শুস্ক মওসুমে নদী তীরবর্তী পাঁচটি উপজেলা অসময়ের ভাঙনে বিড়ম্বনার শিকার নদীকুলের মানুষ। তারা নিঘূম রাত কাটাচ্ছে, হচ্ছে রিক্ত নি:স্ব সর্বশান্ত। যমুনার অব্যাহত ভাঙন আর কতযুগে শেষ হবে তা হলফ করে কেউ বলতে পারেনা। তাই তাদের দু:খ কষ্টের যেন শেষ নাই। প্রশ্ন তাদের দু:খ ঘুচবে কবে?
সত্যি বিচিত্র এই যমুনা নদী, আরো বিচিত্র এর গতি পরিবর্তন। কখন কোথায় ভাঙে, আর কোথায় গড়ে তা বলা দুষ্কর হয়ে পড়েছে। যুগের পর যুগ ধরে প্রমত্তা স্রতস্বনি রাক্ষসি যমুনা অব্যাহত গতিতে ভেঙে চলেছে। কোনো যুগে কোথায় এর সমাপ্তি ঘটবে তার কোন সদুত্তর মেলেনি।
জানা যায়, জেলার সদর উপজেলা, বেলকুচি, চৌহালি, শাহাজাদপুর ও কাজীপুর উপজেলার নদী তীরবর্তীর মানুষ ভাঙনের কবলে পড়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। জেলার চৌহালি উপজেলার এনায়েতপুরে কয়েকযুগ ধরে ভাঙছে নদী, ভাঙছে জনপদ, ভাঙছে হাজারো মানুষের কপাল। এযাবতকাল পনের বিশবার নদীর ভাঙনের কবলে পড়ে হাজারো মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেই ধারা এখনো অব্যাহত গতিতে চলছে।
যমুনা নদীর পথ ভাঙনে আঁকাবাঁকা রেখা সৃষ্টি হয়েছে। কোথাও কম ভেঙেছে, আবার কোথাও বেশি। কিন্তু ভাঙন থেমে নেই। দুপুর-সন্ধ্যা-রাত কিংবা শুষ্ক মৌসুমেও ভাঙন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে এ কূলের মানুষকে। নিশ্চিন্তে ঘুমানোর অবকাশও নেই। রাত জেগে পাহারায় থাকতে হয়, যদি ভাঙনের ভয়াল থাবায় ভিটেমাটি সব কেড়ে নেয়, গোছাতে হয় তল্পি-তল্পা। কিছুতেই যেন এই আতঙ্ক কাটে না তাদের। এমন দৃশ্যপট সিরাজগঞ্জের চৌহালীতে। এযেন মানচিত্র থেকেই হারিয়ে যাচ্ছে উপজেলাটি। তবুও ভাঙন রোধে স্থায়ী কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি এখনও। এখানে যুগ যুগ ধরে এ ভাঙন চলমান। প্রতিনিয়ত স্বপ্ন ভাঙছে কূলের মানুষের কপাল। নদী ভাঙনের ফলে এখন যেন নতুন করে স্বপ্ন দেখতেই ভুলে গেছেন এ এলাকার মানুষ। তবে এসব ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্থদের আক্ষেপ নদী ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড দীর্ঘদিন ধরে প্রকল্প বাস্তবায়নের আশ্বাস দিলেও বাস্তবে নেই কোন উদ্যোগ। প্রচন্ড ক্ষোভ তাই তাদের।
সরেজমিনে জানা যায়, গত দুই সপ্তাহে চৌহালী উপজেলার বাঘুটিয়া ইউনিয়নের বিনানই থেকে চরসলিমাবাদ ভূতের মোড় পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার এলাকায় আবারও শুরু হয়েছে তীব্র ভাঙন। ভাঙনের কবলে হুমকিতে পড়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ, মাদরাসা, বাজার, ৫০টি বসতবাড়ীসহ বিস্তীর্ণ ফসলী জমি। এখন হুমকির মুখে রয়েছে বিনাইন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সম্ভূদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সম্ভূদিয়া বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়, পয়লা বহুমূখী উচ্চ বিদ্যালয়, চৌবারিয়া বিএম কলেজ, বাঘুটিয়া কারিগরি স্কুল এ্যান্ড কলেজসহ প্রায় ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দীর্ঘদিন ধরে এলাকাবাসী সরকারের দৃষ্টি আর্কষণের জন্য মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করলেও দেখা মেলেনি স্থায়ী বাধেঁর।
বাঘুটিয়া ইউনিয়নের বিনানই গ্রামের জসিম উদ্দিন ও জব্বার আলী আক্ষেপ করে এ প্রতিনিধিকে বলেন, অসময় যমুনায় ভাঙন শুরু হয়েছে। কিন্তু ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড তেমন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। গত এক দশকের ও বেশি সময় ধরে তাদের সঠিক পরিকল্পনা না থাকায় অনেক মানুষই ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
চরসলিমাবাদ গ্রামের সানোয়ার হোসেন বলেন, আমার ৬৫ বছর বয়সে পৌষ মাসে নদী ভাঙে কখনো দেখি নাই, এখন ঘর বাড়ি নিয়ে কোথায় যাবো, বুঝতে পারছিনা। আমাদের এলাকা বাঁধ দিয়ে রক্ষা করলে তাও নদীর পাড়ে থাকতে পারতাম।
জালালপুর গ্রামের হালিমুন বেগম জানান, তিনি ৮ বছর আগে স্বামী হারিয়েছেন। তার রেখে যাওয়া একটু জমি ও বসতভিটা ছিল। তাও এ বছর নদীতে ভেঙে গেছে। এখন অন্যের জমিতে ঝুপড়িঘর তুলে বাসবাস করছেন। এখান থেকে কখন যে তুলে দেয় সেই আতঙ্কে দিন কাটছে তার।
একই গ্রামের মকবুল শেখ বলেন, ১৯৮০ সাল থেকে তিনি ভাঙনের মুখে পড়েছেন। বারবার ভাঙনে তাদের সবকিছু নদীতে চলে গেছে। এখন একটু জায়গা আছে তাতে ছেলেমেয়ে নিয়ে বাস করছেন। কিন্তু এটাও ভাঙনের মুখে রয়েছে। বাঁধ নির্মাণ হলে হয়তো ভাঙবেনা। তবে বাঁধ নির্মাণের কথা শুনছি, কাজে বাস্তবায়ন হতে দেখিনা। এলাকায় প্রচলিত আছে যে, যমুনা নদী ভাঙনে যত টাকা এযাৎ ব্যয় হয়েছে সেই পরিমান অর্থ যদি কাঁচা টাকা বা কয়েনে রুপান্তর করে বস্তায় ভরে নদীতে ফেলা হতো তবে নাকি যমুনা নদীই ভরে যেত।
বাঘুটিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম মোল্লা বলেন, এ এলাকায় স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবি দীর্ঘদিনের। তবে সেটি গত বছরে সরকার অনুমোদন দিলেও আলোর মুখ দেখছেনা যমুনা পাড়ের মানুষ।
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী (বেলকুচি-চৌহালী অঞ্চল) মো. মিলটন হোসেন জানান, এনায়েতপুর খাঁজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে শাহজাদপুর উপজেলার পাচিল পর্যন্ত সাড়ে ৬০০ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এটি টেন্ডার শেষে ১৭টি প্যাকেজে ঠিকাদাররা কাজ পেয়েছেন।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এআরসি কনস্ট্রাকশনের ম্যানেজার আকরাম হোসেন জানান, ১১নং প্যাকেজের কাজটি তারা পেয়েছেন। অল্প দিনের মধ্যে ব্লক বানানোর কাজ শুরু করবেন।
এ প্রসঙ্গে সিরাজপগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান জানান, ওই বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের দুটি প্যাকেজের কাজ চলছে। বাকিগুলোর কাজ খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে শুরু হবে।
কিন্তু যমুনা ভাঙন কবলিত এলাকার ভূক্তভোগি মানুষের মন্তব্য- তাদের সমস্যা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরে রয়ে গেছে এবং থাকবে। তাদের দূ:খের যতনিকাপাত কখনই ঘটবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন