বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

অভ্যন্তরীণ

লবণসহিষ্ণু গম চাষে সাফল্য

মো. জাকির হোসেন, পটুয়াখালী থেকে | প্রকাশের সময় : ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

অতিমাত্রার লবনাক্তার কারণে পতিত থাকা জমিতে লবনসহিষ্ণু জাতের গম চাষ করে সাফল্য পেয়েছেন পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার দৌলতপুর গ্রামে কৃষকরা। নাম মাত্র খরচে গমের আবাদ করে তারা লাভবান হওয়ার পাশাপাশি গম আবাদের মাধ্যমে গমের আমদানী নির্ভরতা কমিয়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়েও ভূমিকা পালন করছে।
পটুয়াখালী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী পটুয়াখালী জেলায় শুকনো মৌসুমে প্রায় ৩০ হাজার হেক্টর কৃষি জমি লবনাক্ততার কারণে বছরের অধিকাংশ সময় পতিত থাকে যার বেশিরভাগই কলাপাড়া উপজেলায়। আর দেশের উপকূলীয় এলাকায় এ ধরনের পতিত জমির পরিমাণ প্রায় এক লাখ হেক্টর।
বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেসা কলাপাড়া উপজেলার আবাদি জমিতে লবনাক্ততার পরিমান খুব বেশি হওয়ায় শুধুমাত্র আমন ধান আবাদ করতে পারেন এখানকার কৃষকরা। ডিসেম্বরে আমন ধান কাটার পর শুকনো মৌসুমে জমিতে লবনাক্ততার পরিমাণ এতটাই বেড়ে যায় এসব জমিতে আর কোন ফসল ফলানো যায়না। বর্ষা এলেই আবার আমন ধান চাষাবাদ করেন তারা। ফলে এখানকার কৃষি জমি বছরের প্রায় ৮ মাসই পতিত থাকে।
এ ধরনের পতিত জমি আবাদের আওতায় আনতে অস্ট্রেলিয়ার এসিআইএআর (অস্ট্রেলিয়া সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল রিসার্চ) প্রকল্পের সহায়তায় বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট‘র যৌথ উদ্যোগে এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন কেজিএফ)‘র অর্থায়নে ইউনিভার্সিটি অব ওয়ের্স্টান অস্ট্রেলিয়া, সিএসআইআরও, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ গম ও ভূট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় একটি যৌথ প্রকল্পের আওতায় গত ২০১৭ সন থেকে গবেষণা করে আসছে। এ গবেষণার অধীনে কলাপাড়া উপজেলার পূর্ব দৌলতপুর ও উত্তর দৌলতপুর গ্রামে দু‘টি প্রথক প্রদর্শনীতে মোট ২৮ জন কৃষক গম চাষ করে সাফল্য পেয়েছেন। এদের সাফল্য দেখে চলতি বছর ওই দু‘গ্রামের ৫০ জন কৃষক গম আবাদ করেছেন।
পরীক্ষামূলকভাবে পূর্ব দৌলতপুর গ্রামে বিনা চাষে গমের আবাদ করছেন ১১ কৃষক। প্রত্যেকে ১ বিঘা জমিতে আমন ধান ওঠার আগেই জমি কিছুটা ভেজা থাকা অবস্থায় গম বীজ ছিটিয়ে দেন। এতে জমিতে লবনাক্ততার পরিমান বৃদ্ধির আগেই গম গাছ বেড়ে ওঠে এবং এতে ২/১ বার সেচ দিলেই ৯০ থেকে ৯৫ দিনের মধ্যে গম তোলা যায়।
গম চাষি আব্দুল খালেক বলেন, জমিতে বছরে একটি মাত্র ফসল আমন ধান আবাদ সম্ভব। শুকনোকালে জমিতে মাত্রাতিরিক্ত লবনাক্ততার কারণে আর কোন ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হয় না। তবে গম আবাদের প্রকল্পের লোকজন আমাদের বিনা চাষে গম উৎপাদনের পদ্ধতি হাত-কলমে শিখিয়ে দিলে গত বছর ১ বিঘা জমিতে গম আবাদ শুরু করি। এক বিঘা জমিতে প্রায় ৮ মণ গম পেয়েছি। নাম মাত্র খরচে পতিত জমিতে গম উৎপাদন করতে পেরে আমি খুশি।
এদিকে, উত্তর দৌলতপুর গ্রামে এ প্রকল্পের আওতায় বিএডব্লিউ-১১৪৭ ও বিএডব্লিউ-১২৯০ লবণাক্ততা সহিষ্ণু দু‘টিজাতের গমের বীজ উৎপাদন করে জমিতে আবাদ করা হয়েছে। এখানে ১৭ জন কৃষক প্রত্যেকে এক বিঘা করে জমিতে গমের আবাদ করছেন।
এখানে গম করে সকলেই সাফল্য পেয়েছেন। এদের একজন আমিনুল ইসলাম জানান, আমি গত বছর গম আবাদ করে সাফল্য পেয়েছি। এবছরও আমি প্রকল্পের প্রদর্শণী প্লটে ১ বিঘা জমিতে এবং প্রকল্পের বাইরে আরও ৩ বিঘা জমিতে গম আবাদ করেছি। পতিত জমিতে গম উৎপাদন করে আমরা এখন লাভবান।
অপর কৃষক নুরু জানান, এ এলাকায় আগে কখনও গমের আবাদ হয়নি। পতিত জমিতে গমের আবাদের আমাদের সাফল্য দেখে এ এলাকার আরও ৫০ জন কৃষক গম আবাদ শুরু করেছেন এবং ভবিষ্যতে সকল কৃষকই গম আবাদে এগিয়ে আসার আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার ডেপুটি প্রজেক্ট লিডার ড. মৃন্ময় গুহ নিয়োগী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের উপকূলীয় এলাকায় জমির লবণাক্ততা দিন দিন বাড়ছে। ফলে শুস্ক মৌসুমে এক লক্ষ হেক্টরেরও বেশি জমি পতিত থাকছে।
প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ গম ও ভূট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং অস্ট্রেলিয়ার সিএসআইআরও যৌথভাবে গম ফসলের জাত এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবনে গত ৫ বছর ধরে কাজ করছে। উক্ত প্রকল্পের আওতায় প্রথম দুই বছরের গবেষণা থেকে বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত দু‘টি জাতের গম বিএডব্লিউ-১১৪৭ ও বিএডব্লিউ-১২৯০কে লবণাক্ততা সহিষ্ণু জেনোটাইপ হিসবে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক অবমুক্তির জন্য মূল্যায়ন করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, দক্ষিনাঞ্চলের তিনটি জেলা পটুয়াখালী, খুলনা, সাতক্ষীরায় এ ফসলের প্রদর্শনী স্থাপন করা হয়েছে যার মাধ্যমে উপকূল অঞ্চলে আমন ধান কাঁটার পর বিস্তীর্ন পতিত জমিতে চাষাবাদ করে শুস্ক মৌসুমে কৃষকরা একটি অতিরিক্ত ফসল ঘরে তুলতে পারবে।
প্রকল্পে গম গবেষনায় নিয়োজিত অষ্ট্রেলিয়ার প্রখ্যাত গম বিজ্ঞানী ড. রিচার্ড জেমস বলেন, লবনাক্ত জমিতে গম আবাদের তিনটি জেলায় লবণাক্ত জমিতে গবেষণার কাজ করা হয়েছে এবং উদ্ভাবিত গমের জাত লবণাক্ত সহিষ্ণুজীন সমৃদ্ধ।
বাংলাদেশ গম ও ভূট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. গোলাম ফারুক বলেন, বাংলাদেশের মানুষের আটার রুটি খাওয়ার প্রবনতা বাড়ছে, যা ভালো। প্রতি বছর বাংলাদেশ ৪০ লক্ষ টন গম আমদানী করে থাকে। এভাবে উপকূল অঞ্চলের পতিত জমিতে গম চাষাবাদ করলে গম আমদানীর উপর নির্ভরতা কমবে। আরো অধিক লবণাক্ত সহিষ্ণু গমের এই প্রযুক্তি উপকূলের বিস্তীর্ন লবণাক্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। এভাবেই আমরা অনায়াসে আরো অধিক লবণাক্ততা সহিষ্ণু গমের জাত ব্যবহার করে উপকূল অঞ্চলের বিস্তীর্ন পতিত জমিতে আমন ধানের পর একই জমিতে শুস্ক মৌসুমে গম ফসল আবাদ করে লাভবান হতে পারি এবং দেশকে দারিদ্রমুক্ত করতে পারি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন