ড. শেখ সালাহ্উদ্দিন আহ্মেদ : দেশের দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততার আগ্রাসন বেড়েই চলেছে। কৃষি বিপর্যয়ের অশনি সংকেত হয়ে দেখা দিচ্ছে লবণাক্ততার আগ্রাসী থাবা। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমান্বয়ে নিচে নেমে যাওয়ায় লবণাক্ততা ভূগর্ভস্থ সুপেয় পানিকেও গ্রাস করতে চলেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপক বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে গোটা দক্ষিণ উপকূল অঞ্চলের নদ-নদী ও ফসলি জমিতে। প্রতি বছর লবণাক্ততার আগ্রাসী থাবায় উপকূলীয় জনপদ ক্রমশ পরিণত হচ্ছে বিরানভূমিতে। ২০০৭ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডর এবং তৎপরবর্তী আইলায় বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ সংস্কারের অবহেলায় গোটা উপকূলীয় জনপদ ও ফসলি জমি দ্রুত লবণাক্ত হয়ে আবাদহীন হয়ে পড়ছে।
আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী পানিতে লবণাক্ততার সহনীয় মাত্রা ২০০ পার্সপার মিলিয়ন (পিপিএম)। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে লবণাক্ততার সহনীয় মাত্রা তিনগুণ বেশি ছয়শ পিপিএম। কিন্তু দেশের দক্ষিণাঞ্চলের নলকূপগুলো থেকে যে পানি উঠছে তাতে লবণাক্ততার পরিমাণ সহনীয় মাত্রার চেয়ে ঢের বেশি। পিরোজপুর জেলার নলকূপের পানিতে এখন লবণাক্ততার মাত্রা সাতশ পিপিএম। ধারেকাছের জেলাগুলোর অবস্থা প্রায় অভিন্ন।
আগে শহরাঞ্চলে নয়শ থেকে এক হাজার ফুট এবং গ্রামাঞ্চলে সাতশ থেকে আটশ ফুট গভীর নলকূপ থেকে সুপেয় পানি পাওয়া যেত। এখন শহরাঞ্চলে এক হাজার থেকে বারশ ফুট এবং গ্রামাঞ্চলে আটশ থেকে এক হাজার ফুট গভীর নলকূপ না বসালে সুপেয় পানি পাওয়া যাচ্ছে না। কোথাও কোথাও লবণাক্ততার মাত্রা চার হাজার পিপিএম পর্যন্ত পৌঁছেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় পানিতে লবণাক্ততা বাড়ছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
জলবায়ু পরিবর্তনের অনিবার্য পরিণতিতে দেশের দক্ষিণ উপকূলজুড়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বাড়ছে তেমন বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় নিচে নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। ভারত থেকে আসা নদীগুলোর উৎসমুখে বাঁধ দেওয়ায় সুপেয় পানির উৎস সংকুচিত হচ্ছে। তার বদলে নদ-নদীতে ঢুকছে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি। কৃষি জমিতেও লবণাক্ত পানির আগ্রাসন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা পরিষদের (বিআইডিএস) এক তথ্য অনুযায়ী, দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে গড়ে ২০ শতাংশ আবাদি জমি প্রতি বছর নষ্ট হচ্ছে। এ কারণে উল্লিখিত জনপদের প্রায় ৮০ লাখ একর আবাদি জমি হুমকির মুখে পড়ছে। ওই তথ্য মতে, উপকূলীয় ও সমুদ্র তীরবর্তী ১৪ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় লবণাক্ত মাটি রয়েছে। কিন্তু এ মাটি বিভিন্ন সময়ে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসজনিত প্লাবনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরের সিডর এবং ২০০৯ সালের উপকূলে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় আইলায় দক্ষিণ উপকূল অঞ্চলের বিশাল জনপদের বেড়িবাঁধের প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার মধ্যে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৩৬৬ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ২ হাজার ১৪ কিলোমিটার।
এত বড় ধরনের পর পর ২টি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ায় দক্ষিণের উপকূল অঞ্চলের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলো দ্রুত মেরামত বা সংস্কারে শ্লতগতির কারণে বর্ষা মৌসুমে উপকূলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়ে আরো ভেতরে লবণ পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছে। এর ফলে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে শুরু করেছে উপকূল অঞ্চলে। এ সময় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সর্বোচ্চ মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বিস্তীর্ণ অঞ্চলে লবণাক্ততার করাল গ্রাস ঘটে।
বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের এক জরিপ অনুযায়ী, দেশের উপকূলীয় জনপদের প্রায় ২০ লাখ হেক্টর জমি কম লবণাক্ত। প্রায় ৮০ লাখ হেক্টর জমি ঈষৎ লবণাক্ত, ৬ লাখ ৬১ হেক্টর জমি মধ্যম লবণাক্ত এবং প্রায় ৭ লাখ হেক্টর জমি খুব বেশি লবণাক্ত। তাদের পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী ১৯৭৩ সালে দেশের ৮ লাখ ৩৩ হাজার হেক্টর জমিতে লবণাক্ততা ছিল, ২০১০ সালে এমন জমির পরিমাণ ১০ লাখ ৫৬ হাজার হেক্টরে পৌঁছেছে। উপকূল ভাগের কৃষিজমির শতকরা ৩০ ভাগই এখন লবণাক্ততার শিকার।
ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে কৃষিজমির পরিমাণ জনসংখ্যার তুলনায় কম। সে জমির উল্লেখযোগ্য অংশ লবণাক্ততার শিকার হওয়ায় কৃষির জন্য বিপর্যয়ের হাতছানি দিচ্ছে। এ সমস্যার মোকাবিলায় ত্বরিত পদক্ষেপ নিতে হবে। কীভাবে দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে লবণাক্ততার অভিশাপ থেকে রক্ষা করা যায় সে পথ খুঁজে বের করতে হবে।
ষ লেখক : এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও সভাপতি, সাউথ এশিয়ান ল’ ইয়ার্স ফোরাম
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন