মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

পাঠদানে দুর্বল শিশুদের নিয়ে সমস্যা

উপ-সম্পাদকীয়

| প্রকাশের সময় : ৮ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আফতাব চৌধুরী : প্রত্যেক শিক্ষক-শিক্ষিকা হয়তো লক্ষ্য করে থাকবেন, কিছু সংখ্যক ছাত্রছাত্রী আসে ক্লাছে, যারা স্লো-লার্নার বা পড়াশোনায় পিছিয়ে। তারা সম্পূর্ণ অমনোযোগী না হলেও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পাঠ যেন ঠিকঠাকভাবে বুঝে উঠছে না। তারা হয়তো মনোযোগ দিয়েই পাঠ শুনছে, কিন্তু তাদের চাহনি দেখে বোঝা যাচ্ছে তাদের স্মৃতি-দুর্বলতা এবং আলোচ্য বিষয়বস্তু তাদের বোধগম্য হচ্ছে না। হালে সর্বশিক্ষার দৌলতে ও সরকার শিক্ষা আবশ্যিক করায় সমাজের সর্বস্তরের শিশু বিদ্যালয়ে পড়ার জন্য ভিড় করছে। ফলে পিছিয়ে পড়া শিশু বিদ্যার্থীদের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। একদিকে ভিড়ে ভিড়াক্কার ক্লাসগুলো, অন্যদিকে আনুপাতিক শিক্ষক-শিক্ষকার অপ্রতুলতা এবং স্থান সঙ্কুুলানের অভাবের দরুন এ সমস্যা আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। অথচ তাদের সমবয়সী কিছু সংখ্যক বিদ্যার্থী অতি সহজে একই পাঠ গ্রহণ করে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে। এক শ্রেণির শিক্ষক-শিক্ষিকা আছেন যারা কেবল ওইসব মেধাসম্পন্ন বিদ্যার্থীকে নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছেন। পিছিয়েপড়া শিশুদের প্রতি যতটা দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন ততটা দিচ্ছেন না। এই শিক্ষক-শিক্ষিকা বিদ্যার্থীদের অনেকটা যেন শূন্য বোতল ভেবে বিদ্যার পানি ঢেলে যাচ্ছেন। সেই পানি কিছু কিছু বোতলের ভেতরে যাচ্ছে আর বাকিগুলোতে অল্প-স্বল্প গেলেও বাইরেই সব গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে। বর্ষশেষে সবগুলো বোতলই যথারীতি সিল্ড হয়ে যাচ্ছে। ফলে এই সমস্ত পিছিয়েপড়া বিদ্যার্থীর সংখ্যা-সমস্যা আরও জটিলতর হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
পিছিয়েপড়া বিদ্যার্থীরাই হচ্ছে-স্লো-লার্নার। দেখা গেছে, ওই সমস্ত শিশু তাদের সমবয়সী সতীর্থদের মতো পড়াশোনায় ততটা অগ্রগতি দেখাতে পারছে না, এমনকি তারা ক্লাসে পড়াশোনা বুঝে উঠতেও পারছে না। তারা হয় স্থ’ূলবুদ্ধিসম্পন্ন অথবা তাদের ধী-শক্তির অভাবের জন্য তাদের এগিয়ে যাওয়া এভাবে বিঘিœত হচ্ছে। তবে এ-ও লক্ষ্য করা গেছে, সবক্ষেত্রে ধী-শক্তির অভাবে যে বিদ্যার্থীরা পিছিয়ে যাচ্ছে তা বিবেচনা করা ঠিক হবে না। এমন বিদ্যার্থীরা আছে যারা যথেষ্ট বুদ্ধিদীপ্ত ও মেধাসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও অনেক সময় ক্লাসে পিছিয়ে থাকে। তাই বিদ্যালয়ে এই দুশ্রেণির পিছিয়েপড়া বিদ্যার্থীদের উপস্থিতি রয়েছে। মেধাবী বিদ্যার্র্থীদের পিছিয়ে পড়ার কারণ- তারা হয়তো বা চাকরিজীবী পিতার ঘন ঘন বদলিতে স্থান ও বিদ্যালয় পরিবর্তন অথবা নতুন বিদ্যালয়ে নতুন পাঠ্যক্রম অথবা ক্লাসে অনেক এগিয়ে যাওয়া পাঠ। এই অগ্রগতির অনুসরণে অসমর্থতার দরুন স্বাভাবিকভাবেই এই শ্রেণির বিদ্যার্থীরা ক্লাসে পিছিয়ে পড়ছে। তাছাড়া এমন কতগুলো পরিবার আছে যেখানে শান্তির সুবাতাস নেই। শিশুর সামনে মা-বাবার অন্তহীন বিবাদজনিত অনভিপ্রেত পরিবেশ। এই দুঃসহ পরিবেশে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে অসহায় শিশুটি মা-বাবার রুদ্রমূর্তির দিকে। এ অবস্থায় শিশুমন থাকে প্রতিনিয়ত শঙ্কিত। ভুগতে থাকে নিরাপত্তার অভাবে। তার প্রভাব শিশুমনে হয় নেতিবাচক। দেখা দেয় জঠিল ভাবনা যা ভাসতে থাকে তার মনে হিমশৈলের মতো। সৃষ্টি হয় মানসিক ও শারীরিক সমস্যা যার উপস্থিতি বাইরে থেকে অননুমেয়। এক অসহায় ভাব আচ্ছন্ন করে তার জীবনকে। স্বভাবতই তখন সে হারিয়ে ফেলে মানসিক ধৈর্য। তিরোহিত হয় তার হাসি, আনন্দ, আকাক্সক্ষা ও পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ। তার সেই অশান্ত মানসিক অবস্থায় সে ধীরে ধীরে পরিণত হয় স্থূলবুদ্ধিসম্পন্ন পড়াশোনায় পিছিয়েপড়া শিশুতে। সৃষ্টি হয় তার মধ্যে হতাশা ও ব্যর্থতাবোধ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মা-বাবার চিন্তাহীনতা, অযতœ, অবহেলা, অন্ধ ভালোবাসা এবং মাত্রাধিক প্রশ্রয় পেয়ে মেধাসম্পন্ন শিশু বখাটে হয়ে ওঠে। সংখ্যায় কম হলেও ক্লাসে থাকে আরও একশ্রেণির শিশু বিদ্যার্থী যারা যথার্থই ব্লান্ট্ বা নিরেট। প্রকৃত সমস্যা হচ্ছে তাদের নিয়ে।
    এই সমস্যা নিরসনকল্পে কিছু সমাধানসূচক পরামর্শ দেয়া যেতে পারে। এ ব্যাপারে বিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ও গৃহে মা-বাবা এবং অভিভাবকদের সবিশেষ মনোযোগ, সমবেদনা ও সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষিকাই হোন বা অভিভাবকই হোন এ জাতীয় ছাত্রছাত্রীদের কী সমস্যা, কেন তারা অপারগ, কোথায় তাদের গলদ সে সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত হতে হবে। প্রথমত ক্লাসে প্রখর দৃষ্টি দিয়ে পিছিয়েপড়া বিদ্যার্থীদের চিহ্নিত করতে হবে। এ কাজটা হয়তো সব শিক্ষক-শিক্ষিকার দ্বারা সম্ভব না-ও হতে পারে। তার জন্য প্রয়োজন হবে অভিজ্ঞ দক্ষ শিক্ষক-শিক্ষিকার। তারাই উল্লেখিত দু’শ্রেণির পিছিয়েপড়া বিদ্যার্থীদের চিহ্নিত করে তাদের সমস্যাগুলো পৃথকভাবে ব্যক্তিগত আলোচনার মাধ্যমে জেনে নেবেন। এভাবে সমস্যা জানার পর তারা প্রত্যেক বিষয় শিক্ষকদের সমস্যাগুলোসহ নির্দিষ্ট বিদ্যার্থীদের পরিচয় করিয়ে দেবেন। বিদ্যালয় প্রধানদেরও এ ব্যাপারে অবহিত করতে হবে যাতে তারা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বিশেষ দৃষ্টি ও সহায়তার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে সমর্থ হন। এভাবে সব শিক্ষক-শিক্ষিকার সজাগ দৃষ্টি আকর্ষিত হলে শিশুরা রুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি পাবে ও তাদের অগ্রগতির পথ সুগম হবে। বিদ্যার্থীদের সঙ্গে পৃথক পৃথকভাবে সমস্যানুসন্ধানের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে এজন্য, কারণ বিদ্যার্থীরা বিশেষ করে প্রান্তীয় শিশু বিদ্যার্থীরা নিজেদের ব্যক্তিগত সমস্যা সবার সামনে প্রকাশ করতে অনেক সময় সংকোচ বোধ করে। শুধু শিক্ষক-শিক্ষিকা নয়, বাড়িতে অভিভাবকদেরও দায়িত্ব রয়ে গেছে। মা-বাবাকে শুধু নিজেদের সমস্যা এবং কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকলেই চলবে না, শিশুদের সমস্যা কোথায় তা জেনে নিতে হবে এবং তা জানার কোন চেষ্টা না করে পড়াশোনায় পিছিয়ে যাবার দরুন শিশুদের শুধু গালিগালাজ এবং সময় সময় রূঢ় ব্যবহার করে অথবা শিশুর অবনতির জন্য বিদ্যালয়কে দোষারোপ করে কোনো লাভ হবে না। তারা শিশুদের নিরাপত্তার মোড়কে বেঁধে রাখলেও তাদের অগ্রগতির খোঁজখবর রাখেন না। সপ্তাহ শেষে হাতে ধরে ‘বাজার’ থেকে আকর্ষণীয় জিনিস কিনে দিলেই শিশুমন তুষ্ট হয় না। মা-বাবাকে শিশুর জন্য কিছুটা সময় অতিবাহিত করতে হবে, তাকে নিয়ে বসতে হবে। অত্যন্ত সংবেদনশীল মন নিয়ে ধৈর্য সহকারে এগোতে হবে এবং তাদের সমস্যাগুলো জেনে বিদ্যালয়ের বিষয় শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। তা হলেই দেখা যাবে শিশুদের পড়াশোনায় অগ্রগতি হচ্ছে। শিশুটি যখন জানবে যে তার মা-বাবার সঙ্গে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সংযোগ ও সুসম্পর্ক রয়েছে, সেই শিশুটি তখন মনোযোগী হবে এবং শিখবেও ভালো। এ জাতীয় সংযোগ সমন্বয় এদের ক্ষেত্রে বিশেষ জরুরি। এগুলোই হচ্ছে সমস্যা সমাধানের প্রাথমিক প্রস্তুতি। শুধু আলোচনার সব ক্ষেত্রে পিছিয়েপড়া শিশুদের সমস্যা সম্বন্ধে সঠিক দিশা দিতে যথেষ্ট না-ও হতে পারে। নিরূপিত করতে হবে অসমর্থতার কারণগুলো। স্থূলবুদ্ধিসম্পন্ন পিছিয়েপড়া বিদ্যার্থীদের ব্যক্তিগত টেস্টিংয়ের প্রয়োজন হবে। এই অনুসন্ধানী পরীক্ষা হবে মৌখিক। গ্রুপ টেস্টিং এ বিদ্যার্থী কতটুকু পিছিয়ে আছে তা সঠিকভাবে ধরা পড়বে না। রোগ যথাযথভাবে নিরূপিত না হলে রোগের সমাধান হবে না। তাই এ টেস্টিং হবে সহজ-সরল ও অনুসন্ধানমূলক। বিদ্যার্থীদের জ্ঞান নয়, তারা কতটুকু পিছিয়ে আছে সেটা জানাই এই পরীক্ষার আসল উদ্দেশ্য। চিহ্নিত শিশুগুলোর ওপর নজর রাখতে হবে প্রতিনিয়ত। সম্ভব হলে এ জাতীয় বিদ্যার্থীর একই সঙ্গে ক্লাস একত্রে বসাবার ব্যবস্থা করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে।
দৈনিক পাঠদানের সময় শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিজেদের নির্দিষ্ট আসন ছেড়ে এই শিশুদের মাঝে এসে তারা কতটুকু পাঠ গ্রহণ করতে পেরেছে তা যাচাই করতে হবে। তাদের অসমর্থতা নজরে আসলে ধৈর্য সহকারে পুনর্বার বলে ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে এবং তাদের সুপ্ত আগ্রহ মনোযোগ ও অনুরাগ জাগিয়ে তুলতে হবে। তাদের বিফলতার ওপর কোনো বিরূপ মন্তব্য চলবে না। ক্লাসের সফল ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তুলনা থেকে বিরত থাকতে হবে। বাড়িতেও মা-বাবার তাদের অন্য শিশুদের সঙ্গে তুলনা সমাচীন হবে না। এ রকম শিশুদের অনবরত অনুশীলন, প্রেরণা ও উৎসাহ দিয়ে উদ্দীপিত করতে হবে। যতটুকু এগোবে তার জন্য প্রশংসা এবং বাহবা দিতে হবে। দেখা যাবে আস্তে আস্তে তাদের আত্মপ্রত্যয় ও পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ গড়ে উঠেছে। তাড়াহুড়ো করলে চলবে না। একটা পাঠ ধাতস্থ হলেই তবে পরবর্তী অধ্যায়ে যেতে হবে। তার জন্য সংবেদনশীল শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বিরামহীন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন হবে। জন্মগত স্থূলবুদ্ধির শিশুদের ক্ষেত্রে সমস্যাটা অধিকতর জটিল হলেও একবার যদি তাদের আগ্রহ ও আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলা যায় তা হলে তারাও যথেষ্ট এগিয়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে ধৈর্যশীল  শিক্ষক-শিক্ষিকার ও বাড়িতে মা-বাবার উৎসাহ, সহায়তা এবং প্রশংসাই ফলপ্রসূ ওষুধ।
 এই পিছিয়েপড়া সমস্যা প্রায়-সব বিদ্যালয়েই কমবেশি আছে। সবমিলে এ জাতীয় শিশু বিদ্যার্থীর সংখ্যা নিতান্ত নগন্য হবে না। কাজেই তাদের অবহেলা করা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বিদ্যাদাতাদের সম্পূর্ণ অনুচিত। তবে বর্তমান ক্লাসগুলোর ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই অবস্থায় যে তরির আবহে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া অত্যন্ত দুরূহ। সরকার যদি সত্যিসত্যিই সবার শিক্ষার অগ্রগতি কামনা করে তা হলে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। স্কুলগুলোর পরিকাঠামো সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যার্থীদের সংখ্যা আনুপাতিক শিক্ষক-শিক্ষিকার নিযুক্তিও দিতে হবে। তা হলে পিছিয়েপড়া বিদ্যার্থীদের প্রতি অতিরিক্ত নজর দেয়া সম্ভব হবে। কোনও কোনও মহল থেকে এই সমস্যা সমাধান, বিদ্যালয়ে ছুটির পর অতিরিক্ত ক্লাস করার পরামর্শের কথা উঠে আসছে। প্রকৃতপক্ষে এভাবে সমাধান সম্ভবপর হবে না। কেননা সারাদিন ক্লাস নেয়ার পর অতিরিক্ত ক্লাস নেয়া শিক্ষক-শিক্ষিকার ক্ষেত্রে যেরূপ-ক্লান্তিকর, ছুটির পর অতিরিক্ত ক্লাসে বসে পাঠ নেয়াও শিশু বিদ্যার্থীদের পক্ষে বিরক্তিকর। যে সমস্ত শিশু মনসংযোগের ও ধী-শক্তির অভাবে পিছিয়ে পড়েছে, তারা ক্লান্ত এবং বিরক্তিকর মানসিক অবস্থায় অতিরিক্ত ক্লাসে মনোযোগ দিয়ে পাঠ নেবে, সেটা আর যাই হোক বাস্তব চিন্তা নয়। কাজেই এই সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন শিক্ষক-অভিভাবক ও সরকারের সদিচ্ছার সমন্বয়। একটা পাখি যেভাবে তার হৃদয় ও পাখা দু’টির সমস্বয় ছাড়া আকাশে উড়তে পারে না, ঠিক সেইরূপ শিক্ষক-অভিভাবক ও সরকারের সদিচ্ছা ছাড়া এ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হবে না।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন