মোবায়েদুর রহমান : বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বাপর নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। গত ৪৫ বছর ধরেই লেখালেখি হচ্ছে। ভবিষ্যতেও হবে। আমার কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ওপর অসংখ্য ডকুমেন্ট আছে। মুক্তিযুদ্ধ, আওয়ামী লীগের ভূমিকা, শেখ মুজিবের ভূমিকা, আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন (আজকের রাশিয়া), চীন, ভারত প্রভৃতি দেশের ভূমিকা ইত্যাদি সম্পর্কে রয়েছে অনেক পেপার ক্লিপিং, গ্রন্থ, ক্লাসিফায়েড পেপারস ইত্যাদি। এমনকি ’৭০-এর নির্বাচন থেকে শুরু করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান সমস্ত রাজনৈতিক দল ও নেতার ভূমিকা নিয়ে গ্রন্থিত পেপার কার্টিং, পুস্তকও রয়েছে। হাল আমলে মইদুল হাসান, এ কে খন্দকার, শর্মিলা বসু, জে এন দীক্ষিতসহ অনেকের পুস্তকও রয়েছে। কিন্তু আমার পাঠক-পাঠিকা ভাইবোনেরা হয়তো লক্ষ্য করেছেন যে, এ বিষয়টি নিয়ে আমি বলতে গেলে লিখিই না। কী হবে এসব লিখে? বাংলাদেশ একটি কঠোর বাস্তবতা। তেমনি ভারতও একটি কঠোর বাস্তবতা। আমি তো মনে করি, এসব ইতিহাস, যার কিছু কিছু আবার বিতর্কিতও বটে, না লিখে, সেসবের ওপর এনার্জি খরচ না করে, আমরা বরং সামনের দিকে তাকাই। বাংলাদেশে বসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পিন্ডি না চটকিয়ে বরং দেখি, সেই দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। মতামত প্রকাশের কি অবাধ স্বাধীনতা। ডোনাল্ড ট্রাম্পের নারী কেলেঙ্কারি নিয়ে কত কথাই না বলা হলো। তার জন্য একজন মার্কিনির বিরুদ্ধেও কি মামলা হয়েছে? একজনকেও কি গ্রেফতার করা হয়েছে? নিউইয়র্কে থাকাকালে আমি দু-চারটি নামকরা পত্রিকায় পড়েছি, হিলারি ক্লিনটন নাকি মধ্য বয়সে সমকামী ছিলেন। বিল ক্লিনটন যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখন তার হাঁটুর বয়সী মনিকা লিওনস্কির সাথে তার সেক্স স্ক্যান্ডাল নিয়ে তুলকালাম হয়েছে। কই, একজনের বিরুদ্ধেও তো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি।
এগুলো শুধু একবিংশ শতাব্দীর কথা নয়। ৬০-এর দশকে প্রেসিডেন্ট কেনেডি এবং দুনিয়া কাঁপানো ফিল্ম স্টার মেরিলিন মনরোর গোপন অভিসার নিয়েও তো কম কথা হয়নি। ভøাদিমির পুতিন রাশিয়ার তিনবারের নির্বাচিত রাষ্ট্রনায়ক। তিনি এখন সিটিং প্রেসিডেন্ট। তার তরুণী প্রেমিকাকে নিয়ে কি কথা হচ্ছে না? যাদের কথা এতক্ষণ বললাম, তারা কেউই এসব কেচ্ছা কাহিনী প্রকাশ এবং প্রচারের জন্য কারো বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশন নেননি। এই তো দুই-তিন দিন আগে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে তুলাধোনা করলেন। বললেন যে, বিমানে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কি সাংঘাতিক অভিযোগ। অথচ নরেন্দ্র মোদি সে জন্য মমতা ব্যানার্জিকে বরখাস্ত করে পশ্চিমবঙ্গে প্রেসিডেন্টের শাসন জারি করেননি। বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের ভূমিকা নিয়ে এদেশের লোকের প্রচুর অভিযোগ রয়েছে ! আমারও রয়েছে। আমি মনে করি, ভারত বাংলাদেশকে শোষণ করছে। এ সম্পর্কে ২৭ বছর ধরে আমি লেখালেখি করছি। সেটা একটি দিক। কিন্তু তাই বলে ভারত, ইংল্যান্ড, আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ার অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের যে অবাধ চর্চা এবং প্রবাহ রয়েছে সেটিকে তো অস্বীকার করতে পারি না। এসবের বিপরীতে বাংলাদেশে আমরা কি দেখছি? দিনের পর দিন এখানে গণতন্ত্র সঙ্কুচিত হচ্ছে। এখন এদেশে মিটিং-মিছিল করা যায় না। মিটিং করতে গেলে পারমিশন লাগে। পারমিশন চাইলে পারমিশন দেওয়া হয় না। তাই রাজনৈতিক তৎপরতা দমনের জন্য এখন আর লাঠিচার্জ বা টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ নয়, একেবারে সরাসরি গুলি। তাই আমি মনে করি, অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করে ভবিষ্যতের দিকে তাকাই। অবাধ ও নির্ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করি। বাক-স্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা নিশ্চিত করি।
॥ দ্ইু ॥
এত কিছু বলার পরেও আমি অতীতের দিকে তাকাচ্ছি। আর সেটি করতে হচ্ছে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হেনরি কিসিঞ্জারের একটি উক্তি উপলক্ষ করে। খবরে প্রকাশ, সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ‘আটলান্টিক’-এর চিফ এডিটর রেফরি গোল্ডকর্পকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে নাকি পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান সাবেক পূর্ব পাকিস্তানকে (বর্তমান বাংলাদেশকে) স্বাধীনতা দিতে চেয়েছিলেন। এ সম্পর্কে ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে তিনি, অর্থাৎ ইয়াহিয়া খান, নাকি তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের কাছে ওয়াদা করেছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৫ বছর পর ড. হেনরি কিসিঞ্জার এমন একটি উক্তি করলেন। এই উত্তিটিকে চাঞ্চল্যকর বলা যেত। কিন্তু ৪৫ বছর পর এমন একটি অশ্রুতপূর্ব উক্তি আর চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে না। বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকা যতদূর ঘাঁটাঘাঁটি করেছি, সেখান থেকে দেখতে পাচ্ছি যে, কিসিঞ্জারের এই ইন্টারভিউ এখানে তেমন একটি প্রচার পায়নি। পেলে হয়তো আলোচনা বা সমালোচনার ঝড় উঠত। তবে পাকিস্তানের ‘জিও টিভি’র নির্বাহী সম্পাদক এবং বহুল প্রচারিত উর্দু দৈনিক জং-এর কলামিস্ট হামিদ মীর এ সম্পর্কে একটি কড়া সমালোচনামূলক কলাম লিখেছেন। হামিদ মীরের অনেক বক্তব্যের সাথে আমিও একমত। কিসিঞ্জারের ওই উক্তি পড়ে আমার মনে যেসব প্রশ্নের উদয় হয়েছে, সেগুলো নিম্নরূপ :
(১) যদি ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশকে স্বাধীনতা দেওয়ার সিদ্ধান্তই নিয়ে থাকতেন তা হলে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের ওপর হেভি মিলিটারি ক্র্যাক ডাউন করেছিলেন কেন?
(২) ১৯৭১ সালের ১৪ মার্চ থেকে ২২ মার্চ পর্যন্ত ঢাকায় ইয়াহিয়া খানের মিলিটারি জান্তা এবং শেখ মুজিবের মধ্যে ৯ দিন ধরে আলোচনা হয়। আলোচনার শেষ পর্যায়ে জুলফিকার আলী ভুট্টো যোগদান করেন। ইয়াহিয়া খান কি ওই ম্যারাথন বৈঠকে মুজিব এবং ভুট্টোকে জানিয়েছিলেন যে, পরের বছর মার্চে তিনি পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীনতা দিতে যাচ্ছেন?
(৩) বাংলাদেশকে যদি স্বাধীনতা দেওয়ারই সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে তাহলে ২৫ মার্চের পর শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় কেন? কেন সেখানে তাকে মিয়ানওয়ালী জেলে বন্দি করে রাখা হয়?
(৪) সারা পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে অর্থাৎ পাকিস্তানের পার্লামেন্টে আসন ছিল ৩০০টি। শেখ মুজিবের দল এককভাবে জয়লাভ করে ১৬৭টি আসনে। অর্থাৎ শুধু সাবেক পূর্ব পাকিস্তান নয় শেখ মুজিব সমগ্র পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা হিসেবে ওই নির্বাচনে আবির্ভূত হয়েছিলেন। এরপর ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আর কোনো আলাপ-আলোচনার প্রয়োজন ছিল না। নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করতে পারতেন। সেটা তিনি করেননি কেন?
(৫) ক্ষমতা হস্তান্তর করলে শেখ মুজিব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি যদি পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীনতা দিতেন তা হলেও কারো কিছু বলার ছিল না। কারণ কিসিঞ্জারের উক্তি মোতাবেক ইয়াহিয়া নিজেই তো ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশকে স্বাধীনতা দিতে চেয়েছিলেন।
(৬) আর যদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর শেখ মুজিব পাকিস্তানের অখ-তা বজায় রাখতেন তা হলে তো সেটা পশ্চিম পাকিস্তানিদের জন্য সোনায় সোহাগা হতো।
তিন.
এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। বিগত ৪৫ বছর ধরে এসব প্রশ্নের জওয়াব মেলেনি। আরও অনেক প্রশ্ন এসে যায় যেগুলো কিসিঞ্জারের এ তথ্যকে সমর্থন করে না। তেমন কয়েকটি প্রশ্ন :
(১) ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর ভারত সর্বপ্রথম আন অফিসিয়ালি বিমান হামলা করে। যশোরের চৌগাছা এবং জীবননগরে ভারতীয় জঙ্গি বিমান থেকে বোমাবর্ষণ করা হয়। বাংলাদেশকে যদি স্বাধীনতা দেওয়ারই সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে তাহলে ভারতকে ৩ ডিসেম্বর সরাসরি পাকিস্তান আক্রমণের সুযোগ দেওয়া হলো কেন? তার আগেই স্বাধীনতা দানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়নি কেন?
(২) বাংলাদেশকে যদি স্বাধীনতাই দেওয়া হবে তাহলে ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ থেকে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত পাকবাহিনী মিলিটারি ক্র্যাক ডাউন অব্যাহত রাখল কেন?
(৩) ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে লন্ডন হয়ে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন। মাঝখানে কলকাতায় ছিল ব্রিফ স্টপ ওভার। তার আগে জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হন। ততদিনে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে।
(৪) এত কিছুর পর ভুট্টো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে পাকিস্তানকে এক ও অখ- রাখার জন্য সাহালা রেস্ট হাউসে মুজিবের সাথে সাক্ষাৎ করেন কেন? কেন তিনি পাকিস্তানকে অখ- রাখার জন্য শেখ মুুজিবকে অনুরোধ করেন? কেন তখনও ইয়াহিয়া ভুট্টোকে বলেননি যে, বাংলাদেশকে স্বাধীনতাদানের জন্য তিনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে কথা দিয়েছেন? এখানে বলতে ভুলে গেছি যে, সাক্ষাতের আগে তিনি মুজিবকে মুক্তি দেন।
(৫) এগুলো তো গেল ভুট্টো এবং ইয়াহিয়া খানের কথা। আসলে এখানে আমেরিকার ভূমিকা কী ছিল? আমেরিকাও যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতা চেয়ে থাকে তাহলে মুক্তিযুদ্ধকালে প্রবাসী সরকার এবং পাকিস্তান সরকারের মাঝে মার্কিন কূটনীতিকরা দূতিয়ালি করেছিলেন কেন? কেন তারা পাকিস্তানকে একটি কনফেডারেল রাষ্ট্র বানানোর চেষ্টা করেছিলেন?
চার.
এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। কোনো দিন কোনো জবাব হয়তো মিলবে না। যেমন ৪৫ বছর হয়ে গেল আজও মানুষ জানল না যে, ১৯৭১ সালের ১৪ মার্চ থেকে ২২ মার্চ পর্যন্ত শেখ মুজিব ইয়াহিয়া খান এবং ভুট্টোর মধ্যে কী আলোচনা হয়েছে? ৯ দিন ধরে আলোচনা হলো। অথচ সেই আলোচনার ৯টি লাইনও মানুষ জানতে পারল না? এ কেমন কথা? আমি আজও বিশ্বাস করি যে, ওই আলোচনা শেষে যদি শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হতো তাহলে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ উভয় দেশের ইতিহাসই হয়তো ভিন্নভাবে লেখা হতো। কিন্তু সেসব কথা বলে আজ লাভ কি? যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। এখন এই দেশকে গড়তে হবে। একটি সাচ্চা গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে। প্রকৃত স্বাধীন দেশ হিসেবে, যেখানে থাকবে না স্বৈরশাসনের পদচিহ্ন, থাকবে না আধিপত্যবাদের ধূলিকণা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন