বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মুক্তাঙ্গন

আবারো সংকটের মুখে গার্মেন্ট শিল্প

| প্রকাশের সময় : ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এম এম খালেদ সাইফুল্লা : গার্মেন্ট শিল্প অবারও সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। গত কয়েক দিনের মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে ৫৫টি কারখানা। এই তালিকা আরো দীর্ঘ হতে পারে। বন্ধ হয়ে যেতে পারে আরো কিছু কারখানা। পোশাক প্রস্তুতকারী ও রফতানিকারকদের কেন্দ্রীয় সংগঠন বিজিএমইএ সম্প্রতি আয়োজিত এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে, ন্যূনতম মজুরি বাড়ানো এবং বার্ষিক ছুটির বিপরীতে ও চাকরির মেয়াদ পাঁচ বছর পূর্ণ হলে বছরে একটি করে মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ প্রদানসহ বিভিন্ন দাবিতে বিশেষ করে আশুলিয়া এলাকার কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা বেশ কিছুদিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে আসছিল। পর্যায়ক্রমে সে আন্দোলন অন্য কারখানাগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে। দাবি আদায়ের জন্য শ্রমিকরা কর্মবিরতি শুরু করে। কোনো কোনো কারখানার শ্রমিকরা শুধু হাজিরা দিয়েই বেরিয়ে আসতে থাকে।
এমন অবস্থায় প্রথমে ৩০টি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে শ্রমিকরা অন্য সব কারখানায়ও আন্দোলনের উসকানি দেয়। পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটে ১৩ ডিসেম্বর থেকে। মালিকরা বাধ্য হয়ে ৫৫টি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করেন। বিজিএমইএ’র উদ্যোগে একযোগে সমঝোতার লক্ষ্যে চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু কয়েক দিন আগে চারজন মন্ত্রীর উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত শ্রমিক ও মালিক পক্ষের বৈঠকে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও পরদিন শ্রমিক অসন্তোষ অনেক বেড়ে যায়। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়তে থাকলে মালিক পক্ষ বাধ্য হয়ে কারখানা বন্ধ করে দেন। এ প্রসঙ্গে তারা শ্রম আইনের ১৩(১) ধারার আশ্রয় নিয়েছেন, যেখানে বলা হয়েছে, কারখানা বন্ধ থাকলে শ্রমিকরা কোনো মজুরি বা বেতন পাবে না। মালিক পক্ষের এই কঠোর সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় শ্রমিকরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা আবদুল্লাহপুর-বাইপাইলসহ বিভিন্ন সড়কে যানবাহন চলাচলে বাধার সৃষ্টি করে। কিছু গাড়িও ভাংচুর করেছে তারা। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি মালিক পক্ষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার ফলেই কারখানা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে বলে জানিয়েছে বিজিএমইএ।
বলার অপেক্ষা রাখে না, আশুলিয়ার মতো শিল্পঘন একটি এলাকায় মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে হঠাৎ করে ৫৫টি গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবর নিঃসন্দেহে ভীতিকর। কারণ, কারখানা বন্ধ ঘোষিত হওয়ার খবর এটাই প্রথম নয়। কিছুদিন আগে প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা গেছে, চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত গত আড়াই বছরে বন্ধ হয়ে গেছে অন্তত ৫৩০টি গার্মেন্ট কারখানা। এসব কারখানা শিল্পঘন এলাকা হিসেবে পরিচিত আশুলিয়া, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ এবং চট্টগ্রামে অবস্থিত। এ চারটি এলাকায় অবস্থিত সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি শিল্প-কারখানার মধ্যে গার্মেন্ট কারখানার সংখ্যা ছিল তিন হাজার দুইশ’। জুলাই মাসে এই সংখ্যা নেমে এসেছিল আড়াই হাজারের সামান্য ওপরে। অর্থাৎ বিগত আড়াই বছরে প্রতিদিন গড়ে ১৭টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। এর সঙ্গে এবার যুক্ত হলো আরো ৫৫টি কারখানা।
আমরা উদ্বিগ্ন এজন্য যে, জিএসপি সুবিধা না পাওয়া এবং কারখানার কর্মপরিবেশসহ বিভিন্ন কারণে প্রবল প্রতিকূলতার মধ্যেও তৈরি পোশাকের রফতানি থেকেই এখনো বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার বড় অংশ আয় হয়। পোশাকের গুণগত মান ভালো হওয়ায় এবং ক্রেতা দেশগুলোর সঙ্গে মালিক পক্ষের সুসম্পর্ক বজায় থাকায় গার্মেন্ট রফতানিতে বাংলাদেশ দ্রুত সাফল্যের পথে এগিয়ে চলছিল। এই সাফল্যকে অব্যাহত রাখা গেলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রফতানিতে প্রতিযোগী রাষ্ট্রগুলোর ওপরে উঠে যেতে পারতো। এমন এক সম্ভাবনার মুখে এসে দরকার যখন ছিল কারখানার সংখ্যা এবং উৎপাদন ও রফতানির পরিমাণ ক্রমাগত বাড়ানো ঠিক তেমন এক সময়ে দেশ উল্টো পরিস্থিতির শিকার হয়েছে।
আমাদের উদ্বেগের অন্য এক বড় কারণ ‘অদৃশ্য শক্তি’র অপতৎপরতা, যে বিষয়ে জানিয়েছেন শিল্পমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নেয়ার পর সাংবাদিকদের কাছে মন্ত্রী বলেছেন, আশুলিয়ায় শ্রমিকরা যে আন্দোলন চালাচ্ছে তার পেছনে রয়েছে এক ‘অদৃশ্য শক্তি’র ইন্ধন। মন্ত্রী এই ‘অদৃশ্য শক্তি’ হিসেবে তৎপর লোকজনকে চিহ্নিত করে খুঁজে বের করার এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। আমরা শিল্পমন্ত্রীর এই ঘোষণাকে স্বাগত জানাই এবং মনে করি, বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থেই তাদের বিরুদ্ধে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। একই সাথে সরকারের উচিত এমন সুদূরপ্রসারী পকিল্পনার ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয়া, যাতে কোনো গার্মেন্ট কারখানাই বন্ধ না হয় এবং এবারের ৫৫টিসহ বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানাগুলো যাতে আবারও চালু হতে ও নতুন করে উৎপাদনে যেতে পারে। রফতানি আয়সহ জাতীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেয়ার স্বার্থেই গার্মেন্টের ব্যাপারে যথাযথ গুরুত্ব দেয়া দরকার। কারণ, বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দ্বিতীয় প্রধান খাত রেমিট্যান্স এরই মধ্যে প্রবল প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছে। রেমিট্যান্স কমেছেও আশঙ্কাজনক হারে। তাছাড়া বাংলাদেশীদের জন্য অনেক দেশেই চাকরির বাজার বন্ধ হয়ে গেছে।
এমন অবস্থায় গার্মেন্টই পারে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রে প্রধান খাতের অবদান রাখতে। এজন্যই গার্মেন্টের ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া দরকার সময় নষ্ট না করে। আমরা আশা করি, সরকার আশুলিয়ার বিষয়টিকে যথোচিত গুরুত্ব দেবে। প্রবল প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়ে পড়া মালিকদের পক্ষে কতদূর পর্যন্ত দাবি পূরণ করা সম্ভব সে কথাটা শ্রমিকদেরও বুঝতে হবে।
ষ লেখক : যুগ্ম মহাসচিব, কেন্দ্রীয় কমিটি লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন