রোববার, ১৯ মে ২০২৪, ০৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

অভ্যন্তরীণ

সীমানাপাড়ার ৭শ’ ফুট উঁচু পাহাড়ে শিক্ষার আলো

দুর্গম পাহাড়ের পথশিশুদের হাতে বই-খাতা

| প্রকাশের সময় : ১ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সৌমিত্র চক্রবর্তী, সীতাকুন্ড (চট্টগ্রাম) থেকে : এখন আর বাবার সাথে পাহাড়ে কাঠ কাটতে যায় না সুমন ত্রিপুরা (৭)। সে এখন নিয়মিত স্কুলে যায়। বাড়ির পাশের অন্য শিশুরাও স্কুলে যাচ্ছে দেখে বাধা দেয় না বাবাও। এতে দারুণ খুশি সে। ধারালো দা-ছুরি, কুড়ালের বদলে এখন বই, খাতাই সুমনের সঙ্গী। প্রতিদিন সকাল ৯টার আগেই সে পৌঁছে যায় তার প্রিয় স্কুল সীমানাপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। শুধু সুমন নয়, সীমানাপাড়া হোসনে আরা-মঞ্জু প্রাথমিক বিদ্যালয়টি স্থাপিত হবার পর বদলে গেছে এই এলাকার বহু শিশু-কিশোরের জীবন চিত্র। নিশ্চিত নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হবার পর মাত্র এক বছরেই এ বাস্তবতা উপলব্ধি করেছেন এলাকার মানুষ। ফলে তাদের মুখে খুশির ঝিলিক ও পরম তৃপ্তির ছোঁয়া। জানা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলার অতি দুর্গম পাহাড়ের একটি গ্রামের নাম সীমানাপাড়া। ভারতের মিজোরাম ও বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এ এলাকায় কোনকালে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত ছিল না। ফলে গ্রামের শিশুরা ছিল শিক্ষাবঞ্চিত। আর স্কুল না থাকায় এই গ্রামের মানুষগুলো ভিন্ন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। সন্তান ভালোভাবে হাঁটাচলা করতে শিখলেই অভিভাবকরা তাকে পাহাড়ে নিয়ে গিয়ে কাঠ কাটা কিংবা জুম চাষ করা শেখাত। ফলে অক্ষরজ্ঞানবিহীন মানুষগুলোর শেষ ভরসা ছিল বন্যজীবন। অবশ্য সীমানাপাড়া গ্রাম থেকে ৮ কি.মি. দূরে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। কিন্তু দুর্গম পাহাড়ের চড়াই উৎরাই পেরিয়ে শিশুদের জন্য সেখানে গিয়ে পড়াশুনা করা মোটেও সহজ নয়। ফলে ভুলেও সে পথ মাড়াতে চাইত না কেউ। এতে সীমানাপাড়া গ্রামের মানুষ শতভাগই ছিল নিরক্ষর। বিষয়টি নিয়ে এতদিন কোন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার মাথাব্যথা না থাকলেও দুর্গম সীমানাপাড়ার মানুষের শিক্ষাবিহীন জীবনের কথা জানতে পেরে দুর্গম ঐ পাহাড়ে একটি বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র আলহাজ্ব মঞ্জুরুল আলম মঞ্জু। তিনি তার পারিবারিক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান মোস্তফা হাকিম ওয়েল ফেয়ার ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ২০১৫ সালে ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে গড়ে তোলেন সীমানাপাড়া হোসনে আরা-মঞ্জুর বিদ্যা নিকেতন নামক প্রাইমারি স্কুল। এই স্কুলটি স্থাপনের পর যেন গ্রামের শিশু, কিশোর-কিশোরীদের মাঝে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসে। এলাকার শিশুরা পাহাড়ে কাঠ কাটা আর জুম চাষ করা ছেড়ে দিয়ে নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছে। এখন ধারালো অস্ত্র ছেড়ে দিয়ে তারা হাতে তুলে নিয়েছে বই-খাতা। দেখতে দেখতে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার এক বছর পূর্ণ হয়েছে। গত ১৯ ডিসেম্বর বিদ্যালয়ের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৭শ’ ফুট উঁচু দুর্গম পাহাড়ের সীমানাপাড়া স্কুল মাঠে আয়োজন করা হয় এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান। এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন খাগড়াছড়ির সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। মোস্তফা-হাকিম ওয়েল ফেয়ার ফাউন্ডেশনের পরিচালক সীতাকু-ের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব দিদারুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন ফাউন্ডেশনের পরিচালক সরোয়ার আলম, মো. ফারুক আজম, মো. সাইফুল আলমসহ অনেকে। এদিন সরেজমিন সীমানাপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঘুরে দেখা গেছে, পাহাড় চূড়ায় ঐ স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের ছোটাছুটি যেন উৎসবের আমেজ নিয়ে এসেছে। কোমলমতি শিশুদের গায়ে গাড় সবুজ রংয়ের স্কুল ড্রেসগুলো নাম না জানা পাহাড়ি ফুলের সোন্দর্য ছড়িয়ে দিয়েছে সবখানে। বিদ্যালয়ের সামনেই কথা হয় স্কুলের বিভিন্ন শ্রেণীর শিক্ষার্থী সুমন ত্রিপুরা, রামবিলাশ ত্রিপুরাসহ কয়েকজনের সাথে। সবাই এক বাক্যে জানাল, এখন আর তারা মা-বাবার সাথে পাহাড়ে কাঠ কাটতে কিংবা জুম চাষ করতে যায় না। পাড়ার অন্য শিশুরা স্কুলে আসে তাই বাবা-মা তাদেরকেও কোন বাধা দেন না। স্কুলে আসতে তাদের খুবই ভালো লাগছে। এ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা দিনা ত্রিপুরা বলেন, সাবেক চট্টগ্রামের মেয়র মঞ্জুরুল আলমের মোস্তফা-হাকিম ওয়েল ফেয়ার ফাউন্ডেশন বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করায় এই গ্রামের মানুষ চিরদিনের জন্য শিক্ষার আলো পেলো। এতদিন এই গ্রামে একজনও শিক্ষিত মানুষ ছিল না। এখন থেকে পর্যায়ক্রমে গ্রামের সবাই শিক্ষিত হবে বলে তিনি মনে করেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বেতন, বই খাতা-কলম থেকে যাবতীয় খরচ মোস্তফা-হাকিম ওয়েল ফেয়ার ফাউন্ডেশন বহন করছে জানিয়ে তিনি আরো বলেন, এই স্কুলে বর্তমানে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হচ্ছে। এখন ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ১২৬ জন। যা ক্রমশ বাড়বে বলে তিনি মনে করেন। খাগড়াছড়ির সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এ বিদ্যালয় প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলেন, যে কাজটি আমার করার কথা কিন্তু আমি করতে পারিনি সে কাজটিই মোস্তফা হাকিম ওয়েল ফেয়ার ফাউন্ডেশন করে দেখিয়ে দিয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগরী থেকে এসে এরকম দুর্গম পাহাড়ে একটি স্কুল করার কথা শুধুমাত্র মঞ্জুরুল আলমের মত মহানুভব মানুষরাই করতে পারেন। এ স্কুল একদিন পুরো দীঘিনালা তথা খাগড়াছড়িতে শিক্ষার আলো ছড়াবে বলে অভিমত প্রকাশ করেন তিনি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোস্তফা হাকিম ওয়েল ফেয়ার ফাউন্ডেশনের পরিচালক সীতাকুন্ডের এমপি আলহাজ্ব দিদারুল আলম বলেন, খাগড়াছড়ির দীঘিনালার দুর্গম ঐ পাহাড়ের মানুষগুলো যেন শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয় শুধুমাত্র সেই আশাতেই এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছি আমরা। ঐ এলাকার মানুষ সুশিক্ষিত হলে, নিরক্ষরতার অন্ধকার দূর হলে তবেই আমাদের স্বপ্ন পূরণ হবে। তিনি বলেন, এ বিদ্যালয় স্থাপনে কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই, আছে শুধু মানসিক তৃপ্তি। এখানে এসে শিশুদের মুখে হাসি দেখে মন ভরে গেছে। এর বেশি আর কি-ই বা চাওয়ার আছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন