ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
প্রাইমারি ৫+ হাইস্কুল ৫+ ও কলেজের ২; মোট ১২টি শিক্ষাবর্ষ শেষে শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের লেখাপড়া। এই পর্যায়টি দুই ভাগে বিন্যস্ত; স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। বিএ, বিকম, বিএসসি স্নাতকোত্তর পর্যায়ভুক্ত। আর এমএ, এমকম, এমএসসি স্নাতকোত্তরের আওতাধীন। এর পরের স্তরে এম.ফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের। স্নাতক শ্রেণীর আবার দুটি ধারা। একটি পাস কোর্স, অপরটি অনার্স কোর্স। পাস কোর্স এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ন্যস্ত। অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু অনার্স বা স্নাতক সম্মান কোর্স চালু আছে। এখন আমরা প্রথমে দেখব, বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে কতটুকু ইসলামী শিক্ষার সুযোগ বাংলাদেশে বর্তমানে আছে। আর এ পর্যায়ে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হলে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে।
ডিগ্রি পাস কোর্সে মানবিক গ্রুপে ৩০০ নম্বরের ইসলামিক স্টাডিজ শিক্ষার সুযোগ আছে। ইসলামের ইতিহাস ও আরবির জন্যও আলাদা ৩০০ নম্বর করে বরাদ্দ আছে। তবে যারা বাণিজ্য বা বিজ্ঞান নিয়ে পড়বে তাদের জন্য ইসলামী শিক্ষা, ইসলামের ইতিহাস বা আরবির কোনো বাধ্যবাধকতা বা সুযোগ অবারিত নেই। স্নাতক সম্মানে প্রত্যেকটি বিষয়ে আলাদা ও বিশ্লেষণাত্মক পড়াশোনা হয়। এই স্তরে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ চালু আছে এবং তা যথেষ্ট সমৃদ্ধ। এমন কি আরবি বিভাগের চাইতেও জনপ্রিয়। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যার দিক থেকেও মানবিক অনুষদের অনেকগুলো বিভাগের চেয়ে অধিক কোলাহলমুখর।
কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আল-কোরআন, হাদিস, শরিয়া আইন প্রভৃতি বিভাগের সাথে ইসলামিক স্টাডিজ বিশেষণটি জুড়ে দিয়ে তাকে সর্বজনীনতা দেয়া হয়েছে। সবদিক বিবেচনায় আনলে বলতে হবে যে, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কিছু ছাত্রছাত্রীর ইসলামী শিক্ষা অর্জনের সুযোগ রয়েছে। তবে সর্বজনীনভাবে সকল ছাত্রছাত্রীর ইসলামী শিক্ষা গ্রহণ বা ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা বলতে যা বুঝায়, তার সুযোগ এখন নেই। আমরা এখন খতিয়ে দেখব বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সর্বজনীন ইসলাম শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হলে কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে।
শুরুতে এ বিষয়ে দু-একটি প্রশ্নের উত্তর দেয়া প্রয়োজন মনে করছি। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী শিক্ষা চালুর কথা বললে কারো যেন এই ধারণা না জন্মে যে, এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বুঝি মাদরাসা বানানোর প্রস্তাব করা হচ্ছে। কেউ যেন এ কথাও না ভাবে যে, ইসলামী শিক্ষা বলতে তো একমাত্র মাদরাসা শিক্ষাই বুঝায়। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার কোন ধরনের ইসলামী শিক্ষার কথা বলা হচ্ছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় নামে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে চালু আছে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে সাইনবোর্ডে ‘ইসলামী’ পরিভাষাটাই সার। ভেতরে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে ভিন্ন চরিত্র খুব কমই নজরে পড়ে। কাজেই আমাদের প্রস্তাবনায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইসলামী শিক্ষা বাস্তবায়নের আওতায় এসব নামসর্বস্ব ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়কেও অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। অবশ্য নামে ইসলামী শব্দটি থাকায় এখানে সর্বজনীন ইসলামী শিক্ষার প্রস্তাবনাটি সহজতর হবে বলে আশা করা যায়।
কলেজ স্তরের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখলেই যে কোনো ছাত্রছাত্রীকে দুটি মৌলিক বিষয়ে লেখাপড়া ও পাস করতে হয়। একটি বাংলা, অপরটি ইংরেজি। এ দুটিকে বলা হয় ফাউন্ডেশন কোর্স। এ দুটি বিষয়ে পাস করলেই ধরে নেয়া হয় যে, এই শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে লেখাপড়ার যোগ্যতা ঝালাই করে নিয়েছে। এরপরেই অনার্স কোর্সে বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চতর অধ্যয়নে রত হয় ছাত্রছাত্রীরা। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সর্বজনীন ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে উল্লিখিত দুটি ফউন্ডেশন কোর্সের সাথে আরেকটি কোর্স চালু করতে হবে। তার নাম ইসলামিক স্টাডিজ। মুসলিম ছাড়া অন্য ধর্মের ছাত্রছাত্রীরা রিলিজিয়াস স্টাডিজ নামে তাদের ধর্ম ও ইতিহাস সম্পর্কে অধ্যয়ন করবে।
ইসলামিক স্টাডিজ বলতে সাধারণত আমরা মাদরাসায় অধীত বিষয়গুলো মনে করি। এ ধারণা পুরোপুরি সঠিক নয়। ইসলামের আকিদা বিশ্বাস, ধর্মীয় আচরণ, ইবাদত, আনুষ্ঠানিকতা, আইনকানুন, ইসলামের ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ে বিস্তৃৃত জ্ঞানচর্চা ইসলামিক স্টাডিজের মূল উপজীব্য। তার সাথে অন্যান্য ধর্ম ও সভ্যতা সম্পর্কে জ্ঞানার্জনও ইসলামিক স্টাডিজের আওতাভুক্ত। কোরআন মজিদে তাওহীদ, রিসালাত ও ইসলামী আইনকানুন সম্পর্কে আলোচনার পাশাপাশি কাফের, মুশরিক, ইহুদি খ্রিস্টানদের বিশ্বাস, জীবনাচার ও ইতিহাস সম্পর্কে অনেক বিস্তৃৃত আলোচনা আছে। কাজেই ইসলামী শিক্ষা বলতে শুধু কোরআন-হাদিসের শিক্ষাকে মনে করার মানে নেই। বদর যুদ্ধের ইতিহাস আমরা জানি। যুদ্ধ বন্দিদের মুক্তিপণ হিসেবে একটি শর্ত ছিল ১০ জন মুসলমানকে লেখাপড়া শিখালে একজন যুদ্ধবন্দিকে মুক্তি দেয়া হবে। যুদ্ধবন্দিরা ছিল মক্কার কুরাইশ মুশরিক। এরা ১০ জন মুসলমানকে যে শিক্ষা দেয়ার শর্ত মহানবী (সা.) নির্ধারণ করেছিলেন, তা নিশ্চয়ই তাওহীদ বা কোরআন কিংবা ইসলামী শিক্ষা নয়; বরং প্রচলিত লেখাপড়ার বিদ্যা। এই বিদ্যার কতখানি গুরুত্ব রাসূলুল্লাহ (সা.) দিয়েছেন বদর যুদ্ধের ইতিহাস তার জ্বলন্ত সাক্ষী। কাজেই সাধারণ শিক্ষাকেও ইসলামী শিক্ষার আওতায় গণ্য করার যথেষ্ট যুক্তি আছে।
ইসলামের ইতিহাসের সর্বস্বীকৃত সুফি দার্শনিক হচ্ছেন মওলানা রূমী রহ.। তার রচিত ফারসি কাব্যগ্রন্থ মসনবীর খ্যাতি জগতজোড়া। গল্পের পর গল্প দিয়ে সাজানো মসনবীর একটি বিখ্যাত গল্পের শিরোনাম সিংহ ও খরগোশের গল্প। মওলানা রূমী পরিষ্কার ভাষায় বলছেন যে, তিনি গল্পটি নিয়েছেন সংস্কৃত ভাষায় রচিত ‘কালিলা দিমনা’ থেকে। অথচ এই গল্পের ভেতর দিয়ে ইসলামী আকিদা বিশ্বাস, মানুষের নিয়তির বাধ্যতা ও কর্মের স্বাধীনতা প্রভৃতি বিষয় কালজয়ীরূপে উপস্থাপন করেছেন। কাজেই বোঝা যায় সৎ উদ্দেশে হলে বাইরে থেকে শিক্ষার উপাদান গ্রহণ করতে ইসলামে কোনো বাধা নেই।
আরেকটি মৌলিক কথা হলো মুসলিম সমাজের সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য যে যে জ্ঞানের প্রয়োজন সবই ফরযে কেফায়ার অন্তর্ভুক্ত। আমাদের ধর্মীয় প্রয়োজনে হাদিস তাফসির ফিকাহ প্রভৃতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞের দরকার। আবার সমাজ সভ্যতা টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে সামরিক শিক্ষা, চিকিৎসা শাস্ত্র, ইঞ্জিনিয়ারিং প্রভৃতিও দরকার এবং এগুলো ধর্মীয় দরসের অন্তর্ভুক্ত। এই উদার দৃষ্টিভঙ্গিটি পোষণ করলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ম বর্ষের ফাউন্ডেশন কোর্সে ইসলামিক স্টাডিজকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি সহজে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হবে এবং ইসলাম সম্পর্কে না জেনে বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে যারা স্পর্শকাতরতা দেখান, তাদের অনেক প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে।
বাংলা, ইংরেজি ও ইসলামিক স্টাডিজÑ এই তিনটি ফাউন্ডেশন কোর্সের পর শুরু হবে অনার্স কোর্স। অনার্সে বিভিন্ন বিভাগে অনেকগুলো কোর্স পড়ানো হয় ৪ বছরব্যাপী। তারপরে এম.এ স্তর। ইসলামী শিক্ষার সর্বজনীন বাস্তবায়নের জন্য এখানে আমাদের প্রস্তাব হলো।
ধরুন, অনার্সের ৪ বছর ও মাস্টার্সের ১ বছর মোট ৫ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ৪০, ৫০ কিংবা ১০০টি কোর্স পাঠ করে পরীক্ষা দিতে হয়। কোর্সগুলো থাকে সে বিষয় সংক্রান্ত বিস্তারিত জ্ঞান, তথ্য ও প্রশ্নমালায় সাজানো। ইসলামী শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য এখানে সামান্য কিছু যোগ করলেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে। অর্থাৎ বিষয় ভেদে ৫ থেকে ১০টি ইসলামী কোর্স অতিরিক্ত যোগ করা। দীর্ঘ ৪-৫ বছরে মুসলমান ঘরের ছেলেমেয়েরা ৫-১০টি ইসলামী কোর্স অধ্যয়নে নিশ্চয়ই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে। এখানে উল্লেখ করতে চাই যে, শিক্ষার ইসলামায়ন বা ইসলামী শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য মূল ৪০, ৫০ বা ১০০ কোর্সে তেমন কোনো পরিবর্তন আনার প্রয়োজন হবে না। বরং পাশাপাশি ইসলামী স্টাডিজ বিষয়ক ৫-১০টি কোর্স পড়ালেই চলবে।
উদাহরণস্বরূপ, যারা ডাক্তারি বা সায়েন্স (যে কোনো বিষয়ে) নিয়ে পড়াশোনা করছে, ইসলামী শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য তাদের কোর্সগুলোকে কি ইসলামী ভাবধারায় নতুন করে লিখতে হবে? আমি বলব, না। প্রয়োজন নেই; বরং পাশাপাশি কয়েকটি কোর্স যোগ করে ছাত্রছাত্রীর নৈতিক চেতনাকে শাণিত করা এবং নিজের ধর্ম, ইতিহাস ও ঐতিহ্য থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে তাদের উজ্জীবিত করলেই ইসলামী শিক্ষা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য পূরণ হয়ে যাবে। তখন ডাক্তাররা চিকিৎসা পেশাকে মানবসেবার মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের উপায় হিসেবে গ্রহণ করবেন। প্রচলিত অর্থে গলাকাটা ডাক্তার না হয়ে মানব দরদী চিকিৎসকরূপী মহামানুষে পরিণত হবেন। তখন আমাদের দেশের রোগীরা চিকিৎসা না পেয়ে বা ডাক্তারের অবহেলায় ধুঁকে ধুঁকে মরবে না কিংবা ভারতে সিঙ্গাপুরে গিয়ে অঢেল বৈদেশিক মুদ্রা ঢেলে আসতে হবে না।
ইঞ্জিনিয়াররা যখন কোরআন-হাদিস থেকে তাদের পেশা ও গবেষণার পক্ষে অনুপ্রেরণা পাবেন, মুসলিম বিজ্ঞানীদের অতীত অবদান পড়ার সুযোগ পাবেন তখন দেশ, জাতি ও বৃহত্তর উম্মাহর খেদমতে নিজের প্রতিভা ও উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগাতে উদ্বুদ্ধ হবেন। দেশ ও জনগণের খেদমতে নিজের প্রত্যেকটি কাজকে সাদকায়ে জারিয়া গণ্য করবেন। তখন জাতীয় উন্নয়নের প্রকল্পগুলো দুর্নীতিমুক্ত হবে। নিত্য-নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে জাতীয় জীবনে সমৃদ্ধি আসবে। শিল্প ও প্রযুক্তিতে বিদেশ-নির্ভরতা ক্রমান্বয়ে কেটে যাবে। বৈদেশিক মুদ্রার প্রচুর সাশ্রয় হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের প্রায় সব বিষয় ও বিভাগের জন্য এসব ইসলামী স্টাডিজ কোর্স অভিন্ন বা সামান্য পরিবর্তিত আকারে হতে পারে। কোর্সগুলো বিন্যস্ত করার জন্য বিশেষজ্ঞদের মতামত নেয়া যেতে পারে। আমরা এখানে কয়েকটি কোর্স খসড়া প্রস্তাব আকারে পেশ করছি।
তাওহীদ; তাতে থাকবে আল্লাহর পরিচয়, আল্লাহর গুণাবলী ও সৃষ্টিজগতে তার নিদর্শনাবলীর বর্ণনা। বিশেষত ঈমানের ৭টি মৌলিক বিষয়: আল্লাহ, নবীজি (সা.), অন্যান্য নবীগণ (আ.), আসমানি কিতাবসমূহ, আল্লাহর ফেরেশতাকূল, পরকাল, তকদিরের ভালোমন্দ এবং মৃত্যুর পর পুনরায় জীবন লাভের প্রসঙ্গ। (২) রিসালাত; মহামানব হিসেবে রাসূল (সা.)-এর পরিচয়, তার জীবন চরিত, সেই জীবন চরিত হতে আমাদের সমাজের জন্য শিক্ষা ও আদর্শ এর অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
(৩) পরকাল; মৃত্যুর পরবর্তী জীবন, কিয়ামত, হাশরের ময়দান, মানুষের কর্মফল ও প্রতিদান, বেহেশত দোযখ প্রভৃতির স্বরূপ।
(৪) কোরআন মাজিদ; ওহীর স্বরূপ, কোরআন সংকলনের ইতিহাস, মানব জাতির ইতিহাস চর্চায় কোরআন মাজিদ, কোরআনিক বিজ্ঞান এবং মানব জাতির জন্য কোরআনের চিরন্তন পয়গাম।
(৫) হাদিস শরিফ; হাদিস সংকলনের ইতিহাস, প্রধান প্রধান হাদিস গ্রন্থ পরিচিত, আদর্শ সমাজ জীবনে হাদিসের শিক্ষাবলী।
(৬) বিজ্ঞান; বিজ্ঞান চর্চায় মুসলমানদের অবদান, স্মরণীয় বরণীয় মুসলিম মনীষীবৃন্দ।
(৭) ছেলে-মেয়ে, পিতা-মাতা, প্রতিবেশী ও অসহায় মানুষের প্রতি দায়িত্ব, খেদমতে খালকের (সৃষ্টির সেবার) মাধ্যমে স্রষ্টার সন্তুষ্টি লাভের নানা উপায়।
(৮) তাসাওফ; ইসলাম প্রচারে সুফীদের অবদান, তাসাওফের মূল শিক্ষা, তাসাওফ নিয়ে বিভ্রান্তি ও ধর্ম ব্যবসার স্বরূপ উন্মোচন। মানব প্রেম, আত্মিক সাধনা ও আল্লাহ প্রাপ্তির উপায় প্রভৃতি।
(৯) ইসলামের ইতিহাস, ইসলামের প্রথম যুগের ইতিহাস, বাংলাদেশে ইসলামের আগমন ও মুসলিম শাসনের ইতিহাস, বাংলাদেশে ইসলামী ঐতিহ্যের স্মৃতিচিহ্নসমূহ।
(১০) ইবাদত-অনুষ্ঠানের মাহাত্ম্য, ইসলাম নির্দেশিত ইবাদত অনুষ্ঠানের তাৎপযর্, মাহাত্ম্য ও শিক্ষাসমূহ বিশ্লেষণ।
এ ছাড়া বিষয় ভেদে চিকিৎসা বিজ্ঞান ও ইসলাম, দর্শন শাস্ত্রে মুসলিম অবদান, ইসলামী আইন শাস্ত্র, ইসলামী স্থাপত্য নিদর্শনাবলী প্রভৃতি বিষয়ে আলাদা আলাদা কোর্স অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
আমাদের বিশ্বাস জেনারেল শিক্ষা, বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার ইসলামায়নের জন্য এটি সবচেয়ে সহজ ও নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি এবং ইসলামী আতঙ্কে যারা সব সময় সন্ত্রস্ত থাকে, তারা ছাড়া অন্য কেউ এর বিরোধিতা করবে না।
জেনারেল শিক্ষার মূল আদল ও কাঠামো ঠিক রেখে এর ওপর ইসলামী লেবাস বা অলঙ্কার পরানোর এই পদ্ধতিটি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করা যেতে পারে। শিক্ষকতায় নিয়োজিত অনেকেই ইসলামী রাজনীতি বা সমাজ সেবায় অবদান রাখার জন্য ভাবেন। অথচ মুসলিম শিক্ষক-ছাত্রদের জন্য দেশে একটি সর্বজনীন ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার চেয়ে বড় খেদমত আর কিছু হতে পারে না। যারা সংখ্যায় কম হয়েও আমাদের মতো বিপুলসংখ্যক লোকের ওপর কর্তৃত্ব করছে তারা লোক দেখানো, নাম ফলানো রাজনীতির চেয়ে মৌলিক চিন্তা ও পরিকল্পনার পেছনে লুকিয়ে লুকিয়ে কাজ করাকে অধিক গুরুত্ব দেন।
অতীতের মুসলিম মনীষী, বিশেষত ইমামগণ এভাবে কাজ করেছিলেন বলে ইসলামের বিশাল জ্ঞান ও ঐতিহ্যের ভা-ার আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে। আমরা প্রত্যেকে যদি চিন্তা করে দেখি যে, আল্লাহতায়ালা আমাকে এত কিছু দিয়েছেন। সে তুলনায় একমাত্র আল্লাহর ওয়াস্তে আমি কতটুকু কি করেছি বা করতে পেরেছি। আমি যে জ্ঞান ও শিক্ষার জগতে বিচরণ করছি আমি কি শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে আল্লাহর দীনের জন্য, মুসলিম উম্মাহর জন্য কিছুটা হলেও অবদান রাখতে পারব না। এই আত্মজিজ্ঞাসা আশা করি আমাদের মাঝে জাগরণ আনবে। ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য হয়তো রাজনৈতিক ক্ষমতা বা চাপ লাগবে। কিন্তু এর রূপরেখা তৈরির কাজটি তো জ্ঞানী-গুণীদেরকেই আঞ্জাম দিতে হবে। সেই রূপরেখা সুন্দর হলে, গণমুখী প্রমাণিত হলে একদিন না একদিন এর বাস্তবায়ন আশা করা যাবে।
দেশে ইসলামী সরকার নেই, ইসলামী শাসন চলছে না। তাই বলে হাত-পা ছেড়ে দিয়ে আমরা বসে থাকতে পারি না। এরপরও তো নামাজ পড়তে হয়, রোজা রাখতে হয়, লক্ষাধিক লোক প্রতি বছর হজে যায়। মসজিদ-মাদরাসা আছে, থাকতে হবে। তার মানে আমাদের সাধ্যের মধ্যে ইসলামকে ধরে রাখতে হবে। চর্চা করতে হবে।
ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার আমরা দাবি তুলছি। ধরুন, এখন বলা হলো, সেই শাসনে শিক্ষাব্যবস্থার রূপরেখা কী হবে? বিচারব্যবস্থা ইসলামীকরণ বলতে কী কী সংস্কার দরকার হবে, আমাদের বুঝান। ইসলামী সংবিধান বলতে এর স্বরূপ কি? কোরআন আমাদের সংবিধান বললে তো হবে না। বুঝতে হবে যে, কোরআন মাজিদ সংবিধানের মূলনীতি। মূল সংবিধান নয়। সংবিধান রচনা করতে হবে দেশ ও জাতির প্রয়োজনকে সামনে রেখে। আশাকরি, বিষয়গুলো নিয়ে সবাই ভাববেন। যাদের বিত্ত সামর্থ্য আছে তারা সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়াবেন। ওয়াজ ও তাফসির মাহফিলের পেছনে অর্থ ব্যয় করাকে অগাধ সওয়াবের উপলক্ষ মনে করা হয়। সর্বসাধারণের মাঝে ইসলামী জাগরণের জন্য এসব মাহফিলের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। কিন্তু সব মেধা ও উদ্যোগ এর পেছনে নিয়োগ হলে কিংবা যারা লেখেন, গবেষণা করেন তাদের প্রতি অবহেলা করা হলে, আমাদের তো হুজুগে মাতাল হয়েই থাকতে হবে। অন্যরা আমাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাবে। তখন জাতি ও দেশ গঠনে ও নিয়ন্ত্রণে কতখানি পিছিয়ে থাকব, তার প্রমাণ আমাদের বর্তমান অবস্থা। এই দুরবস্থা থেকে উদ্ধার পেতে হলে শিক্ষাব্যবস্থার আদলে অভিযান চালাতে হবে। এই চেতনায় সামান্য হলেও নাড়া দেয়ার জন্যই আমার এই লেখা, করুণ আর্তকান্না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন