বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

আয় সীমিত কষ্ট সীমাহীন

কান পাতলেই শোনা যায় মানুষের আহাজারি, হা হুতাশ

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ৪ মার্চ, ২০২৩, ১২:০১ এএম

চট্টগ্রামে লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিতে দিশেহারা সাধারণ মানুষ : ধারদেনায় চলছে সংসার : টিসিবির ট্রাকের

পেছনে দীর্ঘতর হচ্ছে লাইন
‘দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। বেড়েছে গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দাম, সেই সাথে গাড়ি ভাড়া। নতুন বছরের শুরুতে বেড়েছে বাসা ভাড়া। চাল, ডাল, আটা, চিনি, তেলসহ ভোগ্যপণ্য, ওষুধপত্র, শিক্ষা উপকরণ সবকিছুর দাম অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের আয় তো বাড়েনি। সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সামনে আরো কঠিন সময় আসছে। আমরা কীভাবে বাঁচবো?’ ক্ষোভের সাথে এক নিঃশ^াসে এসব কথা বলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মো. মাহবুবুল আলম।
বললেন, সবকিছুর দাম বাড়ছে। গোশতের দাম বিশেষ করে বয়লার মুরগির দাম রেকর্ড অতিক্রম করেছে। আগে যারা সপ্তাহে অন্তত একটি দিন গোশত খেতেন এখন তারা এটাকে বিলাসিতা মনে করছেন। স্বল্প আয়ের মানুষ সুষম খাদ্যগ্রহণ করার সামর্থ্য হারিয়েছে। মাসের অর্ধেক না যেতে বেতনের টাকা শেষ। ধারদেনা করে চলছে সংসার।
মাহবুবুল আলমের মতো সীমিত ও স্বল্প আয়ের মানুষের সীমাহীন কষ্টে দিন কাটছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিতে দিশেহারা সাধারণ মানুষ। আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় কঠিন সঙ্কটে স্বল্প ও সীমিত আয়ের মানুষ। মধ্যবিত্তরাও সংসার চালাতে রীতিমত হিমশিম খাচ্ছেন। জমানো টাকা ভেঙে খাচ্ছেন অনেকে। অতিথি আপ্যায়ন, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার মতো বিষয় বাদ দিচ্ছেন। বাজেটে কাটছাঁট করেও সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।
শোচনীয় অবস্থা খেটে খাওয়া মানুষের। টিসিবির পণ্য কিনতে মানুষের লাইন দীর্ঘতর হচ্ছে। মুখ লুকিয়ে সেই কাতারে হতদরিদ্রদের সাথে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছেন মধ্যবিত্তদের অনেকে। সর্বত্রই নীরব হাহাকার, বোবা কাঁন্না। এই কঠিন সময়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাতে শুরু মূল্যবৃদ্ধি। বিশ^বাজারে অনেক পণ্যের দাম কমলেও দেশে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির দোহাই দিয়ে আমদানিকৃত ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছিল ডলার সঙ্কটে এলসি খোলা কমে গেছে, তাই ভোগ্যপণ্যের আমদানি কম। তবে চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টম হাউসের তথ্য বলছে, গত কয়েক মাসে দেশে চাহিদার চেয়ে বেশি ভোজ্য তেল, চিনি, ডাল, পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। অথচ বাজারে এসব পণ্যের দাম কমছে না।
আবার আমদানি করতে হয় না এমন পণ্যের দামও আকাশ ছোঁয়া। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর মাছ ধরার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার অজুহাতে মাছের দাম বাড়ানো হয়। মাছ ও মুরগির খাবারের দাম বৃদ্ধি আর গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে বাড়ানো হয়েছে মুরগি ও ডিমের দাম। দেশে ব্যাপক হারে পেঁয়াজের চাষ হয়েছে। প্রতিদিন ভারত থেকে স্থলবন্দর দিয়ে ট্রাকে ট্রাকে পেঁয়াজ আসছে। তবুও বাজারে দাম কমছে না।
চাল আর আটার দাম সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। আমনের বাম্পার ফলনেও চালের দাম নিম্নমুখী হয়নি। গরু, খাসির দাম অনেক আগ থেকে চড়া। শীতের সবজিতে কিছুটা স্বস্তি থাকলেও গরম পড়তেই সবজির বাজার গরম হয়ে উঠছে। শীতের সবজি শেষে বাজারে আসতে শুরু করেছে গ্রীস্মকালীণ সবজি। গ্রীস্মের খরতাপ শুরু না হলেও সবজির বাজারে এখন দারুণ উত্তাপ। একশ টাকায় ঢেঁড়স আর ৮০ টাকায় বরবটি বিক্রি হচ্ছে। পবিত্র শবেবরাতকে ঘিরে ভোগ্যপণ্যসহ জিনিস পত্রের দাম আরো এক দফা বাড়িয়েছে। চিনির আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে। আরো কিছু ভোগ্যপণ্যের আমদানিতে শুল্ক ও করখাতে ছাড় দেয়া হয়েছে। তবে বাজার মনিটরিং না থাকায় এর সুফল পাচ্ছে না ভোক্তারা। সরকারের বাজার তদারকি কিছু সভা আর রুটিন অভিযান ও জরিমানার মধ্যে সীমিত রয়েছে।
সাধারণ মানুষের অভিযোগ বাজার নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি ব্যর্থ সরকার। কেউ কেউ মনে করেন সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ এসব বিষয়ে নির্বিকার। সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা আগেভাগেই বলে দেন দেশে দুর্ভিক্ষ হবে। দুর্ভিক্ষ আর দুর্ভোগের আগাম ঘোষণা দিয়ে মূলত তারা অসাধু ব্যবসায়ী চক্রকে মূল্য কারসাজিরই সুযোগ করে দেন। আর তার খেসারত দিতে হয় সাধারণ মানুষকে। এ নিয়ে মানুষের মাঝে ক্ষোভ অসন্তোষ বিরাজ করছে। কান পাতলেই শোনা যায় মানুষের আহাজারি, হা হুতাশ।
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই মহানগরীতে প্রায় পৌনে এক কোটি মানুষের বসবাস। তাদের বিরাট একটা অংশ স্বল্প ও সীমিত আয়ের। আছে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী ও কর্মজীবীরা। লাখো ছিন্নমূল মানুষের বসতি এই নগরীতে। অর্থনৈতিক মন্দায় সব শ্রেণির মানুষ বিপাকে পড়েছে। বৈশি^ক অর্থনৈতিক মন্দা ও দেশে ডলার সঙ্কটের কারণে আমদানি-রফতানি কমে গেছে। চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ বিশেষ করে কন্টেইনার জাহাজ আসার হার কমেছে। তাতে বন্দর কেন্দ্রীক অর্থনৈতিক কর্মকাÐ ঝিমিয়ে পড়েছে। পরিবহন, সিএন্ডএফ এজেন্টস, বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোসহ আমদানি-রফতানি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাজ কমে গেছে, কমেছে আয়ও।
টান পড়েছে এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের আয় রোজগারে। শতভাগ তৈরি পোশাক খাত কঠিন সঙ্কটে। রফতানি অর্ডার না থাকায় বেশির ভাগ কারখানায় উৎপাদনের চাকা থমকে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে বেশ কয়েকটি কারখানা। নীরবে চলছে শ্রমিক ছাঁটাই। অনেকে কারখানায় বেতন-ভাতা বকেয়া পড়েছে। দেশের সবচেয়ে বড় চট্টগ্রাম ইপিজেড, কর্ণফুলী ইপিজেডের কারখানাগুলোতেও উৎপাদন কমেছে। আগে যেখানে ছুটির দিনেও কারখানা খোলা রাখা হতো এখন সেখানে নির্ধারিত সময়ের আগেই ছুটি দিতে হচ্ছে। বন্ধ শ্রমিকদের ওভার টাইমও। তাতে কমে গেছে শ্রমিকদের আয়।
ডলার সঙ্কটে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে। তাতে কলকারখানায় উৎপাদন কমে গেছে। আয় কমেছে শ্রমিকদের। নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় নির্মাণ ও উন্নয়ন কাজে ভাটা পড়েছে। এর সাথে জড়িত শ্রমিকরা কাজ পাচ্ছে না। খেটে খাওয়া এসব মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে কঠিন কষ্টে পড়েছে। ব্যাপক হারে আয় রোজগার কমে গেলেও ব্যয় শুধু বাড়ছে। তাতে দিশেহারা সাধারণ মানুষ।
এদিকে রমজানের আগে শবেবরাতকে সামনে রেখে চট্টগ্রামের বাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম আরো এক দফা বেড়েছে। বর্তমানে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২৩০ টাকায়। অন্যদিকে সোনালি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৩৩০ থেকে ৩৫০ টাকা। মুরগির পাশাপাশি বাজারে অন্যান্য মাছ-গোশতের দামও বাড়তি। হাড়সহ গরুর গোশত ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা। আর হাড়ছাড়া গরুর গোশত ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে ছাগলের গোশত বিক্রি হচ্ছে এক হাজার থেকে এক হাজার ১০০ টাকা কেজিতে। দেশি মুরগি সাড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা।
আকারভেদে তেলাপিয়া ১৮০ থেকে ২৪০, রুই ১৮০ থেকে ২৬০ ও কাতলা ২৩০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ১০৮ থেকে ১১২ টাকায়। দেশি মসুর ডাল ১৩৫-১৪০, মোটা দানার মসুর ডাল ১০০-১১০, মানভেদে ছোলা ৮২ থেকে ৯৫, বোতলজাত সয়াবিন (১ লিটার) ১৮০ থেকে ১৯০, পেঁয়াজ ৩৫-৪০, আকারভেদে রসুন ১১০ থেকে ১৪০, প্যাকেটজাত আটা ৬৫ থেকে ৬৮ ও প্যাকেটজাত ময়দা ৭২ থেকে ৭৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ফুলকপি ও বাঁধাকপি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১৫ থেকে ২০ টাকায়। কাঁচা মরিচ ১১০ থেকে ১২০, শিম ৩৫ থেকে ৪০টাকা। বেগুন ২০ থেকে ২৫, আলু ২০ থেকে ২৫, মিষ্টিকুমড়া ২৫-৩০ ও টমেটো ১৫ থেকে ২৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে শীতের সবজি বিদায় নিতে শুরু করেছে। আসছে গ্রীস্মকালীন শাকসবজি। তবে দাম এখনও সাধারণের নাগালের বাইরে। ##

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন