স্টালিন সরকার : ‘পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে’ প্রবাদের মতো কি জাতি হিসেবে আমরা আত্মহননের পথে এগিয়ে চলছি? ‘শিল্প সংস্কৃতিতে যে জাতি যত সমৃদ্ধ সে জাতি তত উন্নত’ মনিষীদের এসব বাণী ভুলে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির হুজুগে মেতে উঠেছি। থার্টিফাস্ট পালন নামে মধ্যরাতে আমরা কোন সংস্কৃতি চর্চা করছি? আমাদের রয়েছে হাজার বছরের সংস্কৃতির ঐতিহ্য। অলি-আউলিয়া, পীর-দরবেশ, কাজী নজরুল ইসলাম, জসিমউদ্দিন, আব্বাসউদ্দিন, আবদুল আলিম, হাছন রাজা, লালন ফকির, জীবনানন্দ দাস, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সে পথ দেখিয়ে গেছেন। বরেণ্যদের দেখানো পথে না হেঁটে আধুনিকতার নামে পশ্চাত্যের ঢং-এ গভীর রাতে আনন্দ-ফুর্তি করছি; পাঁচতারা হোটেলে মদ গিলছি? পিঠা-পায়েসের বদলে বিয়ার, হুইস্কি, শ্যাম্পাইন, ভদকা কী সমাজের সঙ্গে যায়? মধ্যরাতে কিছু তরুণ-তরুণীর উশৃঙ্খতা আতসবাজি আর হোটেলে উচ্চবৃত্তের মদ্যপতা রাষ্ট্রের সর্বজনীন উৎসব হতে পারে না। যে উৎসবে সর্বজনের অংশগ্রহণ নেই; যে আনন্দ প্রকাশে স্বাভাবিকতা-স্বতঃস্ফূর্ততার বদলে শুধু হৈ হুল্লোর, আতসবাজি, মদ্যপান সেটা কী জাতীয় উৎসব? থার্টিফাস্ট পালন নামে রাজধানী ঢাকায় যা হলো তা ফ্রান্স, জার্মানী, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়াসহ ইউরোপের দেশগুলোর সর্বজনীন উৎসব হতে পারে; কিন্তু ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে মদ উৎসব অনৈতিক।
ইংরেজদের উপ-মহাদেশ থেকে বিতাড়িত করলেও যাপিত জীবনে ইংরেজি নববর্ষের গুরুত্ব আছে। ইংরেজি ক্যালে-ার অনুযায়ী সরকারি দাপ্তরিক কাজকর্ম হয়। স্কুল কলেজের শিক্ষাবর্ষ শুরু হয় পহেলা জানুযারি থেকে। সে হিসেবে নববর্ষের গুরুত্ব যথেষ্ট। কিন্তু উৎসবের নামে বিশৃঙ্খল-উপদ্রব! মধ্যরাতে উচ্চবিত্ত শ্রেণির কিছু ছেলেমেয়ের উশৃঙ্খলতা মাত্রারিক্ত বাড়াবাড়ি দেশের সংস্কৃতির উৎসব হিসেবে চালিয়ে দেয়া যায় না। দেশে ‘ভ্যালেনটাইন ডে’ উদ্ভাবক বিকৃত মানসিকতার ব্যাক্তির সংস্কৃতিক-সমাজিক অবস্থান আজ কোথায় দেশবাসী দেখছে।
ব্যাক্তিগত জীবনে পেশাগত কারণে অসমাজিক হওয়ায় থার্টিফাস্ট নিয়ে লেখার কোনো আগ্রহ ছিল না। কিছু ব্যাক্তির জ্বালাতনে লিখতে হচ্ছে। বছরের শেষ রাতে হঠাৎ ঘর-দরজা, খাট-বিছানা কেঁপে উঠলো। পাতলা ঘুম কেবল গাঢ় হয়েছে; অমনি বোমার আওয়াজ। প্রচ- শব্দে বিছানায় তিষ্ঠাতে না পেরে বারান্দায়। চোখে পড়লো পাশের বাসার কার্ণিশ ধরে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে দু’টি বুনো বানর। প্রজ্জলিত আকাশে উড়ছে কাক, শালিক, চড়–ই, ঘুঘু। মধ্যরাতে একজোড়া কাক বিদ্যুতের তারে বসে কা-কা আর্তনাদ করতে করতে ডানা ঝাপটাচ্ছে। কয়েকটি কুকুর ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। কিছু মানুষের বার্ষিক আনন্দে নিষ্পাপ প্রাণীকূলের এ কী দুর্দশা! আকাশে দেখলাম এক সঙ্গে কয়েকটি বিমান আলো জ্বালিয়ে উড়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর গৃহিণী জানালো বিমান নয়; ওগুলো থার্টিফাস্ট নাইট উৎসবের বেলুন। টিভিতে সরাসরি দেখানো হচ্ছে গুলশানের হোটেলে আলো ঝলমলে বাতি, শীতের রাতে বাইরে শত শত পুলিশ প্রহরা। ব্যাচারা পুলিশ! টিভি পর্দায় রিপোর্টার সচিত্র ধারা বিবরণীতে জানাচ্ছেন, হোটেলের ভিতরে কিছু নির্দিষ্ট ব্যাক্তি থার্টিফাস্ট উৎসব পালন করছেন। মদের সাথে চলছে নর্তকীর জলসা। থার্টিফাস্টে রাজধানীর অধিকাংশ বড় হোটেলে গভীর রাতে একই দৃশ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে কিছু তরুণ-তরুণী হৈ হুল্লোর করছেন; টিভিতে সে চিত্র দেখানো হচ্ছে। এই যে অভিজাত হোটেলে গভীর রাতের ঝলোমলো চিত্র এবং টিএসসির হৈ হুল্লোর এটা কী আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি? যে উৎসবে সাধারণ মানুষের অংশ গ্রহণ নেই, দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই, কৃষক-শ্রমিকের সম্পৃক্ততা নেই, পেশাজীবীদের সম্পৃক্ততা নেই, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর অনুষ্ঠান নেই, কবি-সাহিত্যিকের রচনা নেই, সরকারের প্রশাসনযন্ত্রের উপস্থিতি নেই, দেশজ সংস্কৃতি-কৃষ্টি-কালচারের ছিঁটেফোটা নেই; সেটা আবার কীভাবে সর্বজনীন উৎসব হয়? সেই উৎসব পালনে কেন এতো ডামাডোল? শীতের রাতে পুলিশবাহিনীর কেন এতো ঘাম ঝড়ানো? গভীর রাতে হোটেলে মদ খাওয়া পশ্চিমের ঠা-ার দেশে বিধর্মীদের উৎসব হতে পারে; আমাদের উৎসব হতে পারে না। কেন আমরা দেশের তরুণ-তরুণীদের বিকৃত মানসিকতা চর্চায় উৎসাহিত করছি? মধ্যরাতে অল্প কিছু মানুষের উন্মত্ততা, আতশবাজি পুড়িয়ে আকাশ বিদীর্ণ করা, বোমার ফাটিয়ে রাতের নিস্তব্ধতাকে বিচ্যুর্ণ করা কাঙ্খিত হতে পারে না।
মূলত পহেলা বৈশাখ বর্ষবরণ হলো আমাদের সার্বজনীন উৎসব। ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলা নববর্ষ পালনের কিছু ধারাবাহিক আনুসাঙ্গিকতা পালন করেন। চৈত্র সংক্রান্তি হাল-খাতা, জারি-সারি-পালা গানের আসর। বাড়িতে বাড়িতে নানা রঙের-আকারের পিঠা-পায়েশ। হিন্দু বাড়িতে চৈত্র সংক্রান্তির উৎসবে বিভিন্ন পিঠা, নাড়–, পায়েশ তৈরি হতো। গ্রামে আমাদের মা’য়েরা বাসায় সাধ্যমতো ভাল খাওয়ার আয়োজন করতেন। প্রবাদ ছিল ‘পহেলা বৈশাখে ভালভাল খাবার খেলে সারাবছর ভাল খাওয়া যায়’। বিভাজিত রাজনীতি আর অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে এখন কোনো উৎসবেই সার্বজনীনতার আমেজ নেই। ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে মধ্যরাতে ফুল দেই। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস ও ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে গভীর রাতে স্মৃতিসৌধে উপস্থিত হই। এগুলোর সঙ্গে আমাদের অস্তিত্ব জড়িত। হৃদয়ের ভালবাসা থেকে এসব পালন করি। কিন্তু পহেলা জানুয়ারি?
পহেলা বৈশাখ এখন আর আগের মতো পালিত হয় না। দিবসটি পালনে জারি-সারি-পালা গানের বদলে হয় পাশ্চাত্য ঢং-এ হয় রক-পপ-ব্যান্ড। পিঠা-পায়েসের বদলে পান্তা-ইলিশ। এ যেন গরীব মানুষের প্রতি বৃত্তবানদের উপহাস। ভ্যালেনটাইন ডে আর থার্টিফাস্ট পালন করে কিছু বিকৃত মানসিকতার লোক। বাংলাদেশে এসব উৎসব ২০ বছর আগেও দেখা যায়নি। আমাদের পূর্বপুরুষ তথা বাপ-দাদার চৌদ্দ গুষ্টি যা কোনো দিন দেখেনি-করেননি; সেটাই এখন আমাদের সংস্কৃতি উৎসব হয়ে গেছে! উৎসবের নামে গভীর রাতে সেকি উন্মাদনা! আমাদের সংস্কৃতিতে যাঁরা আদর্শ; সেই কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন, মুহম্মদ কুদরাত-ই-খুদা, আব্বাস উদ্দিন, হাসন রাজা, লালন ফকির, রবীন্দ্রনাথ, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লা, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন জীবনভর গবেষণা করে যার সন্ধান পাননি; সেই সংস্কৃতি নিয়ে আমরা নাচানাচি করছি। যুগে যুগে দেশে সমাজে পরিবর্তন আসে। আমরাও বিশ্বায়নের যুগে পরিবর্তন মানিয়ে নিচ্ছি। কিন্তু আধুনিকতার নামে, পশ্চাত্যের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে নিজেদের সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলছি। চিন্তা চেতনায় আধুনিক হচ্ছি বটে; কিন্তু চিন্তা চেতনায় আমরা কী কাজী নজরুল- ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, প্রিন্সিপ্যাল ইব্ররাহিম খা’র চেয়ে বেশি আধুনিক? থার্টিফাস্ট উদযাপনের নামে যে সংস্কৃতি চর্চা হচ্ছে; তা বন্ধ করতে না পারলে পশ্চাত্যের সংস্কৃতি একদিন আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি গিলে ফেলবে। যা হবে স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মহত্যার নামান্তর।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন