লিয়াকত হোসেন খোকা : সারা দেশে হাড় কাঁপানো কনকনে শীত নেমেছে। বইছে মৃদু ও মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ। পৌষের বিদায়লগ্নে সারা দেশে যেমন শীতের প্রকোপ বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে গরিব-দুঃখী মানুষের দুর্ভোগ। শীতের পাশাপাশি ঘনকুয়াশা জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। দেশের উত্তরাঞ্চলে ভরদুপুরেও সূর্যের দেখা পাওয়া দায় হয়ে পড়েছে। সড়ক ও নৌ চলাচলে বিপদের হাতছানি ডেকে আনছে কুয়াশার চাদর। আবহাওয়ার বিচিত্র খেলায় এবার শীত নেমেছে যেমন দেরিতে, তেমন কাঁপুনি দেওয়া শৈত্যপ্রবাহ কিছুটা দেরিতে অনুভূত হলো।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি জানুয়ারি মাসে দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ হতে পারে। তা শেষ পর্যন্ত তীব্র শৈত্যপ্রবাহে রূপ নিতে পারে। মৃদু শৈত্যপ্রবাহ দেশের জনজীবনে ইতোমধ্যে বিপর্যয় ডেকে এনেছে। উত্তরাঞ্চলে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শীতের তীব্রতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ঘনকুয়াশায় সড়ক ও নৌপথে যাতায়াত বিঘিœত হওয়ায় বিপাকে পড়েছে লাখ লাখ মানুষ।
রাজধানী থেকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে যাতায়াতে দেখা দিয়েছে বিঘœ। ঘনকুয়াশায় ফেরি ও লঞ্চ চলাচল বিঘিœত হচ্ছে। আগামী এক কিংবা দুই সপ্তাহে শীতের প্রকোপ যেমন বাড়তে পারে তেমনি বাড়তে পারে কুয়াশা। শীত সাধারণভাবে সবচেয়ে পছন্দনীয় ঋতু হলেও গরিব-দুঃখী মানুষের জন্য এ ঋতু দুর্ভোগও বয়ে আনে। শীতে দিনমজুরদের কাজ পাওয়া দুষ্কর হয়ে ওঠে। শীত নিবারণের পোশাক এবং কম্বল-কাঁথার অভাবে অভাবী মানুষ কষ্টও পায়। শীতজনিত রোগের শিকার হয় অসংখ্য মানুষ। বিশেষত শিশু ও বৃদ্ধরা সর্দি, জ্বর, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়। প্রাণ হারান অনেকে। শীত মৌসুমে প্রতিবারই সরকারের পক্ষ থেকে সমাজের নিঃস্ব মানুষের জন্য কম্বল বিতরণ করা হয়। শীত পোশাক ও কম্বল বিতরণে এগিয়ে আসে সমাজের সম্পন্ন মানুষ। তবে এখন পর্যন্ত এ ধরনের উদ্যোগ ততটা শুরু হয়নি বললেই চলে। শীতের প্রকোপ আরও বাড়ার আগেই সমাজের গরিব মানুষদের রক্ষায় উদ্যোগ নিতে হবে। এটি যেমন সরকারের দায়িত্ব, তেমনি সম্পন্নজনদেরও এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি মৃদু ও মাঝারি শৈত্যপ্রবাহে দেশের কৃষির যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকেও নজর রাখতে হবে। শীত বিশেষত কুয়াশায় সড়ক ও নৌপথে যানবাহন চলাচলেও সর্বাধিক সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
শীতজনিত কারণে ছড়িয়ে পড়ছে নানা অসুখ-বিসুখ। ঠা-া পরিবেশে জবুথবু অবস্থা দেশের সর্বত্র। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে কেউ ঘরের বাইরে বেরুচ্ছে না। ঘরকে উষ্ণ রাখার জন্য সারা দিনই ঘরে দরজা-জানালা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। ঢাকা বা অন্যান্য শহরাঞ্চলে ঘরকে উষ্ণ রাখার জন্য রুম হিটার ব্যবহার করলেও গ্রামাঞ্চলে ঘরকে গরম রাখার জন্য অনেকেই আগুন জ্বালিয়ে রাখছেন। ষাটোর্ধ্ব বয়সীদের অনেকেই মাটির পাত্রে (মালসা) কাঠ-কয়লা জ্বালিয়ে বিছানায় নিয়ে ঘুমাচ্ছেন। এ থেকে দুর্ঘটনাও ঘটে যাচ্ছে।
ভীষণ কষ্টে দিনযাপন করছে দরিদ্র মানুষ। শীতে কাজকর্ম না থাকায় অনাহারে-অর্ধাহারে থাকতে হচ্ছে। একই সাথে গরম কাপড় কেনার সামর্থ্য না থাকায় শীতেও কষ্ট পাচ্ছেন তারা। তীব্র শীতে শিশু ও বৃদ্ধদের মধ্যে দেখা দিচ্ছে নানা ধরনের রোগব্যাধি। সর্দি-কাশি, জ্বর, হাঁপানি, ডায়রিয়া প্রভৃতি রোগ নিয়ে আসছেন হাসপাতালে। প্রাইভেট চিকিৎসকদের কাছেও আসছে একই ধরনের রোগে।
কনকনে শীত দেশের গরিব-দুঃখী মানুষের জন্য বিড়ম্বনা ডেকে আনছে। দেশের উত্তরাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রবাহিত হচ্ছে শৈত্যপ্রবাহ। কনকনে শীতের পাশাপাশি ঘনকুয়াশা জনজীবনকে স্তব্ধ করে দিচ্ছে।
একদিকে প্রচ- শীত, অন্যদিকে ঘনকুয়াশায় দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের জনজীবন কয়েক দিন ধরে স্তব্ধ প্রায়। ফেরি চলাচল বিঘিœত হওয়ায় রাজধানী থেকে দক্ষিণাঞ্চলে সড়কপথে যাতায়াতে তিনগুণেরও বেশি সময় লাগছে। তীব্র শীতে খেটে খাওয়া মানুষের দুর্ভোগ সীমা অতিক্রম করতে চলেছে। শীতের কারণে কাজ পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ছে। জুটছে না পেটের অন্ন। হাড়কাঁপানো শীত অসহায় জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে।
শীত গরিব মানুষের জীবনকে অসহনীয় অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে। জনগণ আশা করে শীতপীড়িত মানুষের ত্রাণে সরকার কম্বল ও গরম পোশাক বিতরণসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। সমাজের সম্পন্ন মানুষদেরও শীতার্তদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে হবে। বাড়িয়ে দিতে হবে সহযোগিতার হাত। শৈত্যপ্রবাহ কৃষির জন্য যেসব হুমকি সৃষ্টি করছে তা রোধে কৃষি বিভাগ যথাযথ উদ্যোগ নেবে আমরা তেমনটিও দেখতে চাই।
হার কাঁপানো শীত পড়েছে, দিন দিন শীতের তীব্রতা বাড়ছে। সামনের দিনগুলোতে স্বাভাবিকভাবেই এর তীব্রতা আরো বাড়বে। তাই এখনই দরকার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ এবং সৎ চেষ্টা। একজন মানুষ হয়ে আর একজন অসহায় কর্মঅক্ষম মানুষের পাশে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। এই তীব্র শীত আমাদের জন্য অনেক আনন্দদায়ক কিন্তু একবার কি ভেবে দেখেছেনÑ এই শীতে অসহায় গরিব বস্ত্রহীন কর্মঅক্ষম মানুষ কীভাবে রাত কাটাচ্ছেন? তাদের আমাদের মতো দামি গরম পোশাক তো দূরে থাক, সামান্য কাপড়টুকু নেই। ছোট ছোট বাচ্চারা এই তীব্র শীতে কত কষ্টে আছে। অনেকে এই শীত সহ্য করতে না পেরে মারাও যাচ্ছে। তাই সকলের প্রতি আহ্বান আসুন আমরা যে যা পারি তাই দিয়েই শীতার্তদের পাশে দাঁড়াই।
আরেকটি বিষয়, শীত মৌসুম শুরু হওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থানে ডাকাতি শুরু হয়েছে। ডাকাতরা প্রবাসীদের বাড়িকে প্রধান টার্গেটে পরিণত করেছে। আর সুযোগ বুঝে বিভিন্ন সড়কের নিরিবিলি স্থানে হাইওয়ে পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে রাতে চলাচলকারী যানবাহনে ডাকাতির সুযোগ খুঁজে নিচ্ছে। হাইওয়ে সড়কে ডাকাতির ঘটনা প্রায়শই ঘটছে। পুলিশও তার ভূমিকা পালনে সামর্থ্যমতো সাহসিকতার পরিচয় দিচ্ছে।
শীতে আবহাওয়ায় শুষ্কতার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্নভাবে অগ্নিকা-ের ঘটনাও বৃদ্ধি পায়। ইতোমধ্যে ছোট-বড় অগ্নিকা-ের ঘটনা সংবাদের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আগুন পোহাতে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ হওয়ার ঘটনাও ঘটে চলছে। মশার উপদ্রবে কয়েলের ব্যবহার অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় ছোট-বড় অগ্নিকা-ের জন্য কোথাও কোথাও কয়েলের ওপর দায়ের হার বাড়ছে। বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটে মার্কেটসহ বড় বড় প্রতিষ্ঠানে অগ্নিকা-ের ঘটনা শীতপূর্ব ঋতুগুলোর চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে।
শীতে ডাকাত ও আগুনের কারণে যেসব ঘটনা ঘটে তা বলা যায় সচেতন মহল মাত্রেরই জানা। কিন্তু এ জানাটাকে সচেতনতা সৃষ্টি এবং প্রতিরোধ ও প্রতিকারমূলক কার্যক্রম গ্রহণের ক্ষেত্রে যথার্থভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। যদি লাগানো হতো তাহলে ডাকাতি ও অগ্নিকা-ের ঘটনা ক্রমশ আশাব্যঞ্জকভাবে কমে আসত।
আশা করি আগামী দিনগুলোতে পুলিশ প্রশাসন এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগ ডাকাতি ও অগ্নিকা- প্রতিরোধে সারা বছর গতানুগতিক যে কার্যক্রম পালন করে, তার চেয়ে শীত মৌসুমে বিশেষ বা অধিক কার্যক্রম পালন করবে। এতে ডাকাতি ও অগ্নিকা-ে জানমালের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অবশ্যই হ্রাস পাবে।
য় লেখক : সংসদ সদস্য, নারায়ণগঞ্জ-৩, সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব, জাতীয় পার্টি, কেন্দ্রীয় কমিটি
মন্তব্য করুন