আইসিসির বর্ষসেরা উদীয়মান : ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আবির্ভাবেই ফেলে দিয়েছেন হৈ চৈ। সে বছরজুড়ে ছিলেন এই বাঁ-হাতি কাটার মাস্টার আলোচনায়। একদিনের ক্রিকেটে মাত্র ৯ ম্যাচে ২৬ উইকেটে আইসিসির বর্ষসেরা ওয়ানডে দলে জায়গা পাওয়া মুস্তাফিজুরের। সে বছর বাংলাদেশ থেকে গুগল সার্চে ছিলেন সবার উপরে। ২০১৬ সালেও বছরজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রে এই ক্রীড়াবিদ। বছরে দুই বার পড়েছেন ইনজুরিতে। শুরুতে এশিয়া কাপ টি-২০তে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচে ইনজুরিতে না পড়লে, কিংবা ইংলিশ কাউন্টি দল সাসেক্সে খেলতে না গেলে বছরের পারফরমেন্স হতে পারতো আরো আলোকিত। ইনজুরি তার প্রত্যাবর্তনে ফেলেনি প্রতিবন্ধকতার দেয়াল। ইনজুরি থেকে পুরোপুরি সেরে ওঠার আগে হাফ ফিট মুস্তাফিজুর প্রত্যাবর্তনেও ছড়িয়েছেন দ্যুতি ! টি-২০ বিশ্বকাপের শুরুতে বাংলাদেশ পায়নি তাকে। সুপার টেনের শেষ অধ্যায়ে মুস্তাফিজুরকে পেয়েই এই বোলারের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ দেখেছে বিশ্ব। কোলকাতার ইডেন গার্ডেনসে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে কাঁটার যাদুর ঝাঁপিটা একটু বেশিই খুলেছিলেন মুস্তাফিজুর। ৪-০-২২-৫ এমন বোলিংয়ে ৫ উইকেটে চারটিই বোল্ড ! ২০১৬ টি-২০ বিশ্বকাপের সেরা বোলিং ফিগারের রেকর্ডেও বাংলাদেশকে এনেছেন আলোচনায়। টি-২০ বিশ্বকাপে সুপার টেনে একটি ম্যাচও জিততে পারেনি বাংলাদেশ, তারপরও আলোচনায় থেকেছে বাংলাদেশের নাম। মাত্র ৩ ম্যাচে ৯ উইকেটÑতাতে টি-২০ বিশ্বকাপ সেরা একাদশে মুস্তাফিজুরকে না রেখে উপায় ছিল না আইসিসির।
আইপিএলে সানরাইজার্স হায়দারাবাদে ১ কোটি ৪০ লাখ রূপীতে বিক্রি হয়ে ফেলে দিয়েছিলেন সাড়া। আইপিএলে সানরাইজার্স হায়দারাবাদের ট্রফি জয়ে রেখেছেন অবদান। ১৭ উইকেট, মিতব্যয়ী বোলিংয়ে আইপিএল সেরা উদীয়মান ক্রিকেটারের পুরস্কারে হয়েছেন ভূষিত। এমন পারফরমেন্সে তাকে যে কোনো মূল্যে অন্তত: একটি ম্যাচের জন্য হলেও পেতে সে কি আবদার ইংল্যান্ডের কাউন্টি দল সাসেক্সের। বিসিবিতে মেইলের পর মেইল করে, মে থেকে প্রতীক্ষা করতে করতে জুলাইয়ে মুস্তাফিজুরকে পেয়ে সে কি খুশি কাউন্টি ক্লাবটি। বিশ্রামহীন ম্যাচে নেমে পড়ে কাউন্টির অভিষেকে ৪ উইকেটেও ফেলে দিয়েছেন হৈ চৈ। এই সাসেক্সে খেলতে যেয়েই বড় মূল্য দিতে হয়েছে মুস্তাফিজুর এবং বাংলাদেশকে। কাঁধের ইনজুরিতে পড়ে করাতে হয়েছে অস্ত্রোপচারের। লন্ডনের বুপা ক্রমওয়েল হাসপাতালে কাঁধের টেলিস্কোপ সার্জারির পর পাঁচ মাস ছিলেন মাঠের বাইরে। এই সময়েও মুস্তাফিজুর ছিলেন আলোচনায়। পুর্নবাসন ক্যাম্প ঠিক ঠাক মতো চলছে তো, মুস্তাফিজ বল গ্রিপ করতে কি পেরেছেন, ক’স্টেপে নিচ্ছেন রান আপ, সামর্থের কতোটা পারছেন দিতে । পাঠক, দর্শক, সমর্থক, ভক্তদের এসব কৌতূহল মেটাতে হয়েছে মিডিয়াকে ! যে ছেলেটি বছরের প্রথম পাঁচ মাস আলোচনার কেন্দ্রে, ক্রিকেটের বাইরে থেকেও আলোচনায় যিনি, তিনি প্রাপ্য স্বীকৃতি পেয়েছেন আইসিসির তরফ থেকে। ২০১৫ সালে আইসিসির বর্ষসেরা ক্যাটাগরিতে সেরা উদীয়মানে তাকে ভূষিত না করে বড় অন্যায় করা হয়েছে, সেই অপরাধবোধে ২০১৬ সালে আইসিসি’র বর্ষসেরা উদীয়মান ক্রিকেটারের পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথম কোনো ক্রিকেটার হিসেবে আইসিসির সেরার স্বীকৃতি পেলেন মুস্তাফিজুর। ২০১৫ সালে ওয়ানডের বর্ষসেরা দলে পেয়েছেন জায়গা, ২০১৬ সালে টি-২০ বিশ্বকাপ সেরা একাদশ এবং আইপিএল সেরা একাদশে ঠাঁই পাওয়া মুস্তাফিজুরের হাত ধরেই পেলো বাংলাদেশ প্রথম কোনো আইসিসির বর্ষসেরার স্বীকৃতি।
টেস্টে মেহেদী উৎসব
অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ নিয়ে শুরু থেকে কম স্বপ্ন দেখেনি বাংলাদেশ। ২০০৬ সালে সাকিব, তামীম, মুশফিকরা পারেনি বাংলাদেশকে সেমিফাইনালে তুলতে। ২০০৪ ঘরের মাঠে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে আশরাফুল, আফতাব, নাফিস ইকবালরা কাপ পর্বের দেখাই পাননি। পূর্বসূরীদের এই আক্ষেপ ঘুঁচেছে মিরাজময় আসরে। বছরের শুরুতে আলোচনা জমিয়ে দিয়েছেন মেহেদী হাসান মিরাজ। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ দলকে নেতৃত্ব দিয়ে নিজের অল রাউন্ড পারফরমেন্সে ( ২৪২ রানও ১২ উইকেট) দলকে তুলেছেন প্রথমবারের মতো সেমিফাইনালে। যুব বিশ্বকাপ সেরা ক্রিকেটারের পুরস্কারে হয়ে আইসিসির কোন আসরে এই প্রথম সেরার স্বীকৃতি তার হাত ধরেই পেয়েছে বাংলাদেশ।
৮ মাস আগে যে ভেন্যু থেকে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে মোস্ট ভেল্যুয়েবল প্লেয়ারের পুরস্কার নিয়েছেন, সেই ভেন্যুতেই অভিষেক টেস্ট সিরিজে সিরিজ সেরার পুরস্কার পেলেন মেহেদী হাসান মিরাজ! মাত্র আট মাসেই যুব ক্রিকেট তারকা থেকে আন্তর্জাতিক তারকা ! ঢাকা টেস্টের পর পর দুই দিনেই নায়ক তিনি। দু’ইনিংসেই প্রথম ব্রেক থ্রু দিয়েছেন, নতুন বলে স্পিন কারিশমা দেখেছে বিশ্ব দ্বিতীয় দিনে। দ্বিতীয় দিন ইংল্যান্ডকে ২৪৪ রানে অল আউটের এই নায়ক ক্যারিয়ারের প্রথম দুই টেস্টে ইনিংসে ৬টি করে উইকেটে (চট্টগ্রাম টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৬/৮০,ঢাকা টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৬/৮২) অন্য উচ্চতায় তুলেছেন নিজেকে। এমন ম্যাজিক বোলিংয়ে টেস্ট ইতিহাসে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে প্রথম দু’ম্যাচের সাফল্যে অন্য উচ্চতায় মিরপুরে। টেস্টে এক ম্যাচে সর্বোচ্চ ১২ উইকেট এতোদিন ছিল শুধুই বাঁহাতি স্পিনার এনামুল জুনিয়রের, ২০০৫ সালে জিম্বাবোয়ের বিপক্ষে ঢাকা টেস্টে (২০০/১২)। উপর্যুপরি তিন ইনিংসে নামতা গুনে ৬টি করে শিকার, দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে ১৮ উইকেটের রেকর্ডটিও এতোদিন ছিল তার। এনামুল জুনিয়রের সেই রেকর্ড টপকে নুতন ইতিহাস রচনা করেছেন মিরাজ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে। ঢাকা টেস্টে ১২ উইকেট (১২/১৫৯), ২ ম্যাচের টেস্ট সিরিজে সর্বাধিক ১৯ উইকেট শিকার তার। টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম ২ ম্যাচে ৩ ইনিংসে ৫টি করে উইকেট আছে ১৩৯ বছরের টেস্ট ইতিহাসে মাত্র ছয় জনের! ১৮৯৩-৯৪ এ ইংল্যান্ডের পেস বোলার টম রিচার্ডসন, ১৯০১ সালে ইংল্যান্ডের সিডনী বার্নস, ১৯২৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার ক্লারি গ্রিমেত, ১৯৭৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার রডনী হগ, ১৯৮৮ সালে ভারতের লেগ স্পিনার নরেন্দ্র হিরওয়ানির পর ২০১৬ সালে এমন অবিশ্বাস্য কৃতিত্ব মেহেদী হাসান মিরাজের। তবে এই ছয় জনের মধ্যে সেরার আসনে হিরওয়ানির পর মিরাজ। ১৯৮৮ সালে টেস্ট অভিষেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে চেনাইয়ে ১৬ উইকেটে ( ৮/৬১ ও ৮/৭৫), বেঙ্গালুরুতে পরের টেস্টে সেখানে (২/৬২ও ৬/৫৯)। ক্যারিয়ারের প্রথম দুই টেস্টে হিরওয়ানির শিকার সংখ্যার সমস্টি ২৪ উইকেট, সেখানে মেহেদীর রঙ ছড়ানো মিরাজের প্রথম ২ টেস্টে শিকার সংখ্যা ১৯টি! এক টেস্টে সর্বকনিষ্ঠ সফল বোলার হিসেবে এখনো সবার উপরে বাংলাদেশের বাঁ-হাতি স্পিনার এনামুল হক জুনিয়র। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২০০৫ সালে ঢাকা টেস্টে ১২ উইকেটের ম্যাচের দিন বয়স ছিল তার ১৮ বছর ৪০ দিন। সবচেয়ে কম বয়সে ২ ইনিংসে ৫টি করে শিকারের তালিকায় পাকিস্তানের ওয়াসিম আকরাম, ভারতের শিবারামাকৃঞ্চাম এবং পাকিস্তানের ওয়াকার ইউনুসের পর ১৯ বছর ৫ দিন বয়সে রেকর্ডটি মেহেদী হাসান মিরাজের। ২ টেস্টের সিরিজে তিন ইনিংসে ৫টি করে শিকারে ১৯ উইকেটে সর্বকনিষ্ঠ বোলার তিনিই। অভিষেক সিরিজেই ইংল্যান্ডের মতো টেস্ট পরাশক্তিকে ঢাকা টেস্টে হারিয়েছে বাংলাদেশ। রাঙিয়ে দিয়েছে শের-ই-বাংলা স্টেডিয়াম মেহেদী রঙে। সিরিজ সেরা পুরস্কারে রচনা করেছেন ইতিহাস এই উদীয়মান অফ স্পিনার।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন