হেলেনা জাহাঙ্গীর : বর্তমান যুগটা যেন প্রযুক্তিরই যুগ। বাজারে নিত্যনতুন প্রযুক্তির আগমন ঘটছে, মানুষ তা ব্যবহারও করছে। ফলে প্রযুক্তিপ্রেমীর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। বর্তমান সময়ে স্মার্টফোনের জয়-জয়কার আমরা লক্ষ্য করছি। খাবার টেবিলেও স্মার্টফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকছেন অনেকেই। তবে এ বিষয়টি পাশের লোকজন ভালোভাবে নাও নিতে পারে।
সম্প্রতি ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা যুক্তরাষ্ট্রের ২৪৯ জন মা-বাবা এবং তাদের ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী সন্তানদের মধ্যে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করেন। এতে দেখা গেছে, অতিরিক্ত প্রযুক্তি আসক্তি সন্তান ও অভিভাবকদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে। জরিপে দেখা গেছে, শুধু খাবার টেবিলে নয়, গাড়ি চালানোর সময় স্মার্টফোন ব্যবহারেও বিরক্ত হয় সন্তান। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভিভাবকের অতিরিক্ত সময় কাটানো এবং শেয়ারিংয়ের অভ্যাসগুলো একদমই পছন্দ করে না সন্তানরা। তবে প্রযুক্তির ব্যাপ্তি ছড়িয়ে পড়েছে সন্তানদের জীবনযাপনেও। বাস্তবতা হলো, এখন শুধু অভিভাবকদের নয়, সন্তানদের জীবনও প্রভাবিত হচ্ছে প্রযুক্তির মাধ্যমে। লক্ষ্য করা গেছে, অভিভাবক ও সন্তানরা একসাথে থাকলেও ব্যস্ত থাকছেন নিজ নিজ স্মার্টফোন নিয়ে। প্রযুক্তির অতিব্যবহার যে কল্যাণকর নয় তা উপলব্ধি করেন অভিভাবকরা। তাই তারা সন্তানদের প্রযুক্তি ব্যবহারের সময়সীমা নির্ধারণ করে দেন। কিন্তু নিজেরা এই শৃঙ্খলা মানেন না। স্ববিরোধী এমন আচরণ সন্তানদের পছন্দ নয়। সব মিলিয়ে স্মার্টফোন তথা প্রযুক্তি এখন অভিভাবক ও সন্তানদের মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমরা এ কথা জানি যে, প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো পিছিয়ে আছে। প্রযুক্তির আবিষ্কার ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে উন্নত দেশগুলো। এ কারণে প্রযুক্তির ব্যবহার ও এর প্রভাব বিষয়ে গবেষণাটা তারাই আগে করে থাকেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও স্মার্টফোনের ব্যবহার নিয়ে উন্নত দেশগুলোতে গবেষণা ও জরিপ হয়েছে। আমাদের দেশেও এখন ওইসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। প্রযুক্তি ব্যবহারের ইতিবাচক দিকগুলো তো স্পষ্ট, তবে এর নেতিবাচক দিকগুলোর ব্যাপকতা ও মাত্রা কেমন তাও আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। নইলে হিতে বিপরীতের আশঙ্কাই বাস্তব বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। এখন তো বলা হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের অসামাজিক করে তুলেছে। এ কথাও বলা হচ্ছে যে, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে যে যোগাযোগ হচ্ছে, সেটা আসলেই কি কোনো যোগাযোগ, নাকি এক ধরনের প্রহেলিকা? এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার ও সময়ের অপচয়ের অভিযোগ তো আছেই। আর স্মার্টফোন তো এখন পরিবার ও সমাজের জন্য অনেক ক্ষেত্রে আপদের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রয়োজনের কথা বলে কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীরা অভিভাবকের কাছে স্মার্টফোনের আবদার করে থাকেন। অভিভাবকরাও মমতার বশবর্তী হয়ে সন্তানদের হাতে স্মার্টফোন তুলে দেন।
কিন্তু ভাবনার বিষয় হলো, স্মার্টফোনের সদ্ব্যবহার কতটা হয়? স্মার্টফোন তো কৌতূহলী কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীদের সামনে যেন নতুন এক রঙিন পৃথিবী উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এই ফোনের মাধ্যমে যেমন জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে পরিচিত হওয়া যায়, তেমনি পরিচিত হওয়া যায় নিষিদ্ধ জগতের সাথেও। যৌনতা ও পর্নোগ্রাফি এক জনপ্রিয় বিষয় হয়ে উঠেছে। আর বিনোদনের তো কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। গান-বাদ্য, ছায়াছবি এখন সহজলভ্য হয়ে উঠেছে স্মার্টফোনের বদৌলতে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ২৪ ঘণ্টাব্যাপী অবারিত এত সব রঙিন বিষয় ও বিনোদন পণ্য মানব স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ইতিবাচক? মানুষকে তো কাজ করে খেতে হয়। স্বাভাবিক মানুষ কাজের মধ্যেই আনন্দ খুঁজে নিতে চায়। ২৪ ঘণ্টার জীবনে পেশা, খাওয়া, ঘুম ছাড়াও মানুষকে পারিবারিক ও সামাজিক নানা কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। এর মধ্যে স্বাভাবিক ও সুস্থ মানুষ তো বিনোদনের জন্য দুই-এক ঘণ্টার বেশি বরাদ্দ করতে পারেন না। কিন্তু হাতের মুঠোয় স্মার্টফোন থাকায় তার একটা প্রলোভন বা আকর্ষণ তো থাকেই। ফলে অনেক সময়ই মানুষ শৃঙ্খলায় থাকতে পারে না। সময়ের অপচয় হয়, দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও দেখা দেয় সমস্যা। ফলে প্রযুক্তির ব্যবহার এখন চিন্তাশীল মানুষদের কাছে এক বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মানুষ এখন কী করবে? প্রযুক্তির ব্যবহার ছেড়ে দেবে? এমন পরামর্শকে যৌক্তিক বলে বিবেচনা করা যায় না। প্রযুক্তির সঙ্গত ও ইতিবাচক ব্যবহারকে আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। তবে এমন ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন হবে নৈতিক মূল্যবোধ ও জবাবদিহির চেতনা। দুঃখের বিষয় হলো, বর্তমান সময়ে নৈতিক চেতনা যেন একটি গুরুত্বহীন বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অথচ এমন ভ্রমের কারণে বিজ্ঞান প্রযুক্তির নব-নব আবিষ্কার কাক্সিক্ষত সুফল বয়ে আনতে পারছে না। বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করলেই মানব জাতির মঙ্গল।
ষ লেখক : চেয়ারম্যান, জয়যাত্রা ফাউন্ডেশন
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন