শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

তুলায় নতুন সম্ভাবনা উত্তরে

মহসিন রাজু, রংপুর থেকে ফিরে | প্রকাশের সময় : ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০৫ এএম

ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক ধরে রংপুর মহানগরীর ঠিক প্রবেশমুখে মাহিগঞ্জে মহাসড়কের ডানদিকে রয়েছে দেশের ৫টি তুলা গবেষণা কেন্দ্রের একটি। ফেব্রæয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে এ গবেষণা কেন্দ্রে প্রবেশ করতেই মনে হল যেন সাদা তুলার এক রাজ্য। সমান তিন সাড়ে তিন ফিট উচ্চতার তুলা গাছে ফোটা পেঁজা পেঁজা সাদা তুলার সমাহার ও সৌন্দর্য্য সত্যই অতুলনীয়।

গবেষণা কেন্দ্রটিতে প্রবেশ করতেই জানতে চাওয়া হল আপনি কে? পরিচয় দেওয়ার পর তুলা উন্নয়ন কর্মকর্তা সেলিনা সুলতানা বললেন, আপাতত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কেউতো এখন নেই। তারপর সাংবাদিক হিসেবে এখানে আসার কারণ ও উদ্দেশ্য জানানোর পর তিনি মোবাইল ফোনে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে কথা বলে কেন্দ্রটি ঘুরিয়ে দেখালেন। তুলতে দিলেন ছবি।

তুলা ও তুলা চাষ সম্পর্কে জানালেন বেশকিছু চমকপ্রদ তথ্য। তার কাছ থেকে জানা গেল, গত ৭ বছরে তুলা চাষে বেশকিছু সফল গবেষণার পর অর্থকরি এ ফসলটির চাষের মেয়াদকাল কমে এসেছে। আগে যেখানে তুলা রোপণের পর উত্তোলন করতে সময় লাগতো ৮ মাস, এখন সেটা কমে ৫ মাসে এসেছে। তুলা চাষিদের এই বিষয়টা আকৃষ্ট করেছে। ফলে বৃহত্তর রংপুর ও রাজশাহী অঞ্চলে বিশেষ করে বরেন্দ্রভ‚মির মতো উচ্চ এলাকায় বাড়ছে অর্থকরি ফসল তুলার চাষ।

তিনি আরো জানালেন, বেক্সিমকো, স্কয়ারসহ বেশকিছু দেশীয় টেক্সটাইল প্রতিষ্ঠান এখন দেশে উৎপাদিত তুলার সুতা ব্যবহার করছে।
তিনি আরো জানান, বিঘাপ্রতি জমিতে তুলা চাষ করে গড়ে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা শুধু তুলা বিক্রি করে লাভ করতে পারছেন কৃষকরা। অন্যদিকে আলাভাবে তুলা বীজ, তুলা বীজ থেকে সরিষার মত ভোজ্যতেল ও খৈল উৎপাদন করে বিক্রি করতে পারছেন। জ্বালানি হিসেবে বিক্রি হচ্ছে তুলার গাছ। তিনি আরো বললেন, ভারতে নাকি তুলা গাছের শক্ত পোক্ত ডাল ও কাÐ থেকে পরিবেশবান্ধব বোতাম তৈরি হচ্ছে।
রংপুর তুলা উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, দেশের পার্বত্য অঞ্চল এবং উত্তরের বরেন্দ্র অঞ্চলের অনাবাদি জমিকে তুলা চাষের ক্ষেতে পরিণত করার চেষ্টা অনেকটাই সফল হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির কর্তাদের মতে, বৃহত্তর রংপুর/ রাজশাহীর কৃষি অর্থনীতির নতুন সম্ভাবনা হতে যাচ্ছে তুলা। তারা জানান, রংপুর বিভাগে রংপুর ও ঠাকুরগাঁও এবং রাজশাহী বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া ও নওগাঁর কিছু অঞ্চলে অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছে তুলার চাষ। এসব অঞ্চলে ফি বছর বাড়ছে তুলার চাষ।

কৃষি তথ্য সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, দেশে এখন ৩৯২টি স্পিনিং মিল সুতা উৎপাদন কাজে নিয়োজিত রয়েছে। এসব মিলের বার্ষিক তুলার চাহিদা ৪৫ লাখ বেল। দেশে গড়ে বর্তমানে ১ দশমিক ৬১ লাখ বেল (১ বেল = ১৮২ কেজি) তুলা উৎপাদন হচ্ছে। বার্ষিক চাহিদার মাত্র ৩ দশমিক ৬১ শতাংশ চাহিদা মেটাতে পারছে দেশের উৎপাদিত তুল।

তবে আশার কথা, গত ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে সারাদেশে তুলার চাষ হয়েছে গড়ে ১ লাখ হেক্টর জমিতে। সূত্র মতে, অনিবার্য বাস্তবতার কারণেই তুলার আবাদ বাড়বে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সাল নাগাদ দেশে তুলার চাষ উৎপাদন ৫ গুণ বাড়বে।

১৯৭২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত আগ্রহে প্রতিষ্ঠিত হয় তুলা উন্নয়ন বোর্ড বলে জানান বর্তমান নির্বাহী পরিচালক ড. মোহাম্মদ ফখরে আলম ইবনে তাবিদ। তিনি জানান, বর্তমান সময়ে এসে বোঝা যাচ্ছে, রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে কতটা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন বঙ্গবন্ধু। এ মুহূর্তে বাংলাদেশকে বছরে গড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হয় তুলার বার্ষিক চাহিদা মেটাতে। মূলত প্রতিবেশি ভারত, পাকিস্তান, মধ্য এশিয়া ও মিসরসহ আফ্রিকান কয়েকটি দেশ থেকে তুলা আমদানি করতে হয়। তিনি জানান, সরকার শস্যক্ষেতের জমির বাইরে অথবা তুলা চাষের পর অন্য ফসল করা যায় এমন জমিতে তুলা চাষের বিস্তার ঘটাতে সচেষ্ট। সেজন্যই দেশের ৩ পার্বত্য জেলা এবং উত্তরাঞ্চলের বরেন্দ্রভ‚মিকে তুলা চাষের জন্য উপযুক্ত মনে করা হচ্ছে।
তার মতে, সরকারি উদ্যোগের ফলে আশা করা হচ্ছে আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ দেশে তুলা উৎপাদনের পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ৫ গুণ বৃদ্ধি পাবে যাতে তুলা আমদানি খাতে বিপুল অংকের ডলার সাশ্রয় হবে।

বগুড়া-গাইবান্ধার সংযোগস্থল শিবগঞ্জের বোয়ালমারী গ্রামের প্রান্তিক চাষি বেলাল হোসেন দীর্ঘদিন ধরে ফুল চাষ ও নার্সারীর পাশাপাশি এবার ২২ শতক জমিতে বগুড়া তুলা উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তাদের অনুপ্রেরণায় হাইব্রিড রূপালি জাতের তুলা চাষ করেছেন। গত বছরের আগস্টে চারা রোপণের পর ফেব্রæয়ারিতেই ফসল তুলতে পারবেন বলে আশাবাদী। বর্তমান বাজারদর অনুপাতে তুলা বিক্রি করে ১০/১২ হাজার টাকা লাভ করতে পারবেন বলে ধারণা তার।

রংপুরের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, সাবেক সংসদ সদস্য আনিসুল হক মন্ডল কৃষি অর্থনীতির এ নতুন সম্ভাবনা প্রসঙ্গে জানালেন, এটা মসলিন কাপড়ের দেশ। এদেশে তুলা, সুতা ও বস্ত্রের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। কাজেই তুলা চাষ বৃদ্ধি ও তুলা চাষিদের আর্থিক নিরাপত্তা বিধানে গার্মেন্টস ও স্পিনিং মিল মালিক এবং এনজিওগুলোর বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে। সবাই উদ্যোগী হলে তুলা খাত হতে পারে সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত। বিশেষ করে বৃহত্তর রংপুর তথা উত্তর জনপদের কৃষি অর্থনীতির স্বার্থে ‘ফুড সিকিউরিটি’ নিশ্চিত করে কৃষি মন্ত্রণালয়কে তুলা চাষের বিস্তার ঘটাতে হবে বলে অভিমত তার।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
জাহাঙ্গীর মাহমুদ ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ৬:১৩ এএম says : 0
প্রতিবেদনটি নিঃসন্দেহে শিক্ষা মুলক,তথ্য মুলক ও গবেষণা ধর্মী! অনেক অজানা তথ্য এখানে সন্নিবেশ করা হয়েছে! প্রতিবেদনকারী অবশ্যই প্রসংসার দাবীদার! আমাদের দেশ তুলা চাষে আরো উন্নতি করুক এবং পরনির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠুক এই কামনা করি!
Total Reply(0)
জাহাঙ্গীর মাহমুদ ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ৬:১৩ এএম says : 0
প্রতিবেদনটি নিঃসন্দেহে শিক্ষা মুলক,তথ্য মুলক ও গবেষণা ধর্মী! অনেক অজানা তথ্য এখানে সন্নিবেশ করা হয়েছে! প্রতিবেদনকারী অবশ্যই প্রসংসার দাবীদার! আমাদের দেশ তুলা চাষে আরো উন্নতি করুক এবং পরনির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠুক এই কামনা করি!
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন