মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা কেমন আছে

প্রকাশের সময় : ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মনশী আবদুল মান্নান
পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা কেমন আছে, বহু পুরনো এ প্রশ্নের সহজ উত্তর, একমাত্র উত্তর, ‘ভালো নেই’। সম্প্রতি নোবেল বিজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনও এ কথা স্বীকার করেছেন। কিছুদিন আগে অ্যাসোসিয়েশন ¯œ্যাপ, গাইডেন্স গিল্ড ও প্রতীচী ইনস্টিটিউটের তৈরি ‘পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের জীবনের বাস্তবতা : একটি প্রতিবেদন’ শীর্ষক রিপোর্ট প্রকাশ উপলক্ষে অমর্ত্য সেন বলেছেন, বাঙালি মুসলমানদের যে কতটা বঞ্চনা সহ্য করতে হয়, তা কেবল বহুমাত্রিক পাঠের মাধ্যমেই বোঝা যায়। সাচার কমিটির রিপোর্ট পরোক্ষ সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের ওপর নির্ভর করে তৈরি হয়েছিল। কিন্তু আলোচ্য রিপোর্টটির ভিত্তি প্রত্যক্ষভাবে পাওয়া তথ্য। এ রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে, রাজ্যের দরিদ্র ও বঞ্চিত মানুষের সিংহভাগই মুসলমান। জীবনযাপনের নিরিখে তারা অসামাঞ্জস্যভাবে দরিদ্র ও বঞ্চিততর।
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত ভারতের মুসলমানরা বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানরা বঞ্চনা ও বৈষম্যের নিগড় থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। দারিদ্র্য তাদের ললাট লিখন এবং বঞ্চনা নিত্যসঙ্গী হয়ে আছে। ভারতীয় সংবিধানে জাতি-ধর্ম ও বর্ণ-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সব নাগরিকের সমানাধিকার স্বীকার করা হলেও বাস্তবে মুসলমানরা এই অধিকার থেকে শোচনীয়ভাবে বঞ্চিত। এমনকি দলিত সম্প্রদায়ের চেয়েও তাদের অবস্থা খারাপ। পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। এই বিপুলসংখ্যক মানুষকে দারিদ্র্য ও বঞ্চনার মধ্যে রেখে রাজ্যের কাক্সিক্ষত উন্নতি ও অগ্রগতি আশা করা যায় না। ব্রিটিশ ভারতে এই জনপদটি ভারতের অন্যান্য রাজ্য বা এলাকা থেকে তুলনামূলকভাবে অনেক এগিয়ে ছিল। কিন্তু এখন অনেক রাজ্য থেকে আছে অনেক পিছিয়ে। এর প্রধান কারণ যে নাগরিকদের এই দ্বিতীয় বৃহত্তম অংশকে অবহেলা ও উপেক্ষা করা, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। পশ্চিমবঙ্গে যারাই ক্ষমতাসীন হয়েছেন, তারাই মুসলমানদের ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তাদের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য কার্যকর কোনো উদ্যোগ-পদক্ষেপ নেননি। স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকেছে কংগ্রেস। কংগ্রেস সরকার মুসলমানদের সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য কিছু করেনি। বরং বিষম নীতি অনুসরণ করেছে যাতে মুসলমানরা সর্ব দিক ও পর্যায়ে চরম বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হয়েছে। কংগ্রেসের পর বামপন্থিরা ক্ষমতায় এসেছেন। তারা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকেছেন। কিন্তু পিছিয়ে থাকা মুসলমানদের বস্তুগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং ক্ষমতায়নে তেমন কিছুই করেননি, যদিও মুসলমানদের অব্যাহত সমর্থন ও ভোটে বারবার তারা ক্ষমতায় ফিরে এসেছেন। ক্ষমতায় ফিরিয়ে এনেছে। গত কয়েক বছর ক্ষমতায় আছে তৃণমূল কংগ্রেস। এই তৃণমূল কংগ্রেসের ক্ষমতায় আসার পেছনেও মুসলমানদের ভূমিকাই ছিল মুখ্য। তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা ব্যানার্জি ক্ষমতায় আসার আগে বহুবার এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তৃণমূল ক্ষমতায় এলে মুসলমানদের এতদিনের বঞ্চনা ও বৈষম্যের অবসান ঘটাবেন। কিন্তু বাস্তবে মুসলমানদের অবস্থা যেখানে ছিল এখনো সেখানেই আছে। অমর্ত্য সেনের মন্তব্য ও কথিত রিপোর্ট তারই সাক্ষ্য বহন করে।
রিপোর্টিটির বিস্তারিত বিবরণ আমাদের হাতে নেই। তবে ২০১৪ সালের মাঝামাঝিতে এই রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে ঢাকার একটি দৈনিকে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়, ‘গত তিন বছর পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় তৃণমূল। এরপরও আশানুরূপ উন্নতি হয়নি মুসলিম সম্প্রদায়ের এবং যে তিমিরে মুসলিমরা ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে।’ ওই রিপোর্ট সূত্রে জানা যায়, পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের হাল জানার জন্য কথিত সংস্থাগুলো ১৯টি জেলার মুসলিম অধ্যুষিত ৩১৫টি গ্রাম ও ৭৫টি শহর থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। সমীক্ষক দল ৯৭ হাজারেরও বেশি বাড়িতে গিয়ে বিভিন্ন বয়সের সাড়ে ৪ লাখের বেশি মুসলিম পুরুষ ও নারীর সঙ্গে কথা বলে। সরেজমিন এই পর্যবেক্ষণ ও তথ্যে দেখা যায়, মুসলমানদের মধ্যে নিরক্ষরতার হার ১৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ। ১২ শতাংশের শিক্ষা প্রাথমিক স্তরে সীমাবদ্ধ। ¯œাতক স্তরে পড়ছে মাত্র ৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ। ¯œাতকোত্তর ১ দশমিক ৮৬ শতাংশ। পর্যবেক্ষণ ও তথ্যে আরও দেখা যায়, মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে ২৭ দশমিক ১৩ শতাংশ রাস্তায় পানি জমে থাকে। গ্রামের ১৮ শতাংশ রাস্তা কাঁচা, ৯ শতাংশ রাস্তা পাকা। মাত্র ৩৬ শতাংশ গ্রামে সরকারি নলকূপ রয়েছে। চিকিৎসার জন্য গ্রামের লোকদের যেতে হয় অন্তত ৪ কিলোমিটার দূরের সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রে। ৪৫ শতাংশ গ্রামবাসীকে নির্ভর করতে হয় হাতুড়ে চিকিৎসকদের ওপর। এর বাইরে মুসলমানদের অর্থনৈতিক অবস্থা বিশেষ করে জীবিকা অর্জনের দিকটি আরো করুণ। অধিকাংশ মুসলমান দিন মজুর। তাদের নিশ্চিত কর্মসংস্থান নেই। অন্য রিপোর্ট থেকে জানা যায়। সরকারী চাকরি-বাকরিতে মুসলমানদের অবস্থান ও প্রবেশাধিকার অত্যন্ত সীমিত। সরকারী চাকরিতে ৩/৪ শতাংশের বেশী মুসলমান নেই।
পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের জীবনের বাস্তবতা : একটি প্রতিবেদন, শিরোনামের রিপোর্টটি আরও পূর্ণাঙ্গ ও ব্যাপকভিত্তিক হবে বলেই ধারণা করা যায়। এর আগে এ ধরনের কাজ হয়নি। কয়েক বছর আগে বিচারপতি রাজিন্দর সাচারের নেতৃত্বে ভারতের কয়েকজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী ও পরিসংখ্যানবিদকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক ও শিক্ষাগত অবস্থান নিরূপণ করা। কমিটির তরফে বিভিন্ন রাজ্য থেকে মুসলমানদের অবস্থা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। পরে সাচার কমিটি যখন রিপোর্ট পেশ করে তখন ভারত জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। রিপোর্টে ভারতের মুসলমানদের করুণ অবস্থার চিত্র উঠে আসে। সাচার কমিটির রিপোর্টে কিছু অসম্পূর্ণতা ছিল বলে অনেকেই বলে থাকেন। এর কারণ তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে সাচার কমিটিকে প্রধানত বিভিন্ন রাজ্যের সরকারী কর্তৃপক্ষগুলোর ওপর নির্ভর করতে হয়। ফলে পূর্ণাঙ্গ ও সঠিক তথ্য পাওয়া অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। কমিটিকে অসহযোগিতারও সম্মুখীন হতে হয় অনেক ক্ষেত্রে। এরপরও সাচার কমিটির রিপোর্টে যে চিত্র বেরিয়ে আসে তা সবাইকে হতবাক করে দেয়। সব সময় মনে করা হতো, নিম্নবর্ণের তফসিলি জাতি, উপজাতি ও দলিতরাই বুঝি সবচেয়ে পশ্চাদপদ। সাচার কমিটির রিপোর্টে দেখা যায়, তারা নয়, মুসলমানরাই সবচেয়ে পিছিয়ে আছে। সাচার কমিটির রিপোর্টের আরেকটি বিস্ফোরক তথ্য হলো, চাকরির ক্ষেত্রে মুসলমানরা প্রায় সকল রাজ্যেই জনসংখ্যার অনুপাতে ব্যাপকভাবে বঞ্চিত। বেসরকারী পর্যায়ে চাকরির ক্ষেত্রে তো বটেই, সরকারী চাকরির ক্ষেত্রেও মুসলমানদের অবস্থান অত্যন্ত নগণ্য। আশ্চর্যের আরও একটি দিক হলো, যেসব রাজ্যে সেক্যুলার ও প্রগতিশীল হিসেবে পরিচিত সরকার ক্ষমতায় এবং যারা সংখ্যালঘুদের বন্ধু বলে পরিচয় দিয়ে থাকে, সেসব রাজ্যে মুসলমানদের অবস্থা তুলনামূলকভাবে আরও শোচনীয়। সাচার কমিটির রিপোর্টে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের যে চিত্র উঠে আসে তাকে মর্মান্তিক বললেও কম বলা হয়। দেখা যায়, পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের সরকারী চাকরির হিস্যা মাত্র ৪ দশমিক ২ শতাংশ। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গেই জনসংখ্যার অনুপাতে সরকারী চাকরিতে মুসলমানদের প্রাপ্তি সর্বাপেক্ষা কম। এছাড়া এই রাজ্যের সরকার পরিচালিত শিল্প ও বড় কোম্পানীতে উঁচুপদে মুসলমানরা শতাংশের মধ্যে নেই বলে সাচার কমিটির রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। আর এসব ক্ষেত্রে নিম্নস্তরের কাজে মুসলমানদের নিয়োগ মাত্র ১ দশমিক ৪ শতাংশ।
স্বাধীনতার পর থেকেই পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা শিক্ষা-দীক্ষা, চাকরি ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পিছিয়ে আছে। কংগ্রেস, বামফ্রন্ট ও তৃণমূল নেতারা মুসলমানদের ভোট ব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করে ক্ষমতায় এলেও তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নসহ সকল ক্ষেত্রে ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে এ রাজ্যের মুসলমানরা পিছিয়ে পড়তে পড়তে দলিতদেরও পেছনে পড়ে গেছে। ধারণা করা হয়েছিল, সাচার কমিটির রিপোর্টের পর গোটা ভারতে মুসলমানদের সামনে এগিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় কার্যব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু গত ক’বছরে এমন কোনো আলামত কারো নজরে পড়েনি। পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জি মুসলমানদের জন্য কিছু করবেন বলে আশা করা হলেও যে আশা ফলবতী হয়নি। এখন আবার নির্বাচনকে সামনে রেখে সবদলই মুসলমানদের জন্য ‘এই করবো’ সেই করবো বলে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।
মুসলমানরা যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই আছে, এমনি অবস্থার প্রেক্ষাপটে কয়েক মাস আগে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন ইমাম ও মুসলিম সংগঠনের নেতারা কলকাতায় এক  বৈঠকে বসেন।  বৈঠকে তারা সিদ্ধান্ত নেন, রাজ্যের প্রায় তিন কোটি মুসলমানের জন্য তারা একটি অভিন্ন দাবিনামা প্রণয়ন করবেন। এই দাবিনামায় মুসলমানদের শিক্ষা, চাকরির সুযোগসহ নানা বিষয় থাকবে। বৈঠকের আয়োজকদের একজন জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গের গরীব ও পিছিয়েপড়া মানুষদের জন্য আমরা কিছু করতে চাই, এটা আমাদের দায়িত্ব। সে জন্যই সব মুসলিম সংগঠনকে নিয়ে আমরা বৈঠক করেছি। সবাইকে এক জায়গায় এনে আমরা এগুতে চাইছি। জানা গেছে, দাবিনামা তৈরির আগে রাজ্যজুড়ে মুসলমানদের সার্বিক অবস্থা জানার জন্য একটি সমীক্ষা চালানো হবে। এর ভিত্তিতে তৈরি করা হবে অভিন্ন দাবিনামা।
যে সব সংগঠনের প্রতিনিধিরা ওই বৈঠকে মিলিত হন সে সব সংগঠন অরাজনৈতিক। এটা একদিক দিয়ে অত্যন্ত অনুপ্রেরণাদায়ক যে, পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের বিশেষ করে অরাজনৈতিক সংগঠনগুলোর মধ্যে সচেতনতা দেখা দিয়েছে এবং স্বসম্প্রদায়ের পশ্চাদপদ ও দরিদ্র-বঞ্চিত মানুষের কল্যাণে কিছু করার জন্য তারা চিন্তা-ভাবনা করছে। অবশ্য এ কথা বলাই বাহুল্য, রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিশেষত, ক্ষমতাসীনরা যদি সদিচ্ছাপ্রবণ না হন, পিছিয়েপড়া মুসলমানদের উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার নিয়ে পদক্ষেপ না নেন, তাহলে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন-অগ্রগতি হবে না। এ যাবৎ যারাই ক্ষমতায় এসেছেন, তারা যদি মুসলমানদের উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে ভূমিকা ও দায়িত্ব নিতেন তাহলে তাদের এতটা অবনতি হওয়ায় কথা না। বর্তমানে ক্ষমতাসীন তৃণমূল সরকার মসজিদ-মাদরাসার জন্য কিছু করার চেষ্টা করছে। যেমন ইতোমধ্যে ইমাম-মুয়াজ্জিন ভাতা প্রচলন করেছে। এসব কাজ বৃহত্তর মুসলিম সম্প্রদায়ের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কোনো অবদান রাখবে না। মুসলমানরা সামাজিকভাবেই এসব কাজ করতে পারে যদি সমাজ অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সক্ষমতা অর্জন করে। রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই মূল দায়িত্ব পালন করতে হবে। অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি নয়, আন্তরিকভাবে মুসলমানদের উন্নয়ন-অগ্রগতির জন্য কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে মুসলমানদের রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায়িত করার কার্যকর উদ্যোগও থাকতে হবে। মুসলমানদেরও উচিত হবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের ব্যাপারে উৎসাহিত হওয়া।
সাচার কমিটির রিপোর্টের ওপর ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে কোলকাতায় একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আলোচনা সভায় বিশিষ্ট সাংবাদিক এম জে আকবর এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়েছিলেন।  সেখানে তিনি ভারতীয় মুসলমানদের দুরবস্থার বিষয়ে অনেক কথা বলেছিলেন। বাঙালি মুসলমানদের অত্যন্ত নাজুুক হালের কথা তুলে ধরেছিলেন। বলেছিলেন, সাচার কমিটির রিপোর্টে যা আছে তা বহু আগে থেকেই মুসলিম সম্প্রদায়ের চোখে-মুখে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। এই সম্প্রদায় যে দারিদ্র্য ও উন্নয়নহীনতায় ধুঁকছে সে কথা বলার জন্য সাচার কমিটির প্রয়োজন নেই। পশ্চিমবঙ্গের কোনো গ্রাম বা বস্তিতে গেলেই সাচার কমিটির রিপোর্টের বাস্তবতা চোখে পড়বে। তিনি দুঃখ করে বলেছিলেন, ভারতের পশ্চাদপদ জাতিগুলোর জন্য মন্ডল কমিশন করা হয়েছিল ১৯৮৮ সালে। এর পর যে সরকারই এসেছে, তারা আর কোনো কমিটি গঠন করেনি। সবাই ক্ষমতায় গিয়ে মন্ডল কমিটির কিছু কিছু সুপারিশ বাস্তবায়ন করেছে। কিন্তু মুসলমানদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, গত ৬০ বছর ধরে এবং ৬০ বছর পরও তারা শুধু বঞ্চনাই পেয়ে যাচ্ছে। যদি বিদ্বেষভাবাপন্ন সরকার আসে তারা পায় নির্মম অবহেলা, আর যদি ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিদার সরকার আসে জোটে কমিশন বা কমিটি। কেউই আজ পর্যন্ত মুসলমানদের রোজগার বা চাকরি দেয়নি। কেউই আজ পর্যন্ত শিক্ষা ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার দেয়নি। তাদের সঙ্গে শুধু প্রতারণাই করা হয়। মুখে বলা হয়, মুসলমানরাও পশ্চাদপদ, তাদের জন্য এই করা দরকার, ওই করা দরকার। এগুলো তাদের প্রবঞ্চনা করারই অংশমাত্র, বঞ্চিত করার ভিন্ন এক প্রকরণ মাত্র।
বাঙালি মুসলমানদের একটি ভিন্ন দিকের প্রতিও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন এম জে আকবর। তিনি বলেছিলেন, ভারতীয় মুসলমানদের সমস্যা রয়েছে। কিন্তু বাঙালি মুসলমানদের সমস্যা আরো প্রকট। বাঙালি মুসলমানদের সমস্যা ও ট্রাজেডি হচ্ছে হিন্দুদের কাছে বাঙালি মুসলমানরা ‘যথেষ্ট বাঙালি’ নয়। আর উর্দুভাষী ভারতীয় মুসলমানদের কাছে তারা ‘পুরোপুরি মুসলিম’ নয়। তাই বাঙালি মুসলমানরা দ্বিমুখী করুণ অবস্থার শিকার। তারা শিকার দ্বিগুণ অবহেলার।
বছর দশেক আগে কলকাতার একজন সাংবাদিক ও মুসলিম কমিউনিটি লিডারের সঙ্গে এই লেখকের সাক্ষাৎ হয়েছিল। তার কাছে মুসলমানদের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি প্রায় এম জে আকবরের মতই কথা বলছিলেন। বলেছিলেন, কলকাতায় যারা মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দেন তাদের অধিকাংশেই উর্দুভাষী ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা এবং কলকাতারই বাসিন্দা। পশ্চিম বঙ্গের বৃহত্তর মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক  ও যোগাযোগ নেই। মুসলিম সম্প্রদায়ের দাবি-দাওয়া ও অধিকারের প্রশ্ন যখন উঠে, সরকারের সঙ্গে যখন দেন-দরবার হয়,তখন বাঙালি মুসলমানদের প্রসঙ্গ তেমন একটা উঠে আসে না। ফলে তাদের অবস্থার কোনো পরিবর্তনও হয় না।
বলা যায়, বাঙালি মুসলমানদের পশ্চাদপদতা, বঞ্চনা, অধিকারহীনতা ও বিপন্নদশার জন্য অনেক কিছুই দায়ী। রাজনৈতিক অবহেলা, সাম্প্রদায়িক মনোভাব, উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাব ইত্যাদির পাশাপাশি ঐতিহাসিক, সামাজিক বাস্তবতাও এক্ষেত্রে ক্রিয়াশীল। পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ মুসলমান গ্রামে বসবাস করে। জমি বা কৃষিনির্ভরতার কারণে তাদের অবস্থার উন্নয়ন পদে পদে বাধাগ্রস্ত হয়ে আছে। আর্থিক দৈন্য, কর্মসংস্থানের অভাব, শিক্ষার সুযোগ-বঞ্চনা ইত্যাদি তাদের আগে বাড়তে দিচ্ছেনা।
মুসলমানদের এ অবস্থার পরিবর্তন সহসা হবে এমন আলামত দৃশ্যগ্রাহ্য নয়। সাচার কমিটির সুপারিশ আজও বাস্তবায়িত হয়নি। রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা ক্ষমতায় বলয় থেকে এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে তেমন গরজ দেখা যায় না। যদি রাজনৈতিক নেতৃত্ব সদয় হতো, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় দিতো, তাহলে এতদিনে মুসলমানদের অবস্থার কিছু না কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করা সম্ভব হতো। এসোসিয়েশন স্ন্যাপ, গাইডেন্স গিল্ড এবং প্রতীচী ইন্সটিটিউট অনেক খেটেখুটে দীর্ঘ সময় নিয়ে যে রিপোর্ট তৈরি করেছে তা ভবিষ্যতে কোনো কাজে আসবে কিনা, মুসলমানদের উন্নয়ন ও প্রতিষ্ঠায় কোন ভূমিকা রাখবে কিনা ভবিষ্যতই বলতে পারে। তাদের এ উদ্যোগ ও কাজ অভিনন্দনযোগ্য। আর কিছু হোক না হোক, এই রিপোর্টের আয়নায় ভারতীয় মুসলমানেরা নিজেদের দেখতে পাবে এবং তাতে তাদের মধ্যে হয়তো সচেতনতা ও সক্রিয়তা বাড়তে পারে।
মুসলমানরা যদি উন্নয়ন, সমৃদ্ধি, প্রতিষ্ঠা ও অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে চায় তাহলে সম্প্রদায়গতভাবে তাদের আরো সচেতন হতে হবে। সংঘবদ্ধ হতে হবে। জেগে উঠতে হবে। তাদের শিক্ষার ব্যাপারে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। যে কোনো মূল্যে শিক্ষিত হয়ে উঠতে হবে। কর্মসংস্থানের উপর জোর দিতে হবে। শিক্ষণ-প্রশিক্ষণে উপযুক্ত হয়ে সরকারী-বেসরকারী চাকরি তালাশ করতে হবে। চাকরির জন্য সোচ্চার হতে হবে। এই সঙ্গে বিভিন্ন পেশা গ্রহণসহ ব্যবসা-বাণিজ্যে মনোযোগ দিতে হবে। আর রাজনীতি যেহেতু সব কিছুর  নিয়ন্তা সুতরাং তাদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণও বাড়াতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (3)
Kareemullah ৬ এপ্রিল, ২০২১, ১০:১৮ এএম says : 0
খুব সুন্দর লিখেছেন স্যার আপনার এই লেখা পড়ার পর সত্যি বাঙ্গালী হিসেবে আমার খুব দুঃখ হয়েছে।
Total Reply(0)
গাজ্জালী ২৬ জুন, ২০২১, ৭:০২ পিএম says : 0
বাংলাদেশে বর্তমানে হিন্দুদের সংখ্যা ১০:৭ % কিন্তু তারা সরকারী চাকরী করছে ২২ % এর উপরে। আর আমাদের ভারতের মুসলমান আছে ২০ % আর বেসরকারি জরিপে মুসলিম আছে প্রায় ৩২% উপরে। ভারতের মুসলিমদের সরকারি চাকরি করছে ৪:২% যা সংখ্যা তুলনায় খুবই নগণ্য। এমন বৈষম্য খুব দুঃখ জনক।
Total Reply(0)
মাহবুব ২৫ নভেম্বর, ২০২২, ১১:৪০ এএম says : 0
কিচ্ছু একটা করা দরকার
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন