আবদুল আউয়াল ঠাকুর : জাতীয় বিচার বিভাগীয় সম্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেছেন। তার বক্তব্যে চলমান সংকটের প্রেক্ষিতে একদিকে যেমনি সকলের ভাবনার বিষয় রয়েছে, অন্যদিকে উত্তরণের পথ খোঁজারও তাগিদ রয়েছে। তিনি বলেছেন, গণতান্ত্রিক সরকার পাঁচ বছর দেশ পরিচালনা করতে পারবে আর সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা করতে পারেবে না- এটা রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা। গণতন্ত্রকে বিকশিত করার জন্য গণতান্ত্রিক সরকার প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক সরকারের স্থ’লে অগণতান্ত্রিক সরকার সমাধান নয়। একটি গণতান্ত্রিক সরকার পাঁচ বছর দেশ পরিচালনার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি কার্যকর হতো। আর এই সরকার প্রধান হতেন একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি। তখন বিচারপতি নিয়ে রাজনীতি শুরু হতো। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি নিরপেক্ষ কিনা সে বিষয়ে নানা আলোচনা হতো। আর তিনি যদি নিরপেক্ষ না হন তাহলে তিনি বিচারপতি থাকাকালে যেসব রায় দিয়েছেন সেগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। তিনি আরো বলেছেন, নিরপেক্ষ নির্বাচন রাজনীতিবিদরা করতে পারবে কিনা এটা তাদের ব্যাপার। এটা বিচার বিভাগের দায়িত্ব নয়। তার মতে, সংবিধানে সরকার পরিবর্তন হওয়ার গণতান্ত্রিক বিধান সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। সামরিক শাসন জারি করে গণতান্ত্রিক পরিবেশকে বারবার ধ্বংস করা হয়েছে। ফলে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার উন্নতি সাধন হয়নি।
একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু রাখার বিবেচনা থেকে প্রধান বিচারপতি, যে পর্যবেক্ষণ গভীর বিবেচনায় দেখার এবং এ নিয়ে ভাববার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। এ কথা সত্যি যে, একজন প্রধান বিচারপতি হিসেবে তিনি মূলত এবং প্রধানত বিচারবিভাগ নিয়েই ভেবেছেন। হয়তো এটাকেই তিনি সঙ্গত মনে করেছেন। তার ভাবনার মধ্যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুসংহত করতে রাজনীতিবিদদের ওপর চাপ সৃষ্টির যে ব্যাপারটি আছে তার সুনির্দিষ্ট একটা মাত্রাও রয়েছে। প্রধান বিচারপতির এই পর্যবেক্ষণ ও মন্তব্য নিয়ে এই লেখা পর্যন্ত সরকারি বা বিরোধী কোনো রাজনৈতিক মহলই কোনো প্রকার মন্তব্য করেনি বিধায় ধরে নেয়া যায়, রাজনীতিবিদরা তাদের দেউলিয়াপনার ব্যাপারটি হয়তো মেনে নিয়েছেন। এ কথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের বিবেচনাতে রাজনীতিবিদের এক ধরনের অসমর্থতার প্রসঙ্গ ছিল। স্বাধীনতা-পরবর্তী যতগুলো নির্বাচন দেশে হয়েছে তার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে সাবেক বিচারপতিরাই দায়িত্ব পালন করেছেন। এমনকি স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সময়ও যে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে অপসারণ করা হয়েছিল রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে তিনিও একজন সাবেক বিচারপতি ছিলেন। এদেশে সেনাপ্রধান হিসেবে একমাত্র সামরিক শাসনের প্রবক্তা জেনারেল এরশাদ সামরিক শাসনের পক্ষে যে ভাষণ দিয়েছিলেন তাতেও প্রধান উদ্ধৃতি ব্যবহৃত হয়েছিল একজন বিচারপতির। বোধকরি দেশে যে প্রথম সামরিক শাসন জারি হয়েছিল তাও একজন সাবেক বিচারপতির জবানিতেই। আবার সামরিক শাসকরা অনেকাংশেই একজন সাবেক বিচারপতিকে প্রথমে প্রেসিডেন্ট নিয়োগ করে সামরিক শাসন জারি করে তারপরে তাকে সরিয়ে নিজে পর্দার সামনে আসেন। বাংলাদেশের এ ইতিহাস বোধকরি একজন নাবালকেরও অজানা নয়। এসব ক্ষেত্রে যেসব বিচারপতি বিতর্কিত নির্বাচন পরিচালনা করেছেন, সামরিক সরকারের পার্টনার হয়ে কাজ করেছেন তাদের রায় নিয়েও তো বিতক ওঠার কথা। এসব নিয়ে অদ্যাবধি কোনো কথা হয়নি। প্রাসঙ্গিক আলোচনায় এটাও বলা দরকার দেশের একমাত্র সামরিক সরকার প্রধান হিসেবে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংসের নায়ক এইচ এম এরশাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা আদালত নেয়নি। অথচ জমির মামলার রায় দিতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে। এই বাতিলকে অবশ্যই সংবিধানের মূল চেতনার বিবেচনায় নিতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দেশের গণতান্ত্রিক শক্তির ঐকমত্যের ভিত্তিতে। এটি যখন সংসদে পাস হয়েছিল তখনকার অবস্থা আজ আর নতুন করে আলোচনা করে লাভ নেই। শুধু এটুকু বলা প্রয়োজন, এসব কিন্তু সবার চোখের সামনেই হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য দেশ অচল করা হয়েছিল। সংসদ থেকে পদত্যাগ করে সংসদ ভেঙে দেয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল। সবমিলে এই যে রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হয়েছিল এর মূল বিষয় ছিল, দেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিস্থিতি তৈরি করা। আস্থার এই জায়গাটিতে নিজেদের মধ্যে থেকে কাউকে না নিয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতিকে স্থান দেয়ার মধ্যদিয়ে মূলত এই আসনকে মহিমান্বিতই করা হয়েছিল। মানুষের চিন্তার যেমনি সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তেমনি রয়েছে একমুখিনতা। সে সময়ে এর চেয়ে ভালো কোনো বিকল্পের খোঁজ পাওয়া যায়নি। তবে হ্যাঁ, এ কথা অকপটে স্বীকার করা উচিত, এই প্রস্তাবের পেছনে প্রকৃতই লিয়াজোঁ কমিটি কাজ করেছে নাকি অন্য কোনো মহলের দেয়া ফর্মুলা বাস্তবায়ন করা হয়েছে তা নিয়ে পরেও আলোচনা হয়েছে। এই আলোচনার কারণও ছিলেন সে সময়ের প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এটা মনে করা হয়, সে সময়ের পরিস্থিতিতে গণরোষ থেকে বাঁচাতে এরচেয়ে আর কোনো ভালো ফর্মুলা হয়তো কারো কাছে ছিল না। এর পেছনে এক ধরনের রাজনৈতিক চিন্তা হয়তো সক্রিয় ছিল। সে প্রেক্ষিতকে সামনে রেখে যদি খোদ প্রধান বিচারপতির বক্তব্যকে মেলানো যায় তাহলে তার কথার একটি বিশেষ অর্থ হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে। তিনি বলেছেন, একটি বিশেষ মহলের প্ররোচনায় গণতান্ত্রিক সরকারের পরিবর্তে অগণতান্ত্রিক সরকারের মাধ্যমে নির্বাচন পরিচালনার লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধন করে বিচার বিভাগকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। এ কাজটি আসলে কীভাবে কেমন করে কোন মহলের প্ররোচনায় বা ইন্ধনে হয়েছিল তার কোনো বিবরণ পেতে হলে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এ রূপরেখা যারা তৈরি করেছিলেন তারা আসলে কাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন বা কাদের কান কথা কানে তুলেছিলেন সেটি যেমনি বেরিয়ে আসা দরকার, তেমনি যারা রাজপথ উত্তপ্ত করেছিলেন তারাই বা কী উদ্দেশ্যে কোন লক্ষ্য বাস্তবায়নে এ কাজটি করেছিলেন তাও জনগণের জানার সুযোগ রয়েছে। এদের অনেকেই এখনো জীবিত রয়েছেন। বিচার বিভাগের মর্যাদা সংরক্ষণ ও বৃদ্ধির বিবেচনা থেকে এ ব্যাপারটি খুঁজে পেতে এবং জনগণকে জানাতে উচ্চ আদালত একটি তদন্ত কমিটি গঠন করলে সেটি জনগণ ইতিবাচকভাবেই গ্রহণ করবে। তবে মূল বিষয় এটি নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়া উচ্চতর আদালতের রায়েই সমঝোতায় পৌঁছার জন্য আরো দুটার্ম এই সরকারের অধীনে নির্বাচন করার স্বীকৃতি দিয়েছিল। আদালতের রায় ধরে সংসদে যে আইন প্রবর্তন করা হয়েছে সে মোতাবেক ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই নির্বাচনে নির্বাচন প্রসঙ্গে সংবিধান বর্ণিত যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা বলা হয়েছে তা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনের অগ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সকল মহল একমত হলেও উচ্চতর আদালত এই নির্বাচনকে বাতিল করেনি। এক্ষত্রে জনআকাক্সক্ষা, সংবিধানের গাইডলাইন কোনো কিছুই সমান্তরাল নয়। তবুও এই সরকার ওই নির্বাচনের বদৌলতে শুধু ক্ষমতায় বহালই নেই বরং যিনি বা যারাই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা বলছে তাদেরই জঙ্গি তকমা দেখা হচ্ছে। ফলে পরিস্থিতি এই দাঁড়িয়েছে যে, নির্বাচনের কথা বলা বা সংবিধান বর্ণিত মৌলিক অধিকার প্রয়োগের কোনো স্বাধীনতা তাদের নেই। এই বাস্তবতায় প্রধান বিচারপতি কেবল বিচার বিভাগের স্বাতন্ত্র্য নয়, সংবিধান নিয়ে চেতনার যে কথা বলেছেন তাকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার আলোকে দেখতে গেলে অবশ্যই এটা বলা দরকার যে, সুপ্রিমকোর্ট যেহেতু সংবিধানের ব্যাখ্যাকারী তাই সে কার্যত অভিভাবকও। এক্ষেত্রে কেবল বিচার বিভাগ নয় বরং দেশের সামগ্রিক বিষয়াবলীর দিকেই নজর দেয়া প্রয়োজন। আলোচ্য সম্মেলনে প্রধান বিচারপতি অবশ্য দেশের বিরাজমান নানা গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর প্রসঙ্গেও কথা বলেছেন। সে আলোচনার সাথেই মিলে রয়েছে কীভাবে দেশে সংবিধান অনুযায়ী একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা যায় সেটি এবং দেশ রক্ষার বিষয়ও।
ভারতে মুঘল সা¤্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা স¤্রাট বাবরের পুত্র হুমায়ুন ছিলেন নির্লিপ্ত ও উদাসীন প্রকৃতির লোক। তিনি ধূর্ত বা নিষ্ঠুর প্রকৃতির ছিলেন না। তার দুর্ভাগ্য যে, তিনি শেরশাহকে মোকাবিলা করতে পারেননি। মুঘল শাসকদের মধ্যে নানাভাবে আলোচিত-সমালোচিত স¤্রাট আকবর প্রায় ৫০ বছর দিল্লির মসনদে ছিলেন। তার এই শাসনামলের গোড়ায় মূলত অভিভাববের ভূমিকা পালন করেছিলেন বৈরাম খান। হুমায়ুনের দুঃখ-কষ্টে এবং বিপদের সময় তিনি তার পাশে ছিলেন। একদা হুমায়ুন বৈরাম খাঁকে বলেছিলেন, আমাদের পরিবারে দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে আপনার ন্যায় সাহায্যকারী আর কেউ নেই। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আকবরের ক্ষমতা লাভের পর বৈরাম খাঁ তার সমস্ত শক্তি ও ক্ষমতা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। একমাত্র তার বুদ্ধির বলেই পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে মুঘলদের বিজয় হয়েছিল। বিপদের সময়ে তাকে রক্ষার জন্য বৈরম খানের মতো অন্য কোনো বন্ধু ও উপকারী কেউ ছিল না। ইতিহাস বলে বৈরাম খাঁর স্বেচ্ছাচারিতা ও রূঢ় আচরণ অনেককেই তার শত্রুতে পরিণত করে এবং তার পতনকে আসন্ন করে তুলে। এটা বাস্তব যে, রাজ্যহারা একজন শাসককে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে একজন প্রকৃত অভিভাবকের ভূমিকায় ছিলেন বৈরাম খাঁ। এক্ষত্রে তিনি ছিলেন আপসহীন। একইভাবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অভিভাবকত্বের প্রসঙ্গও সে সময়ে অনেকের বেলাতেই ছিল। অভিভাবকের বিষয়টিকে যেমনি পরিবারের বেলায় অস্বীকার করা যাবে না তেমনি রাষ্ট্র-সমাজের বেলাতেও। আইন অনুযায়ী নাবালকের সম্পত্তির অভিভাবক আদালত ঠিক করে দেন। যে কোনো বিতর্কিত বিষয়ে মীমাংসা পেতে হলে সেজন্য আদালতের শরণাপন্ন হতে হয়। সে বিবেচনায় আদালতকেই ফয়সালা দিতে হয়। প্রধান বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে যে আলোচনা করেছেন তা পূর্ণাঙ্গ নয়। কারণ, তিনি শুধুমাত্র সমস্যার একদিক তুলে ধরেছেন। অন্যদিকটি রেখে দিয়েছেন তার ভাষায় দেউলিয়াদের হাতেই। ভাববার রয়েছে, রাজনীতিবিদরা যদি দেউলিয়া হন তাহলে দেশ কখনো সমৃদ্ধ হতে পারে না। রাজনীতিবিদরাই দেশ পরিচালনা করেন। রাজনৈতিক ঘোষণাতেই দেশ স্বাধীন হয়েছে। এখন যে সংবিধানের কথা বলা হচ্ছে তা রাজনীতিবিদরাই রচনা করেছেন। আবার তাদের ভ্রান্তির কারণেই কখনো কখনো সংবিধানের চেতনা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। অবশ্যই এখানে রাজনীতিকদের যোগ্যতা, দক্ষতা, আন্তরিকতার প্রসঙ্গকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। দেশ যখন সামরিক শাসনের অধীনে ছিল তখন আবার দেশ থেকে রাজনীতি নির্মূল করার যখন আয়োজন করা হয়েছিল তখনও তা প্রতিরোধ করেছে এই রাজনীতিকরাই। অবশ্যই এখানে মতপার্থক্যের বিষয়টি রয়েছে। ’৮২ সালের সামরিক সরকারকে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল সমর্থন দিয়েছিল। তেমনিভাবে ২০০৭ এর পর যখন দেশ থেকে রাজনীতি নিমর্ূূল করার চেষ্টা হয়েছিল তাতেও কারো কারো সমর্থন ছিল। আবার দেশ যখন গভীর সংকটে ছিল নব্বইয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অন্য সকলে মিলেই দেশকে মুক্ত করার সনদপত্র তৈরি করেছিল। মানুষ তো ভুলের মধ্যেই থাকে। ভুল করা মানুষের চিরাচরিত স্বভাব। ভুলই প্রধান নয় বরং প্রধান বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, ভুলকে ভুল বলে মেনে নেয়া এবং নতুন ভুল থেকে নিবৃত্ত থাকা। একটি সত্যিকারের দায়বদ্ধ সরকার গঠনে নির্বাচনী ব্যবস্থার গুরুত্ব এবং রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা নিয়ে প্রধান বিচারপতি যে বক্তব্য দিয়েছেন তা সামগ্রিক এবং দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই বিবেচনার দাবি রাখে। দেশে দুর্ঘট পরিস্থিতি বিস্তারের মূলে রয়েছে নির্বাচনী ব্যবস্থার ত্রুটি বা ভ্রান্তি। অবশ্যই এটা লক্ষ্যণীয় যে, ২০১৪ সালের অগ্রণযোগ্য নির্বাচনের পর দেশে এক ধরনের নৈরাজ্য স্থান করে নিয়েছে তার অন্য কোনো উদাহরণ পাওয়া ভার। সঙ্গত বিবেচনা থেকেই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে রাজনীতিকদের দক্ষতা-যোগ্যতা প্রমাণের ওপর যে গুরুত্ব প্রধান বিচারপতি দিয়েছেন তার মূল সুর যদি তারা অনুধাবন করতে পারেন তাহলে দেশে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সংকট অনেকখানি আপনাতেই কেটে যাবে। তবে বিষয়টিকে এভাবে না দেখে অন্য ভাবে দেখা যায়। এ পর্যন্ত উচ্চতর আদালত দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলেছেন। বর্তমান প্রধান বিচারপতিও দেশে মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। নির্বাচনী ব্যবস্থাকে সঠিকখাতে আনা না গেলে কোনো ভাবেই দেশকে এগিয়ে নেয়া যাবে না। প্রধান বিচারপতি যেহেতু উপলব্ধি করেছেন নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে রাজনীতিবিদদের বড় ধরনের ত্রুটি রয়েছে সে কারণেই সংবিধানের ব্যাখ্যাকারী হিসেবে সুষ্ঠু বিহিতকরণের দায়িত্ব থেকে তিনি মুক্ত থাকতে পারেন না। এটা সকলকেই মনে রাখতে হবে, যারা ভুল করে তারা যেমনি ভুলের খেসারত দেয় যারা ভুলের সাথে যুক্ত নয় তারাও এর খেসারত থেকে মুক্ত নয়। হযরত মুসা (আ.)-এর সময়কার একটি প্রসঙ্গ উপস্থাপন জরুরি মনে করছি। একবার এ ধরনের প্রশ্ন উঠেছিল, কোনো জনপদে সকলেই তো আর অপরাধের সাথে যুক্ত থাকে না, তাহলে সকলে আক্রান্ত হয় কেন? এর জবাব ছিল মোটামুটি এরকম যে, যারা অপরাধের সাথে যুক্ত তারা তো আছেই কিন্তু যারা অপরাধ দেখে অথচ প্রতিরোধ করে না তারাও সমভাবে যুক্ত। রাজনীতিবিদদের ভুলে বা অর্বাচীনতার কারণে যদি নির্বাচনী ব্যবস্থা ভ-ুল হয়ে থাকে এবং এটি যখন প্রধান বিচারপতি উপলব্ধি করেছেন তখন তার দায়িত্ব হচ্ছে ব্যাপারটিকে পূর্ণ অর্ডারে নিয়ে আসার জন্য ভূমিকা রাখা।
একটি সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়ার অভাবই এই মুহূর্তে দেশের প্রধান সংকট। এক্ষেত্রে দোষারোপের নীতি কোনো ফয়সালা নয়। যে কারণেই হোক, যার কারণেই হোক এটা এখন সর্বজন অনুভূতিতে পরিণত হয়েছে যে, দেশে নির্বাচনকালীন একটি গ্রহণযোগ্য সরকার প্রয়োজন। শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে দেশের সকল মানুষের স্বার্থে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছিল। সে সময়ের প্রধান বিচারপতিও কোনো না কোনোভাবে এর সাথে যুক্ত ছিলেন। এখন যখন মনে করা হয়েছে, এটি সংবিধানের বিধানের অনুরূপ নয় তখন অবশ্যই যে সংবিধান মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে রচিত হয়েছে সেখানে যুক্তিযুক্ত ব্যবস্থাতেই সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সুতরাং এটির ব্যবস্থা করতে সকলের ঐকমত্য জরুরি। এটা সকলেরই মনে রাখা দরকার, নির্বাচনী ব্যবস্থার ত্রুটির পথ ধরে দেশ আজ এক গভীর খাদে পতিত হয়েছে। এই খাদ থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে কারো মর্যাদাই রক্ষিত হবে না।
awalthakur@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন