পরিত্যক্ত বোতলের মাধ্যমে গাছে পরিমিত পুষ্টি উপাদান সরবরাহ এবং সফটওয়্যারের মাধ্যমে গাছের খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের তরুণ বিজ্ঞানী আমিনুল ইসলাম। নিজ বাড়ির খালি জায়গায় এবং ছাদের বিভিন্ন গাছে তার উদ্ভাবিত এই পদ্ধতি ব্যবহার করে লেবু, কাঁচামরিচসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদনে সফল হয়েছেন তিনি। যে কোন গাছে ব্যবহার করা যায় এই প্রযুক্তিটি৷
সিদ্ধিরগঞ্জের পূর্ব সাহেবপাড়া আল-হেরা ইন্টারন্যাশনাল স্কুল সংলগ্ন এলাকায় তার বাড়িতে গিয়ে এমনই চিত্র চোখে পড়ে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, তরুণ বিজ্ঞানী আমিনুল ইসলাম এমন একটি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন, যাতে সফটওয়ারের মাধ্যমে গাছের খাদ্যকে কন্ট্রোল করার মধ্য দিয়ে কম খরচে অধিক ফলন পাওয়া যায়৷ দেখা যায়, এর মাধ্যমে সারা বছর বাম্ফার ফলন হয়৷ তিনি ইনকিলাবকে জানান, তার উদ্ভাবিত এই পদ্ধতি ব্যবহার করায় একটি গাছে সাধারণত যে পরিমাণ ফল পাওয়া যায়, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ফল পাচ্ছেন তিনি। বিভিন্ন গাছপালা নিয়ে প্রায় ১০ বছর গবেষণার পর তিনি এই দুটি পদ্ধতি আবিষ্কার করতে সক্ষম হন বলেও জানান।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, পৃথিবীর ৭০০ কোটি মানুষের সবাই তরুণ বিজ্ঞানী আমিনুল ইসলামের এই প্রযুক্তিটি জানা প্রয়োজন। কোন মানুষ ১ মাস এই প্রযুক্তিটি ব্যবহার করলে তিনি সব সময় তার সব গাছে প্রযুক্তিটির ব্যবহার করবেন। কথা বলে জানা গেছে, তরুণ বিজ্ঞানী আমিনুল ইসলাম অনেক কস্ট করে গবেষণা করেছেন৷ স্কুল-কলেজে পড়ার সময় টিফিনের টাকা বাচিয়ে গবেষণা করেছেন আমিনুল। যে সময় সবাই টাকা খরচ করে খেতেন, সে সময় আমিনুল গবেষণা করেছেন টাকা বাচিয়ে৷ দীর্ঘ এই সময় গবেষণা করতে গিয়ে তরুণ বিজ্ঞানী আমিনুল ইসলামের মোট ১ লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়েছে বলে ইনকিলাবকে জানান তিনি।
আমিনুল বলেন, খাবারের দোকানে রুটি, বিস্কুট, কেক, মুরগীর মাংস ( বারবিকিউ ) খাওয়ার জন্য রাস্তার পাশে টানানো থাকে, তখন রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় খেতে মন চায়। খেতে পারি না, পরে চোখ দিয়ে দেখে মনে মনে খেয়ে নিই, মনকে বলি টাকা গুলি খেলে তো গবেষণা করা যাবে না । এক সময় টাকা হলে খাওয়া যাবে এই বলে মনকে সান্তনা দেই। এভাবে কষ্ট করে গবেষণা করেছি । আমিনুল ইসলাম জানান, স্কুলজীবন থেকেই তার গবেষণার প্রতি অন্যরকম আগ্রহ ছিল। পাশাপাশি ছোটবেলা থেকে তিনি প্রচুর পরিমাণ গাছ লাগাতেন কিন্তু কিছু গাছে ফল হতো, আবার কিছু গাছে ফল হতো না। তখন তিনি এর কারণ বের করার চেষ্টা করতে লাগলেন। হঠাৎ একদিন খেয়াল করলেন টয়লেটের আশপাশের গাছগুলো তুলনামূলকভাবে বেশি মোটা ও বড় হয়ে থাকে। তখন এর কারণ বের করতে গিয়ে তিনি এই দুটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেন।
আমিনুলের জন্ম কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার শ্রীকাইলের ভুতাইল হলেও তার বেড়ে ওঠা নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে। বর্ণমালা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন।ইসলামী ব্যাংক ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে ডিপ্লোমা করেন। উদ্ভাবনের বিষয়ে আমিনুল বলেন, বোতলের মাধ্যমে গাছে পরিমিত পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করতে তিনি প্রতিটি গাছে দুটি করে বোতল লাগিয়েছেন। গাছে একটি বোতলের মাধ্যমে এনার্জি এবং আরেকটি বোতলের মাধ্যমে ফুল-ফলের খাদ্যউপাদান দেওয়া হয়েছে। এর ফলে যদি গাছে ফুল-ফল চান, তাহলে ওই বোতলে পরিমিত মাত্রায় পানি দিতে হবে। আবার যদি গাছের এনার্জী চান তাহলে এনার্জির বোতলে পরিমিত মাত্রায় পানি দিতে হবে।
তিনি গাছের এনার্জীর জন্য তৈরিকৃত বোতলে মুরগির বিষ্টা, নাড়িভুড়ি, শাকসবজির ফেলে দেওয়া অবশিষ্ট অংশ ব্যবহার করেছেন। তবে যে কেউ চাইলে শুধু মুরগির নাড়িভুড়ি বেশি ব্যবহার করে গাছের এনার্জী বোতল বানাতে পারবেন। অপরদিকে গাছের ফুল-ফলের জন্য তৈরিকৃত বোতলে তিনি শুধু কলার খোসা ব্যবহার করেছেন। দুটি বোতলের সরু প্রান্তটি গাছের মাটির সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে এবং অপর প্রান্তটির মুখ খোলা রাখা হয়েছে পানি দেওয়ার জন্য যাতে কন্ট্রোল হয় । অর্থাৎ বোতলের উপরের প্রান্তে পানি দেওয়া হলে তা বোতলের মধ্যে থাকা উপাদানগুলোর সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে মাটিতে যায়। এর ফলে মাটি পুষ্টি উপাদান ঠিকমতো পায়। ফলে অল্প জায়গা ও অল্প মাটিতে সারা বছর বাম্পার ফলন হয় ৷ গাছ যে খাবার টা পাচ্ছে তা জৈব উপায়ে পাচ্ছে৷ ফলগুলোও খুব সুস্বাদু হচ্ছে।
আমিনুল ইসলাম এই প্রযুক্তিটি এমনভাবে ডিজাইন করেছেন, যেন সব শ্রেণির মানুষ, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত সবাই এটা ব্যবহার করতে পারেন।কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, নারায়ণগঞ্জের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ ড. মো. আব্দুল মাজেদ এসেছিলেন তার প্রযুক্তি দেখতে। তিনি ইনকিলাবকে বলেন, এই প্রযুক্তিটা যদি আমরা ব্যবহার করি, তাহলে সহজেই বিভিন্ন রকমের সবজি যেমন: শসা, টমেটো, বেগুন, লেবু, মরিচ ইত্যাদি আমরা উৎপন্ন করতে পারবো ৷ আমরা নিজেরা খেয়ে বাড়তি বাজারে বিক্রয় করার সুযোগ আছে৷ এই উদ্ভাবনী প্রযুক্তির জন্য আমি তার প্রশংসা করি। আমি বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে আহবান জানাবো যে, নিজে দেখে গবেষণার মাধ্যমে এটাকে আরো যেন উত্তর উত্তর উন্নত করতে পারে ৷ বাংলার কৃষক প্রযুক্তিটা গ্রহণ করে অত্যন্ত উপকৃত হতে পারে বলেও আমি মনে করি ৷
আমিনুল ইসলাম বলেন, বিনা খরচেই যে কেউ এটি তৈরি করতে পারবে। ১০-১৫ বছরেও এইসব প্লাস্টিকের বোতল নষ্ট হয় না। তাই এই পদ্ধতিটি দীর্ঘদিন গাছে ব্যবহার করা যায়। একদিন দেখা যাবে পৃথিবীর সবাই এই প্রযুক্তিটা ব্যবহার করছে৷ আমিনুলের দ্বিতীয় প্রযুক্তিটি হলো, সফটওয়্যারের মাধ্যমে এনার্জি ও ফুল ও ফলের উপাদান কে নিয়ন্ত্রণ করা। এর ফলে যেকোনো স্থান থেকে গাছের খাবার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আপনি যখন কোথাও বেড়াতে গেলেন ২ দিনের জন্য আসলেন ৩০/৬০ দিন পর৷ তখন ঐ জায়গা থেকে সফটওয়্যার দিয়ে গাছে খাদ্য সরবরাহ করে ফুল ফল এবং গাছের সেই ফলকে বড় করতে পারছেন ৷ আপনি ২ ভাবেই কন্ট্রোল করতে পারবেন। সফটওয়্যার দিয়ে এবং ম্যানুয়ালি ৷ আপনি যখন গাছের কাছে আসবেন, তখন ম্যানুয়ালি কন্ট্রোল করবেন আর দূরে থাকলে সফটওয়্যার দিয়ে ৷
এই প্রযুক্তিটি তৈরি করতে তিনি প্রথমে তিনটি অংশ তৈরি করেছেন। রিসিভার অংশ, মেকানিক্যাল অংশ ও ইলেকট্রনিক্স অংশ। সফটওয়্যারের মাধ্যমে গাছে লাগানো বোতল দুটোতে পরিমিত মাত্রায় এনার্জি দেওয়া সম্ভব হয়। তবে এটি প্রথম পদ্ধতির চেয়ে তুলনামূলক কিছুটা ব্যয়বহুল। তিনি বলেন, প্রথমে একটু কষ্ট হলেও যখন এই প্রযুক্তিটি হাতে এসে যাবে, তখন আপনি গাছ লাগাবেন আর লাগাবেন ৷ মন চাইবে গাছ লাগাতে ৷ যখন ফলন বেশী বেশী আসবে, সবাই গাছ লাগাতে চাইবে। ১ ইঞ্চি জায়গা খালি রাখবে না কেউ ৷ এমনিতে যে ১টা গাছ লাগাতো, সে এই প্রযুক্তিটির ব্যবহার করার ফলে সে ১০০টি গাছ লাগাতে চাইবে৷ তরুণ বিজ্ঞানী আমিনুল ইসলামের এই প্রযুক্তিটি ব্যবহারের ফলে গাছের ফুল সহজে ঝরে না। ফলে বাম্পার ফলন হয় ৷ আমিনুল ইসলাম বলেন, গাছ অতিরিক্ত খাবার পেলে মরে যায়। অনেকে টাকা খরচ করে ছাদবাগান করলেও সঠিক খাদ্যের অভাবে আশানুরূপ ফল পান না। উদ্ভাবিত প্রযুক্তিগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি প্রচুর পরিমাণে গাছ লাগানোর উৎসাহ পাবেন বলে তিনি মনে করেন।
তিনি জানান, তরুন বিজ্ঞানী আমিনুল ইসলামের অনুবীক্ষন যন্ত্রটি নস্ট হয়ে গেছে , কেউ যদি ১টি নতুন অনুবীক্ষন যন্ত্র ও ১টি ল্যাপটপ সহায়তা করতেন, তাহলে গবেষণা করে আরো অনেক কিছু আবিস্কার করা যেতো ৷ অনুবীক্ষণ যন্ত্র এবং ল্যাপটপ কিনতে পারলে তিনি তার গবেষণা আরো বড় পরিসরে করতে পারবেন বলে জানান। আমিনুলের বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর মো. জাকারিয়া জানান, আমিনুল ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করতো। অনেক মেধা খাটিয়ে আমার ছেলে এই প্রযুক্তিটি উদ্ভাবন করেছে। সারাদিন যখন আমিনুলকে গবেষণা করতে দেখতাম, আমি প্রথম প্রথম তাকে বাধা দিয়েছিলাম। কারণ, এগুলো করে কোনো কাজ হবে না। শুধু শুধু সময় নষ্ট হবে। কিন্তু তার অনড় মনোভাব দেখে পরবর্তীতে আর বাধা না দিয়ে তাকে এইসব কাজে আরো উৎসাহ দেই।
আমিনুলের প্রতিবেশী তানভীর বাশার জানান, আমিনুল ইসলাম একজন তরুণ গবেষক। তার উদ্ভাবন নিয়ে আমরা অনেক আশাবাদী। এইসব উদ্ভাবনের মাধ্যমে বাংলাদেশ অনেকদূর এগিয়ে যাবে। এই এলাকার মানুষ তাকে তরুণ বিজ্ঞানী হিসেবেই চিনে থাকে। আমিনুলের মেধাকে সরকার কাজে লাগাতে পারলে দেশ অনেক কিছু পাবে৷বাংলাদেশের সবাই আমিনুল ইসলামের বাসায় এসে প্রযুক্তটির ব্যবহার হাতেকলমে শিখে যেতে পারেন। মাত্র ৩০ মিনিটে শিখিয়ে দেওয়া যাবে বলে আমিনুল জানান৷ তিনি চান সবাই তার টেকনোলজিটি ব্যবহার করুক৷ আমিনুল অনেক স্কুলে গিয়ে নিজের টাকা খরচ করে ছাত্রদেরকে এটি শিখান৷ তিনি বলেন, অনেকে আমার গবেষণা পছন্দ করছে এবং অনেকে শিখছে ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন