেছে, তাহলে প্রথম থেকেই একটি নেগেটিভ ধারণা সৃষ্টি হবে। সরকার তো ইসলাম শিক্ষার কথা বলছে; প্রধানমন্ত্রীও তো ইসলাম শিক্ষার কথা বলছেন, যেভাবে হোক। তার যতটুকু বুঝ ততটুকুই তিনি বলছেন। ভিতরে ভিতরে যারা এ কাজটা করছে তাদেরকে চিহ্নিত করতে হবে, তাদের চক্রান্তের কথা ফাঁস করে দিতে হবে। কওমী অঙ্গনে যারা আছেন তারা আগের তুলনায় জাতীয় বিষয় নিয়ে অনেক সোচ্চার। কিন্তু নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করার শক্তি তাদের কাছ থেকে রহিত করা হয়েছে। মনে করুন, স্কুলের নবম-দশম শ্রেণি থেকে ইসলামিয়াত তুলে দেয়ার ষড়যন্ত্রের যে কথা বললাম, তা নিয়ে চিন্তা করার ফুরসত তাদের নেই। তারা বলবেন, আমাদের নূরানী মাদরাসা আছে। কিন্তু ২০১২ সালে প্রণীত শিক্ষানীতিতে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। তার মানে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত একই সিলেবাসের প্রাইমারী শিক্ষা প্রবর্তন করা হবে, তার বাইরে গেলে জেল-জরিমানার শাস্তি আছে। শিক্ষানীতি পড়ে দেখলেই আমার কথার সত্যতা পাবেন।
[২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১, বাংলাদেশ জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়ার প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রদত্ত প্রধান অতিথির ভাষণ। ক্যাসেট থেকে অনুলিখন করেছেন বাংলাদেশ জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়ার বর্তমান সভাপতি মুহাম্মদ জহিরুল ইসলাম।]
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন