শরীফুর রহমান আদিল : মানবজীবন সীমিত তাই তার থেকে একটি বছর চলে যাওয়ার অর্থই হলো তার জীবনের চাওয়া-পাওয়া, সফলতা-ব্যর্থতা সব কিছুর হিসার গণনা। আর সব ভুলকে শোধরে কিংবা ব্যর্থতার গ্লানি মুছে সে এগুতে চায় সামনের দিকে। এটাই জীবন। জীবন কারো সফলতা কিংবা ব্যর্থতার সাথে অংশীদার হতে বসে থাকে না তবে সে স্বাক্ষী হয়ে রয় মানুষের কাছে। সে তার গতিতে আনমনে চলতে থাকে তার সেই চলার মধ্যদিয়েই আমাদের সকলের নিকট বিদায় নিলো ২০১৬ সাল। প্রত্যেক সালের মতো ২০১৬ সালও বাংলাদেশ সহ আন্তর্জাতিক অঙ্গন ছিল ঘটনাবহুল বলতে গেলে কোথাও হানাহানি, কোথায় হাহাকার, কোথাওবা বারুদের আওয়াজ কিংবা মায়ের ডাকের আর্তনাদ আবার কেউ বিজয়ী বা সফল হওয়ার আনন্দ, বিভিন্ন অর্জন কিংবা সূচকের ঊর্ধ্বগতি সবই যখন স্বাক্ষী তখন ২০১৬ সালের বিদায়ের পর এসেছে ২০১৭।
বাংলাদেশের জিডিপি এখন ৬ শতাংশ ছাড়িয়েছে, বেড়েছে মাথাপিছু আয় যা এখন ১৩১২ ডলারের কাছাকাছি। পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রজেক্টের কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপতির আহ্বানে সংলাপ পরিশেষে রাজনীতিতে সুবাতাস বইছে, মীরজাফরের দায়িত্ব নিয়ে নির্বাচন কমিশন নারায়ণগঞ্জে চমকপ্রদ উপহার দিয়েছে জনগণকে, খাদ্যে মোটামুটি স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জিত হয়েছে। শেয়ার বাজারে বিদেশী বিনিয়োগ বেড়েছে ৭৩ শতাংশ, শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তৈরি পোশাক শিল্প বিশ্ববাজারে প্রভুত্ব বিস্তার করে চলছে। বিদ্যুতের ঘাটতি দিনদিন কমে আসছে, সামাজিক সক্ষমতার সূচক বৃদ্ধি পেয়েছে, জাতিসংঘের আর্থ পুরস্কার বাংলাদেশের জন্য গৌরব এনে দিয়েছে, ঔষধ শিল্পে ব্যাপক সফলতা আসছে এত কিছুর পরও কিছু চ্যালেঞ্জ নতুন বছরে হাতছানি দিচ্ছে যেমন- মানুষ স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি পাচ্ছে না সরকার এখনো আইনের শাসন নিশ্চিত করতে পারছে না, এখনো মানুষের গুম কিংবা বিচারবহির্ভূত হত্যা নিত্য দিনের খবর হয়ে আসছে। মায়ের আর্তনাদ আর হাহাকার যেন সব উন্নয়নকে ম্লান করে দিচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের আচরণ রীতিমতো গোপাল ভাঁড়কেও হার মানছে, মানুষের ভোটের অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে উন্নয়নের জোয়ার গাদ্দাফিকে স্মরণ করে দিচ্ছে, দুর্নীতির হার কমলেও সেবাপ্রার্থীদের হয়রানি নিত্যসঙ্গী হয়ে ভিড় করছে। হলমার্ক, ডেসটিনির নাম না শোনা গেলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারীকে হার মানিয়েছে। জাতীয়করণের নামে স্বজনপ্রীতি কিংবা দলীয়নীতির দায়ে পুলিশের লাথি আর পায়ের বুটে ক্ষতবিক্ষত শিক্ষক মুখ কিংবা বুক কোথায়ও শিক্ষকের মৃত্যু, শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নয়নের নামে রাজনৈতিকভাবে প্রায় শতভাগ পাস! আই এ্যাম জিপিও ফাইভ পায় ৩৩ শতাংশ, পরে ঢাবি জবির ভর্তি পরীক্ষা যেন জিপিও ফাইভপ্রাপ্ত প্রশ্ন দেখে বিড়ালের চোখ দিয়ে! শিশু-কিশোরদের উপর নিষ্ঠুরতা কাঁপিয়েছে পুরো জাতিকে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে নাসিরনগরে হামলা, গতিহীন নেতৃত্ব, সহিষ্ণুতাহীন রাজনীতি, হাউজিং ব্যবসার নামে কৃষি জমিকে কর্পোরায়েটন, ক্ষুদ্র- ও মাঝারী শিল্পীদের মাথায় হাত, সরকারি কর্মকর্তা- কর্মচারীদের সুরক্ষা দেয়ার জন্য আইন তৈরি ক্ষমতাকে ইস্পাতের সাথে তুলনাকরণ। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি নৈতিক প্রবৃদ্ধিকে জোর না দেয়া। আধুনিকতার নামে অশ্লীলতাকে প্রশয় দিয়ে মিডিয়া জগৎকে ধ্বংস করে সুলতান সুলেমান এনে জোড়াতালি, ক্রিকেটকে প্রাধান্য দিয়ে অন্যান্য খেলাধুলাকে নিশ্চিহ্ন করা, ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক কারণে ক্রিকেটারকে বসিয়ে রাখা অন্যদিকে রাষ্ট্রের শতশত কোটি টাকা খরচ করে বিদেশে লজ্জাজনক হার, গ্যাস-বিদ্যুৎ থেকে সরকারের উচ্চ মুনাফা অর্জনের মানসিকতা, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ১০০০ টাকা বাসাভাড়া দিয়ে করের বোঝা আরোপ, মুক্তিযোদ্ধের মাধ্যমে প্রাপ্ত দেশে গণতন্ত্র নিয়ে হাজির হয় বিদেশি লোক, বাক স্বাধীনতা রুদ্ধ, গণমাধ্যমই যেন গণতন্ত্রের একমাত্র বিকাশক অন্যকথায় প্রচারক, বিরোধী দল হয়েও যেটা পারছে না সংসদে; টিভির টকশো সেটা করে উপাধি পায় বিকল্প সংসদ, মাগুরার চেয়েও ভয়ানক ফেনী মডেল নির্বাচনের ছড়াছড়ি, এসব কিছু নিয়ে পুরো বছর ছিল সরব।
নতুন বছরে সকলের আশা এসব অভিযোগ আর সরকারের সমালোচনার ভিত হবে না, সরব হবে না টকশো আর টিভি চানেলগুলো প্রধানমন্ত্রীও অভিযোগ করবে না টিভি মালিকদের বরং এগুলোকে চ্যালঞ্জ হিসেবে নিয়ে নতুন বছর শুরু করবে সরকার এবং নতুন বছরে কার্যপ্রণালীতে এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে আর সব কিছু যেন নতুন বছরের জন্য একপ্রকার চ্যালেঞ্জ বৈকি! অন্যভাবে বলা চলে, বাংলাদেশ তার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে; যাতে ২০২৪ সালের মধ্যে স্বল্প উন্নত দেশ থেকে উন্নত রাষ্ট্রের তালিকায় ঢোকার চেষ্টা করছে আর এ লক্ষ্যে সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে কিšুÍ সরকারের এ লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে সরকারকে অবশ্যই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে। অন্যথায় এ লক্ষ্য অর্জন আরো বিলম্ব হতে পারে। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তা পূরণ করতে গেলে প্রথমেই উপরোক্ত সমস্যাবলীর সমাধান করতে হবে। অন্যথায় উন্নত দেশে ঢোকার স্বপ্ন কিংবা সরকারের যাবতীয় অর্জন সবকিছুই স্লান হয়ে যেতে পারে।
আমরা জানি বাঙ্গালীদের নিজস্ব পঞ্জিকা রয়েছে ওই হিসেবে বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে সরকার তার কর্মকর্তা- কর্মচারীর জন্য ২০ শতাংশ উৎসব বোনাস ঘোষণা করেছে। এছাড়াও রয়েছে আরবি হিজরি সাল যা দেখে আমরা পালন করি রোযা, ঈদ, হজ্ব, আশুরাসহ অন্যান্য ধর্মীয় বিষয়াদী। তবুও গ্রেগরিয়ান বা খ্রিস্টীয় বর্ষপঞ্জি আমাদের দেশেও খুব গুরুত্বপৃর্ণ কেননা, অফিস- আদালত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সবর্ত্রই এ পঞ্জিকা অনুসরণ করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, আমাদের অর্থবছরও হিসাব করা হয় এই গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকা দ্বারা। সুতরাং রাজনীতিবিদরাও এ নতুন বছরকে টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করবে, শীতের ঠা-ায় রাজনৈতিক আস্থা সংকটের জহির রায়হানের ভাষায় যে ‘বরফ গলা নদী’ অবস্থা তৈরি হয়েছে রাষ্ট্রপতির উদ্যোগে তাতে রাঙ্গা প্রভাত হাসবে। নতুন বছর সকলের জন্য শুভ ও মঙ্গল বয়ে আনুক আর দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ তাদের শান্তির নীড় খুঁজে পাক এই বছরে দূর হোক সকল সাম্প্রদায়িকতা, অনৈতিকতা আর হানাহানি ও দলীয়করণের বেড়াজাল থেকে এই প্রত্যাশা সকলের।
ষ লেখক : প্রভাষক, দর্শন বিভাগ, ফেনী সাউথ ইস্ট ডিগ্রী কলেজ
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন