মোহাম্মদ আবদুল গফুর : দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল আরেকটি বছর ২০১৬। নতুন বছর ২০১৭-এরও ৫ দিন শেষ হয়ে যাবে আজ সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে। দুই দুই বার স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশকে এখন আর কোন বিচারেই শিশুরাষ্ট্রটি বলা যাবে না। তাই প্রশ্ন আসে, বাংলাদেশে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিত্তিরূপী গণতন্ত্র কতখানি মজবুত হতে পেরেছে? না পারলে, কেন, কাদের কারণে তা হতে পারছে না?
গণতন্ত্রকে যে আমাদের দেশের জনগণ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে তার প্রমাণ আমাদের ইতিহাস। আমাদের দেশের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অর্জন সাতচল্লিশ ও একাত্তরের স্বাধীনতা- এ দুই স্বাধীনতার মূলেই ছিল দুটি গণতান্ত্রিক নির্বাচন। একটি ১৯৪৬ সালের আরেকটি ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন। প্রথমটি ছিল অবিভক্ত ভারতবর্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে স্বতন্ত্র, স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। আর দ্বিতীয়টি (১৯৭০) ছিল ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের মর্মানুসারে বাংলাদেশের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার রায় ঘোষণা। জনগণের এই স্বাধিকার চেতনাকে টিক্কা বাহিনী পশুবলে ধ্বংস করে দেয়ার চেষ্টা করলে জনগণ জান কবুল করে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে নয় মাসের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে।
পাকিস্তান বাহিনীর হটকারিতার কারণে আমাদের সুদীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ নয় মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অতিবাহিত হতে বাধ্য হলেও অবশিষ্ট সময়টা এ সংগ্রাম পরিচালিত হয় নিয়ামতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক পন্থায়। ১৯৪৬ ও ১৯৭০ সালের দুটি ইতিহাস সৃষ্টিকারী সাধারণ নির্বাচন ছিল তার প্রকৃষ্টতম উদাহরণ। এ কারণে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচয়িতাগণ গণতন্ত্রের প্রতি বাংলাদেশের জনগণের এ গভীর সমর্থনের স্বীকৃতিস্বরূপ সংবিধানের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গণতন্ত্রকে নির্ধারণ করেন। সংবিধানে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গণতন্ত্রকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদানের মূলে ছিল গণতন্ত্রের প্রতি জনগণের অকুণ্ঠ আস্থা। গণতন্ত্রের প্রতি জনগণের এই নিরঙ্কুশ সমর্থনের কারণেই বাংলাদেশের অন্যান্য তিন মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা একাধিকবার সরকার কর্তৃক পরিবর্তিত হলেও গণতন্ত্রের গায়ে আঁচড় দিতে কোন সরকারই সাহস করেনি।
দুঃখের বিষয়, যে গণতন্ত্রের প্রতি জনগণের গভীর সমর্থনের ভয়ে কাগজে-কলমে কোন সরকার এর গায়ে আঁচড় দিতে সাহস করেনি সেই গণতন্ত্রকেই বাস্তবে সব চাইতে বেশী অবমূল্যায়িত করা হয়েছে। বাংলাদেশের চরম দুর্ভাগ্য, এ দুঃখজনক কাজটি শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের আমলেই। গণতন্ত্রের মর্যাদার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে দেশের সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে একটি মাত্র সরকারী দল রেখে দেশে একদলীয় বাকশালী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে গণতান্ত্রিক পন্থায় সরকার পরিবর্তনের সকল পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, এই একদলীয় বাকশালী ব্যবস্থার সুযোগ গ্রহণ করে পঁচাত্তরের বিয়োগান্ত ঘটনাবলীর নায়করা।
যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সারা জীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন তাকে একদলীয় বাকশালী ব্যবস্থা প্রবর্তনের দুর্বুদ্ধি কে দিয়েছিল তা প্রত্যক্ষভাবে জানা না গেলেও বাকশালের সমর্থক অন্যতম বাকশাল নেতা কম্যুনিস্ট পার্টির কমরেড মণি সিংহের বাকশালের সমর্থনে একটি উক্তি থেকে মনে হয়, এ ব্যাপারে তার ইন্ধন ছিল। মণি সিং বাকশালের সমর্থনে বলেছিলেন, বাকশাল কোন একাধিক একটি নাটিকা নয়, এটা বহু অংকের নাটক, এর শেষ অংকের শেষ দৃশ্য না দেখা পর্যন্ত এর মূল্যায়ন করা ঠিক হবে না। সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের আদলে একদলীয় সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাকশাল কায়েম করার পক্ষপাতী ছিলেন।
যাই হোক বহু দুঃখজনক ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে এক পর্যায়ে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। সেই ব্যবস্থাধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে একটি ক্ষমতাসীন সরকারকে সামরিক ক্যুর মাধ্যমে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে বসেন তদানীন্তন সেনা প্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সে সময়ে দুনিয়াকে অবাক করে দিয়ে ঐ সামরিক ক্যুর প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে বসেন আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা। আজ এই অদ্ভুত আচরণের স্বপক্ষে একটিই মাত্র কারণ খুঁজে পাওয়া যায় যে, সামরিক ক্যুর মাধ্যমে উৎখাত হওয়া ঐ নির্বাচিত সরকারের নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগের নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি। এর অর্থ দাঁড়ায়, নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের শাসনের চাইতে আওয়ামী লীগের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়েছিল সামরিক ক্যুর মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকারী জেনারেলের শাসন। বলা বাহুল্য, এটা গণতন্ত্র প্রীতির পরিচয় বহন করে না।
দেশের জনগণ জানেন, এর পর শুরু হয় জেনারেল এরশাদের দীর্ঘ স্বৈরাচারী শাসন। অন্যদিকে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এরশাদ সরকারের স্বৈর শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যায়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নবাগতা বেগম খালেদা জিয়া একটানা আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণের কাছে আপোষহীন নেত্রী হিসাবে আবির্ভুত হন। প্রথম দিকে আওয়ামী লীগ এরশাদবিরোধী আন্দোলনে উৎসাহ না দেখালেও পরবর্তীতে এক পর্যায়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেয়। এরশাদের দীর্ঘ শাসনের শেষ পর্যায়ে যখন সাধারণ নির্বাচনের প্রশ্ন ওঠে তখন দেশের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ঐক্যমতের ভিত্তিতে তদান্তীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যেমনটা আসা করা গিয়েছিল তেমান নির্বাচন খুব সুষ্ঠু-অবাধ ও নিরপেক্ষ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব ভোটকেন্দ্রে ভোটদান শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতাকালে বলেন, আমি সকল জেলার খবর নিয়েছি, নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু হয়েছে। আপনারা লক্ষ্য রাখবেন, ভোটে কেউ হেরে গিয়ে এর মধ্যে যেন আবার কারচুপি আবিষ্কার না করে। নির্বাচনের ভোট গণনা শেষে যখন দেখা গেল, আওয়ামী লীগ নয়, নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে বিএনপি তখন তিনি অবলীলাক্রমে বলে ফেললেন, নির্বাচনে সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে। এর অর্থ কী? অর্থ হচ্ছে, নির্বাচন যত সুষ্ঠুই হোক, তাতে যদি আওয়ামী লীগ বিজয়ী না হয়, তা হলে ধরে নিতেই হবে, নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। এটাও কিন্তু আওয়ামী লীগের গণতন্ত্র প্রীতির প্রমাণ বহন করে না।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মনে থাকার কথা, এরপর নির্বাচনে বিজয়ী হিসেবে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সরকার গঠন করেন এবং আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। খালেদা জিয়ার সরকারের আমলের শেষ দিকে প্রধানত শেখ হাসিনার দাবির মুখেই দেশের সকল জাতীয় নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের বিধান সংবিধানে গৃহীত হয়। সেই বিধান মোতাবেক দেশে পর পর বেশ কয়েকটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে পর পর দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জনগণের অবাধ ভোটে নির্বাচিত হয়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে। এতে প্রমাণিত হয়, বাংলাদেশের বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য বাস্তবতার নিরিখে এটাই সব চাইতে উৎকৃষ্ট পন্থা।
দুঃখের বিষয়, এক পর্যায়ে এক শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতানেত্রীর মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা-ক্ষুধা এই সুন্দর ব্যবস্থাটিকে পচিয়ে ফেলে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সুযোগ অসাংবিধানিক শক্তি ক্ষমতার আলিন্দে ঢুকে পড়ে সেনা সমর্থিত সরকারের নামে সেনা নিয়ন্ত্রিত এক অদ্ভুত সরকার গঠন করে। শুধু তাই নয়, তারা দেশের দুই প্রধান নেত্রীকে সংসদ চত্বরের দুই ভবনে আটক রেখে তথাকথিত মাইনাস টু ফর্মূলা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দুই প্রধান দলের নেতৃত্ব তথাকথিত সংস্কারপন্থীদের হাতে ন্যস্ত করার প্রচেষ্টা চালায়। সৌভাগ্যবশত দুই প্রধান দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের প্রবল বিরোধিতার ফলে এই চক্রান্ত ব্যর্থ হয়ে যায়।
এ পর্যায়ে দুই অবরুদ্ধ নেত্রীর অন্যতম শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন, তিনি ক্ষমতায় গেলে অসাংবিধানিক শক্তির সকল অবৈধ কর্মকা-কে বৈধতা দান করবেন। এর পর ঐ অসাংবিধানিক সরকারের অধীনে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাতে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। পরবর্তীকালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ৫ জানুয়ারি যে নির্বাচনের ঘোষণা দান করে তা বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সঙ্গে অতীতে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে যে সমঝোতা হয়েছিল তার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে বিএনপি ঐ নির্বাচন বয়কট করে। বিএনপি ঐ নির্বাচন বয়কট করায় নির্বাচন হয়ে পড়ে একটি নির্বাচনী প্রহসন। বিএনপি তো দূরের কথা আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মীও ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। কারণ তারা জানতেন, তারা না গেলেও তাদের ভোট প্রদানের ব্যবস্থা দলীয় নেতাকর্মীরা ঠিকই করবেন। আসলে হয়ও তাই। বিরোধী দলের ভোটারদের অনুপস্থিতির সুবাদে ক্ষমতাসীন দলের অল্পসংখ্যক নেতাকর্মীর মাধ্যমে ব্যালটপত্রে ইচ্ছামত সিল মেরে সরকারী দলের প্রার্থীদের পক্ষে প্রদত্ত ভোট সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে তোলার সুযোগ গ্রহণ করা হয়।
দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এই নির্বাচনে অংশ নেয়ার আগ্রহ অনুভব করেনি বলে জনগণ এই নির্বাচনের নাম দিয়েছে ভোটারবিহীন নির্বাচন। এই ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হয়েই বর্তমান সরকার ঘোষণা দেয় মেয়াদ শেষ হওয়ার একদিন আগেও দেশে আর নির্বাচন দেয়া হবে না। এই প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন হয়েও সরকার যে কোন রকম গ্লানিবোধ করছে, তা মনে হয় না। এই প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে নির্বাচিত হওয়ার পর জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই বলে আনন্দ প্রকাশ করেন যে, বিএনপি সংসদ নির্বাচন বয়কট করায় ভালই হয়েছে সংসদে তাদের কথা শুনতে হচ্ছে না। জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের সদস্যদের বক্তব্য সম্বন্ধে যাদের এ ধরনের মনোভাব তারা গণতন্ত্রের মর্মবাণীর প্রতি যে কতটা শ্রদ্ধাশীল তা সহজেই অনুমেয়। গণতন্ত্রের মূল মর্মবাণী হচ্ছে, বিরোধী মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করতে শেখা।
কেন প্রকৃত গণতন্ত্রে বিরোধী মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয় ? মানুষ যেমন ফেরেশতা নয়, তেমনি নয় ইবলিশ। মানুষের যেমন গুণ থাকে, তেমনি দোষও থাকে। সাধারণত মানুষ নিজের দোষ ধরতে পারে না, বুঝতে পারে না। অথচ দোষে-গুণেই মানুষ। নিজেরা আমরা নিজেদের দোষত্রুটি বুঝতে পারি না বলে যারা আমাদের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেয়, তারা প্রকৃতপক্ষে আমাদের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিয়ে সেগুলো সংশোধনের সুযোগ করে দেয়। সেই নিরিখে ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিয়ে বিরোধীরা আমাদের ত্রুটিমুক্ত করার কাজে সাহায্যই করে থাকে। চূড়ান্ত বিচারে তাই তারা আমাদের বন্ধুর কাজই করে থাকে। তাছাড়া এর মাধ্যমে সমাজকে অন্যায়মুক্ত করতেও তারা ভূমিকা পালন করে।
এসব কারণেই একটি দেশের শুধু রাষ্ট্রীয় পর্যায়েই নয়, সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত পর্যায়েও গণতান্ত্রিক মনোভাব ও পরিবেশের গুরুত্ব অত্যধিক। ধর্মীয় ও নৈতিক বিচারেও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। সকল ধর্মেই মানুষকে মহান স্রষ্টার সৃষ্টি হিসেবে স্রষ্টার উপাসনার পাশাপাশি স্রষ্টার সৃষ্টিকুলের প্রতি স্রষ্টাপ্রদত্ত দায়িত্ব পালন করতে হয়। এই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে মানুষ হিসেবে অনেক সময় ভুলত্রুটি হয়ে যেতেই পারে। মানুষ তার ভুলত্রুটি সম্বন্ধে অবহিত হতে পারে যদি সে তার নিজের সম্বন্ধে অন্যদের মূল্যায়নকে গুরুত্ব দিতে শেখে। নিজের সম্বন্ধে নিজের মূল্যায়ন অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক না হওয়ার আশঙ্কা। অন্যদের মূল্যায়নকে যদি আমরা যথাযথ গুরুত্ব দিতে পারি তবে অনেক অবাঞ্ছিত ত্রুটির উর্ধ্বে থেকে মহত্ত্বের আলোকে নিজেদের আলোকিত করে তুলতে পারি। এসব কারণেই নিজেদের বিভিন্ন কাজ ও আচরণ সম্বন্ধে অন্যদের মূল্যায়ন একেবারেই অপরিহার্য।
তবে যদি আমরা নিজেদের ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে মনে করে আমাদের সম্বন্ধে অন্যদের সমালোচনা বা মূল্যায়নকে অগ্রাহ্য করে চলাকেই আমাদের নীতি হিসেবে ধরে নেই তা হলে আমরা অবাস্তব পন্থা অনুসরণের কারণে এমন অবাঞ্ছিত বিপদ বা দুর্দশায় পতিত হতে পারি যার কথা আমরা পূর্বে কল্পনা করতে পারিনা। সুতরাং নিজেদের বৃহত্তর ও সমাজের বৃহত্তর স্বার্থেই বিরোধী মতামতকে আমাদের গুরুত্ব দেয়া উচিত। এসব কারণেই পবিত্র হাদিসে বলা হয়েছে, যে তোমার ভুল ধরিয়ে দেয় সে তোমার ভাই, কারণ সে তোমার ভুল ধরিয়ে দেয়ার মাধ্যমে তোমাকে ত্রুটিমুক্ত হতে সাহায্য করে।
আমাদের প্রিয় জন্মভূমিকে আমরা যদি একটি সত্যিকার আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে চাই তা হলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জোরদার করা এবং দেশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা বৃদ্ধি করার কোন বিকল্প নেই। তার পরিবর্তে দেশ পরিচালনার সুযোগকে আমরা যদি ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থসিদ্ধির অবলম্বন হিসেবে বিবেচনা করি তবে আমাদের দ্বারা দেশের সর্বনাশ ছাড়া অন্য কিছুই সাধিত হতে পারবে না। দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মজবুত রাখা দেশ ও দেশের জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে এ কারণেই অপরিহার্য। নতুন বছরের দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করাই হোক আমাদের সকলের পবিত্র সংকল্প।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন