রোববার, ২৬ মে ২০২৪, ১২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৭ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

অভ্যন্তরীণ

দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকার শীতবস্ত্র

ক্রেতা-বিক্রেতাদের পদচারণায় মুখর নয়ারহাট

| প্রকাশের সময় : ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

গোবিন্দগঞ্জ (গাইবান্ধা) উপজেলা সংবাদদাতা : গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের কোচাশহর হোসিয়ারী পল্লীর শ্রমিকদের দম ফেলার ফুসরৎ নেই; শীতকে সামনে রেখে দেশের সর্বমোট চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ শীতবস্ত্র উৎপাদনকারী এ এলাকার ব্যবসায়ীরা নয়ারহাটে প্রতিদিন বিক্রি করছে কোটি কোটি টাকার শীতবস্ত্র। চলতি শীত মৌসুমে এখানে উৎপাদিত শীতবস্ত্রের বেচা বিক্রি ৪/৫শ’ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। ইতোমধ্যে দেশের প্রায় সকল এলাকা থেকে আসা শত শত ছোট-বড় ব্যবসায়ী এখান থেকে কিনতে শুরু করেছেন সকল বয়সী মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন প্রকারের শীতবস্ত্র। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলা এ শীতবস্ত্রের হাটে পাইকারী ব্যবসায়ীরা কেনাকাটা করে ট্রাক-বাস-পিকআপ-ট্রেনসহ বিভিন্ন যানবাহনযোগে এসব মালামাল নিয়ে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। সরকারি সহায়তা ছাড়াই স্বউদ্যোগে গড়ে ওঠা কুটির শিল্পাঞ্চলের প্রধান বিপণনকেন্দ্র এ বাজারটির অবস্থান গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কোচাশহর ইউনিয়নের পেপুলিয়া গ্রামের নয়ারহাট। নয়া মিয়া সরকার নামের একজন উদ্যোক্তার ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে ওঠা ছোট্ট বাজারটি এখন সারা দেশে পরিচিতি লাভ করেছে শীতবস্ত্রের পাইকারি বাজার হিসেবে। স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, পাকিস্তান শাসনামলের প্রথম পর্যায়ে এই পেপুলিয়া গ্রামের এক যুবকের হাত ধরে এখানে সূত্রপাত হয় হোসিয়ারী শিল্পের। মোজা তৈরির ছোট্ট দুটি হাত মেশিনের সূত্র ধরে এখানকার মানুষ পথ দেখেন শুধু কৃষিজমিতে ফসল ফলানো, মাছ ধরা বা কুলি-মজুরের কাজ নয়Ñ অন্য ধরনের কাজ বা ব্যবসা করেও জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি অনেক বড় কিছু করার। গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে পূর্বদিকে কোচাশহর ইউনিয়নের ছোট্ট একটি গ্রাম পেপুলিয়া। এ গ্রামেরই এক যুবক আব্দুর রহিম ভাগ্যান্বেষণে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঢাকায় গিয়ে এক মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীর মোজা কারখানায় কাজ করেন। ব্রিটিশ শাসনামলের শেষপর্যায়ে দেশ ভাগের কারণে ওই মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী ভারতে চলে যাওয়ার সময়ে আব্দুর রহিমকে দান করে যান দুটি মোজা তৈরির ছোট্ট হাত মেশিন (হ্যান্ড লুম) আর সামান্য কিছু সুতো। এ নিয়েই বাড়ি ফিরে মোজা তৈরি করে বিভিন্ন হাট-বাজারে বিক্রি শুরু করেন তিনি। ধীরে ধীরে প্রসার ঘটে তার এ ব্যবসার। উন্নয়ন ঘটে তার ভাগ্যের। এখানে কাজ শিখে নিজেরাও মেশিন কিনে মোজা তৈরি এবং বিক্রি শুরু করেন এখানকার আরো অনেকে। পাকিস্তান আমলেই এ জনপদ পরিচিতি পায় কুটির শিল্পের এলাকা হিসেবে। তখন কেবল সুতি সুতোয় হাত মেশিনে বোনা হাত ও পায়ের মোজা শীতকালে আশপাশের হাট-বাজারগুলোতে বিক্রি করতেন এখানকার ব্যবসায়ীরা। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে পার্শ্ববর্তী ভারত থেকে উন্নত মেশিন ও উলেন সুতা আমদানি সহজ হলে এখানকার উদ্যোক্তারা শুরু করেন মোজার পাশাপাশি মাফলার, সুয়েটারসহ কয়েকটি আইটেমের শীতবস্ত্র তৈরির কাজ। কালক্রমে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এখানে উৎপাদন হতে থাকে সর্বাধুনিক ডিজাইনের বিভিন্ন প্রকার শীতবস্ত্র। বর্তমানে দেশের চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ শীতবস্ত্রের যোগান দেন কোচাশহরের নয়ারহাটকেন্দ্রিক ক্ষুদ্র কুটিরশিল্প মালিক ও ব্যবসায়ীরা। কোচাশহর ইউনিয়নের পেপুলিয়া, বনগ্রাম, কানাইপাড়া, ধারাইকান্দি, রতনপুর, শক্তিপুর, ছয়ঘরিয়া, আরজী শাহাপুর গ্রামসহ পার্শ্ববর্তী চারদিকের অর্ধশতাধিক গ্রামে এ শিল্পের বিস্তার লাভ করেছে। গড়ে ওঠা এসব কারখানায় বছরে প্রায় আড়াই থেকে তিনশ’ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকার শীতবস্ত্র উৎপাদিত হচ্ছে। বর্তমানে কোচাশহর, গোবিন্দগঞ্জ, ধারাইকান্দি, রতনপুরসহ আশপাশের বেশ কিছু এলাকায় এখানকার উৎপাদিত শীতবস্ত্র বিক্রির বেশ কয়েকটি ছোট ছোট মোকাম স্থাপিত হলেও কেবলমাত্র নয়ারহাটেই এখন প্রতিদিন গড়ে এক থেকে দেড় কোটি টাকার শীতবস্ত্র বিক্রি হচ্ছে। প্রতিনিয়তই অত্যাধুনিক ডিজাইনের সকল প্রকার শীতবস্ত্র তৈরিতে অগ্রগামী ভূমিকা রাখছেন এখানকার কুটির শিল্পীরা। প্রয়োজনীয় মেশিন ও যন্ত্রাংশও তৈরি করছেন স্থানীয় কারিগররা। এখানে স্থাপিত বেশকিছু লেদ কারখানায় বিদেশ থেকে আমদানি করা মেশিনের অনুরূপ মেশিন ও যন্ত্রাংশ তৈরি করে অনেক কমদামে সরবরাহ করা হয়। দেশে তৈরি সুতা ছাড়াও বর্তমানে এখানকার একাধিক ব্যবসায়ী এলসির মাধমে ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে সরাসরি সুতা, নিটিং মেশিন ও প্রয়োজনীয় খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানি করে থাকে। সরেজমিনে ওই হাটে গিয়ে দেখা যায়, ছোট-বড় শতাধিক দোকানে এখন চলছে পুরোদমে বেচাকেনা। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা পাইকাররা ঘুরে ঘুরে কিনছেন তাদের প্রয়োজনীয় নানা প্রকারের শীতবস্ত্র। রাজশাহীর গোদাগাড়ির এক ব্যবসায়ী জানান, কমদামে উন্নতমানের শীতবস্ত্র কিনতে তিনি প্রতি বছরই এখানে আসেন। কথা হলো সিলেট ও ফরিদপুর থেকে আসা কয়েকজন ব্যবসায়ীর সাথেও। তারা জানালেন, তারাও এখান থেকে প্রতি বছর শীতবস্ত্র কিনে নিয়ে যান। এখানে টাকা পয়সা নিয়ে নিরাপদে চলাচলে কোনো সমস্যা হয় না। তবে নয়ারহাট হোসিয়ারি শিল্প মালিকরা অভিযোগ করেন, বিদ্যুৎ বিভ্রাটসহ ভাঙাচোরা রাস্তার কারণে পণ্য উৎপাদন ও বিপণনে ভোগান্তি পোহাতে হয় তাদের। কারণ বিদ্যুৎ না থাকলে পাওয়ার লুমগুলো বন্ধ থাকে আর ভাঙা রাস্তার কারণে বড় গাড়ি যাতায়াত করতে পারে না। নয়ারহাটের ব্যবসায়ীরা জানালেন, এখানে কোনো ব্যাংক না থাকায় ব্যাংকিং সেবাবঞ্চিত উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী ও ক্ষুদ্র মালিকরা বিভিন্ন এনজিও এবং দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছেন। তারা আরো জানান, সারা বছর ধরে উৎপাদিত শীতবস্ত্র অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই বিক্রি হয়ে যায়। কোচাশহরের মানুষের স্বউদ্যোগে গড়ে তোলা কুটির শিল্পকে সরকারি স্বীকৃতির পাশাপাশি অবিলম্বে এখানকার প্রয়োজনীয় সমস্যাগুলো সমাধানে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন কোচাশহর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ম-ল।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন