বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

জান-মাল ও ইজ্জত সংরক্ষণে রাসূল সা.-এর শিক্ষা

| প্রকাশের সময় : ৮ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান

॥ এক ॥
মানুষের জান-মাল ও ‘ইজ্জত সংক্ষরণের প্রকৃত মালিক মহান আল্লাহ্। তিনিই তার প্রতিটি জীবনের সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। রাসূলুলাহ্ (সা.) বলেন, “জীবনদাতা আল্লাহ্, মানুষ তো একটি পিপড়ার ডানা সৃষ্টিরও ক্ষমতা রাখে না; অতএব, যে মানুষ সৃষ্টি করতে পারে না তার পক্ষে অন্যের জান হরণের কি অধিকার থাকতে পারে?” জীবনের নিরাপত্তা লাভ মানুষের জন্য অতীব প্রয়োজন। যার জীবনের নিরাপত্তা নেই তার অন্য কোনো অধিকার লাভের প্রশ্নই ওঠে না। বেঁচে থাকলে তবেই তো অন্য সকল অধিকার ভোগ করার প্রশ্ন আসে। প্রত্যেক দেশে প্রত্যেক যুগেই এক শ্রেণীর মানুষ অন্য মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। দুর্বৃত্তদের হাতে জান হারাচ্ছে বহুসংখ্যক মানুষ, পঙ্গু ও বিকলাঙ্গ হচ্ছে বহুসংখ্যক জীবন। অন্ধকার কারা-প্রকোষ্ঠে দুঃসহ জীবনযাপন করছে বহু নিরাপরাধ নারী-পুরুষ। বর্তমান বিজ্ঞানের উন্নতির যুগেও প্রতিনিয়ত এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। ইসলাম পূর্ব যুগে সমাজব্যবস্থায় অন্যের মাল-সম্পদ আত্মসাৎ করা কোনো দূষণীয় কাজ বলে গণ্য হতো না। চুরি-ডাকাতি ও দস্যুতা পুরা সমাজকে গ্রাস করে ফেলেছিল। আর মাল-সম্পদের নিরাপত্তার অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকারসমূহের মধ্যে অন্যতম একটি অধিকার। সমাজ উন্নয়নে এর গুরুত্ব অপরিসীম। তাই রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ঘোষণা করলেন, “যদি কোনো ব্যক্তি কারো এক বিগত জমিও জবর-দখল করে নেয় তাহলে কিয়ামতের দিন তার গলায় সাত স্তর জমিন ঝুলিয়ে দেয়া হবে।” ‘ইজ্জতের নিরাপত্তা মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্যতম। যে সমাজে মানুষের এ গুরুত্বপূর্ণ ‘ইজ্জতের কোনোরূপ নিরাপত্তা ছিল না, মানুষের ‘ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হতো, সে সমাজে রাসূলল্লাহ্ (সা.)-এর আমূল সংস্কারে মানবতা লাভ করেছে পরিপূর্ণভাবে ‘ইজ্জত ও সম্মানের নিরাপত্তাপূর্ণ সম্মান। ইসলাম মানুষের জান-মাল ও ‘ইজ্জতের সংরক্ষণের তাকিদ দিয়েছে। হজরত আবূ হুরায়রা (রা.) রাসূলুল্লাহ্ (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, “তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজ বর্জন কর। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ্! সেগুলো কি কি? রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বললেন, ১. আল্লাহ্র সাথে শরিক করা, ২. জাদুটোনা করা, ৩. যথাযথ কারণ ব্যতীত কাউকে হত্যা করা, যা আল্লাহ্ হারাম করেছেন, ৪. সুদ খাওয়া, ৫. ইয়াতীমের সম্পদ ভক্ষণ করা, ৬. যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করা, ৭. সতি-সাধ্বী নারীর প্রতি ব্যভিচারের অপবাদ প্রমাণ করা” (সহীহুল বুখারী, বাবু কাওলিল্লাহ্ তা‘আলা : ইন্নাল্লাযীনা ইয়াকুলূনা আমওয়ালা..., হাদিস নং ২৫৬০, বাবু রামইয়াল মুহসানাতি ..., হাদিস নং ৬৩৫১; সহীহ মুসলিম, বাবু বায়ানিল কাবাইর ওয়া আকবারিহা, হাদিস নং ১৪৫ (৮৯), পৃ. ৬০; সুনানু আবী দাউদ, বাবু মাজাআ ফিত্-তাশদীদি ফী আকলিল মালিল ইয়াতীম, হাদিস নং ২৮৭৪, পৃ. ৫৮৯; সুনানুন্-নাসা’ঈ, হাদীস নং ৩৬১১)।
জান সংরক্ষণ
ইসলাম মানুষের জান হরণকে অত্যন্ত কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। অন্যায়ভাবে একজন মানুষকে হত্যা করা সকল মানুষকে হত্যা করার শামিল। হত্যাকারী আল্লাহ্র নিকট অভিশপ্ত, ক্রোধভাজন ও জাহান্নামী। আত্মঘাতী হামলা করাও শরী‘আতে নিষিদ্ধ। এ ধরনের কাজ ইসলাম সমর্থন করে না। শুধু তাই নয়, কোনো মানুষকে ভীতি প্রদর্শন করাও ইসলামে হারাম। নিরপরাধ মানুষ হত্যা সম্পর্কে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন, “যে ব্যক্তি কাউকে কোনো হত্যার পরিবর্তে কিংবা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি ছাড়া অন্য কোনো কারণে হত্যা করে, সে যেন সমস্ত মানুষকে হত্যা করল। আর যে কারো জান রক্ষা করল সে যেন সব মানুষের জীবন রক্ষা করল” (সূরা মায়েদা : ৫ : ৩২)।
এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, পৃথিবীর মানব জাতির সংরক্ষণ ও স্থায়িত্ব নির্ভর করে মানুষের মনে পারস্পরিক মর্যাদাবোধ পুরোপুরি বিদ্যমান থাকার উপর। সাথে সাথে একে অপরের জান রক্ষা ও স্থিতির ব্যাপারে পরস্পর সাহায্যকারী হওয়ার মানসিকতা পূর্ণ মাত্রায় বজায় থাকা আবশ্যক। যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কারো প্রাণ সংহার করে সে সমগ্র মানবতার দুশমন। কেননা তার মধ্যে যে দোষ-ত্রুটি পাওয়া যায় তা যদি সকল মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে গোটা মানব জাতির ধ্বংস অনিবার্য। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি মানুষের জান রক্ষার ব্যাপারে সাহায্য করে সে প্রকৃতপক্ষে মানবতারই বন্ধু ও সাহায্যকারী। কেননা সে গুণে মানবতার স্থিতি ও সুরক্ষা নির্ভরশীল তার মধ্যে তা পুরোপুরি বিদ্যমান।
আল্লাহ্ তা‘আলা পরস্পরে জান হরণ করা নিষেধ করে বলেন, “তোমরা নিজেরা পরস্পরকে হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তোমাদের প্রতি দয়াশীল” (সূরা নিসা’ : ৪ : ২৯)। অপর আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা আরো বলেন, “যার হত্যাকে আল্লাহ্ নিষিদ্ধ করেছেন, যথার্থ কারণ ছাড়া তোমরা তাকে হত্যা করো না” (সূরা বনী ইসরাঈল : ৩৩)।
যে সকল ব্যক্তিকে হত্যা করা আল্লাহ্ তা‘আলা হারাম করেছেন তারা হচ্ছে মুসলিম ব্যক্তি, চুক্তিবদ্ধ কাফির, জিম্মী এবং নিরাপত্তাপ্রাপ্ত ব্যক্তি। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি কোনো চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তির জান হরণ করবে সে জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না” (সহীহুল বুখারী, বাবু ইসমি মান কাতালা মু‘আহাদান বিগায়রি জুরমিন, হাদীস নং ২৯৩০, ৬৪০৩; সুনানু ইব্ন মাজাহ্, বাবু মান কাতালা মু‘আহিদান, হাদীস নং ২৬৮৬)
ইসলাম অন্যায়ভাবে নির্দোষ ও নিরাপরাধ ব্যক্তির জান হরণ করাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।
“আব্দুল্লাহ্ ইব্ন মাস‘উদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলল্লাহ্ (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ‘ব্যভিচার, হত্যা এবং ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাওয়া অপরাধ ব্যতীত আল্লাহ্ ও রাসূলে বিশ্বাসী কোনো মানুষকে হত্যা করা বৈধ নয়” (সহীহুল বুখারী, বাবু কাওলিল্লাহি তা‘আলা : ইন্নান্-নাফসা বিন্-নাফসি .., হাদীস নং ৬৩৭০; সহীহ মুসলিম, বাবু মাইউবাহু বিহি দামুল-মুসলিমি, হাদীস নং ৩১৭৫; সুনানু আবী দাউদ, বাবুল হুকমি ফীমান ইরতাদ্দা, হাদীস নং ৪৩৫৪, পৃ. ৮৬০; জামি‘উত্-তিরমিযী, বাবু মাজাআ লা ইহিলু দামু ..., হাদীস নং ১৩২২; সুনানু ইব্ন মাজাহ্, বাবু লা ইয়াহিলু দামু ইমরিইন মুসলিমিন ইল্লাহ্ ফী সালাসাতিন, হাদীস নং ২৫২৫; মুসনাদু আহ্মাদ, হাদীস নং ৩৪৩৮)।
রাসূলুল্লাহ্ (সা.) মানব জীবনের নিরাপত্তাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি মানুষের জান হরণকে অত্যন্ত কঠোর ভাষায় নিন্দা করেছেন। হজরত ‘আব্দুল্লাহ্ ইব্ন ‘আমর (রা.) রাসূলুল্লাহ্ (সা.) থেকে বর্ণনা করেন যে, “আল্লাহ্র নিকট সারা দুনিয়া ধ্বংস হওয়ার চেয়েও গুরুতর বিষয় হচ্ছে মুসলিমকে হত্যা করা” (জামি‘উত্-তিরমিযী, বাবু মাজাআ ফী তাশদীদি কাতলিল মু’মিন, হাদীস নং ১৩১৫; সুনানুন্-নাসা’ঈ, কিতাবুত্-তাহরীম, বাবু তা’যীমুদ্-দাম, হাদীস নং ৩৯২২)।
হজরত উবাদা ইবনুস্ সামিত (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কোনো মু’মিন ব্যক্তিকে হত্যা করবে, আল্লাহ্ তা‘আলা তার কোনো নফল ও ফরজ ‘ইবাদাত কবুল করবেন না” (সুনানু আবী দাউদ, বাবু ফী তা‘যীমি কাতলিল-মু’মিনি, হাদীস নং ৪২৭০, পৃ. ৮৪৩)।
হযরত আবূদ্-দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন, “মু’মিন ব্যক্তি নেক্কার হিসাবে বিদ্যমান থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা না করবে” (সুনানু আবী দাউদ, বাবু ফী তা‘যীমি কাতলিল-মু’মিনি, হাদীস নং ৪২৭০, পৃ. ৮৪৩)।
হজরত আব্দুল্লাহ্ ইব্ন মাস‘উদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন, “মুসলমানকে গালি দেয়া ফাসিকী এবং হত্যা করা কুফরী” (সহীহুল বুখারী, বাবু ইত্তিবা‘উল জানাইঝি মিনাল ঈমান, হাদীস নং ৪৬, বাবু মা ইয়ানহা মিনাস্-সিবাবি ওয়াললা‘নি, হাদীস নং ৫৫৮৪, বাবু কাওলিন্-নাবিয়্যে (সা.), লা তারজি‘উ..., হাদীস নং ৬৫৩৯; সহীহ মুসলিম, বাবু বায়ানি কাওলিন্-নাবিয়্যে (সা.) সাবাবি ..., হাদীস নং ৯৭; জামি‘উত্-তিরমিযী, বাবু মাজা‘আ সিবাবুল মু’মিনি ফুসূকুন, হাদীস নং ২৫৫৯; সুনানুন্-নাসা’ঈ, কিতালুল মুসলিমি, হাদীস নং ৪০৩৯; সুনানু ইব্ন মাজাহ্, বাবু সিবাবুল মুসলিমি .., হাদীস নং ৩৯২৯)।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন