কাজী সিরাজুল ইসলাম : নদী-নালা, খাল-বিল বা ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়াতে সরকারের নেয়া সেচ সম্প্রসারণ প্রকল্পের সুফল হিসেবে চলতি বছর ১ লাখ ৭১ হাজার টন খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি বছর সেচ সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় ৫৬ হাজার ৯৪৫ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা দিয়ে এই সাফল্য অর্জিত হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিকে দেয়া এ তথ্যটি নিঃসন্দেহে আশাজাগানিয়া।
সেচ কাজে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যাপক ব্যবহার দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। নিচে নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। বাংলাদেশ এমনিতেই নদীনালার দেশ। বৃষ্টিপাতের পরিমাণও সন্তোষজনক। নদ-নদী-জলাশয়ের ধারণ ক্ষমতা বাড়ালে সারা বছরই সেচ সুবিধার জন্য প্রয়োজনীয় পানি পাওয়া সম্ভব। ভূগর্ভস্থ পানি সেচযন্ত্রের সাহায্যে উঠানোর চেয়ে সেচকাজে জলাশয়ের পানি খরচ করা অপেক্ষাকৃত সাশ্রয়ীও বটে। কৃষি মন্ত্রণালয় ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়াতে যে উদ্যোগ নিয়েছে তা প্রশংসার দাবিদার। তবে বিষয়টি শুধু উপরিভাগের পানি ব্যবহারে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয়ের পানি সংরক্ষণেও নজর দিতে হবে। দেশের প্রাকৃতিক জলাশয়গুলোর পানি ধারণক্ষমতা বাড়াতে পারলে একদিকে সেচের ক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার যেমন কমিয়ে আনা সম্ভব হবে, অন্যদিকে জলাশয়গুলোতে মাছ চাষের মাধ্যমে আমিষ চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে।
বর্ষাকালে দেশের এক বিরাট অংশে বন্যা ছোবল হানে নদ-নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা না থাকার কারণে। নদ-নদী খননের মাধ্যমে পানি ধারণক্ষমতা বাড়াতে পারলে এ বিপদ থেকে অনেকাংশে রেহাই পাওয়া সম্ভব হবে। বাংলাদেশে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ সীমিত। ঘনবসতির এই দেশে প্রতিদিনই চাষযোগ্য জমি কমছে। এ অবস্থায় খাদ্য চাহিদা পূরণে সীমিত জমির সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারের দিকে নজর দিতে হবে। দেশের সব কৃষি জমি সেচ সুবিধার আওতায় আনা গেলে খাদ্য উৎপাদন অন্তত ৫০ ভাগ বাড়ানো সম্ভব হবে।
এ বিষয়টি মনে রেখে প্রাকৃতিক জলাশয়ের পানির সদ্ব্যবহারকে প্রাধান্য দিতে হবে। পাশাপাশি কৃষক যাতে তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পায় সেদিকেও নজর দেয়া দরকার। খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর জন্য যার কোনো বিকল্প নেই।
আমাদের জন্য খুশির বিষয় হচ্ছে, ওয়েবসাইটে ২০১৩ সালের উৎপাদনে তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে বিশ্বের ২০টি দেশের তালিকা। তাতে ৫ কোটি ৫০ লাখ টন খাদ্যশস্য উৎপাদন করে বাংলাদেশকে বিশ্বের দশম বৃহত্তম খাদ্য উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তালিকায় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে দুনিয়ার সবচেয়ে জনবহুল দেশ চীন। চীনের খাদ্য উৎপাদনে ৫৫ কোটি ১১ লাখ টন। ৪৩ কোটি ৬৫ লাখ টন খাদ্য উৎপাদনকারী যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান দ্বিতীয়, ২৯ কোটি ৩৯ লাখ টন খাদ্য উৎপাদন করে ভারত তৃতীয়, ১০ কোটি ১০ লাখ টন খাদ্য উৎপাদনকারী ব্রাজিল চতুর্থ, রাশিয়ার স্থান পঞ্চম ৯ কোটি ৩ লাখ টন খাদ্য উৎপাদন করে এ দেশটি। ষষ্ঠ স্থানে ৮ কোটি ৯৭ লাখ টন খাদ্য উৎপাদনকারী ইন্দোনেশিয়া, সপ্তম স্থানে ৬ কোটি ৭৫ লাখ টন খাদ্য উৎপাদনকারী ফ্রান্স, অষ্টম স্থানে কানাডা, যে দেশের উৎপাদন ৬ কোটি ৬৩ লাখ টন এবং নবম স্থানে ইউক্রেন ২০১৩ সালে যে দেশটির খাদ্য উৎপাদন ছিল ৬ কোটি ৩১ লাখ। বাংলাদেশ কয়েক বছর ধরে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ হিসেবে পরিচিত। সামান্য কিছু খাদ্য বিদেশ থেকে আমদানি হলেও একইভাবে বিদেশে খাদ্যও রপ্তানি করে বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার আগে দেশের লোকসংখ্যা ছিল ৭ কোটি। গত ৪৪ বছরে জনসংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেলেও খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে অন্তত তিনগুণ। ফলে যে দেশের মানুষ অন্তত ২০০ বছর ধরে অর্ধাহারে-অনাহারে কাটাত সে দেশে খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ স্বাধীনতার পর প্রায় দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি অনুসরণ কৃষি ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জনে সহায়তা করেছে। সরকারের কৃষিবান্ধব নীতিও এ কৃতিত্বের অন্যতম দাবিদার।
পরিশেষে বলতে হয়, বাংলাদেশ বিশ্বের দশম বৃহত্তম খাদ্য উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও এতে আত্মপ্রসাদের অবকাশ নেই। ঘনবসতিপূর্ণ এ দেশে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ সীমিত। জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে তাতে আগামীতে বর্ধিত জনসংখ্যার চাহিদা পূরণে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেবে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণেও উদ্যোগী হতে হবে।
ষ লেখক : উপদেষ্টাম-লীর সদস্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, সাবেক সংসদ সদস্য ফরিদপুর-১
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন