জামালউদ্দিন বারী : আর মাত্র দু’দিন বাদে ২০ জানুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার পালাবদল ঘটতে যাচ্ছে। মার্কিন ইতিহাসের প্রথম আফ্রো-আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা দুই মেয়াদে ৮ বছর সফলভাবে প্রেসিডেন্সির দায়িত্ব পালন শেষে নব নির্বাচিত রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে হোয়াইট হাউজের দায়িত্ব হস্তান্তর করতে যাচ্ছেন। এবারের দায়িত্ব হস্তান্তর অতীতের যেকোনো নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের গতানুগতিক ঐতিহ্যের চাইতে একটু ভিন্ন মাত্রা গ্রহণ করতে চলেছে। আমেরিকার ৪৫তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মনোনয়ন লাভ থেকে শুরু করে অপ্রত্যাশিত ও বিস্ময়করভাবে নির্বাচিত হওয়া পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ও বিশ্বব্যাপী যে গণপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে তা মার্কিন নির্বাচনী ইতিহাসের বিরল ঘটনা। বিশেষত পপুলার ভোটে ডেমোক্রেট দলীয় প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের চেয়ে অনেক পিছিয়ে থাকার পরও প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের জয় নিশ্চিত হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে হাজার হাজার মানুষের রাজপথে নেমে এসে বিক্ষোভ করার ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন ব্যবস্থা এবং গণতন্ত্রের নড়বড়ে অবস্থাকেই বিশ্বের সামনে প্রকটভাবে তুলে ধরেছে। শুধু মার্কিন গণতন্ত্র ও নির্বাচন ব্যবস্থাই নয়, নির্বাচনে ট্রাম্পের জয়লাভের পেছনে রাশিয়ার হ্যাকিং কারসাজির অভিযোগের মধ্যদিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যপ্রযুক্তি সক্ষমতা এবং কূটনৈতিক দুর্বলতাও স্পষ্ট হয়েছে। নির্বাচনের পর পর এক সাথে দুইডজনের বেশি রাশিয়ান কূটনীতিককে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কারের মধ্যদিয়ে সে দুর্বলতার প্রকাশ ঘটেছে। ঘটনা যা-ই ঘটুক, ২০১৬ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের এসব ঘটনাবলী এখন মার্কিন নির্বাচনী ইতিহাসের অংশ। আর এই নির্বাচনের ফলাফলের মধ্যদিয়ে মার্কিন পাওয়ার এলিটদের ‘নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরী’ নিঃসন্দেহে এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করতে চলেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর রাজনীতি, অর্থনীতি ও ক্ষমতার পালাবদলের সাথে পররাষ্ট্রনীতি ও যুদ্ধনীতির যে অবিচ্ছদ্য যোগাযোগ তার পেছনে থাকে পাওয়ার এলিট ও তাদের মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্স, কর্পোরেট মিডিয়ার প্রোপাগান্ডা ম্যাকানিজম এবং গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের সমন্বিত তৎপরতা। এবারের মার্কিন নির্বাচনে এসব সাম্রাজ্যবাদী মেশিনারিজ যেন অনেকটা সেইমসাইড বা আত্মঘাতী হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নির্বাচনী বাছাইয়ের প্রতিযোগিতায় তারা প্রথমেই ডেমোক্রেটদলীয় প্রার্থী বার্নি সেন্ডার্সকে মার্কিন কর্পোরেট সাম্রাজ্যবাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে গণ্য করে খোলাখুলিভাবে হিলারি ক্লিনটনের পক্ষাবলম্বন করে। ডেমোক্রেট দলীয় প্রার্থী বার্নি সেন্ডার্স ও রিপাবলিকান দলীয় প্রার্থী টেড ক্রুজের মতো অপেক্ষাকৃত লিবারেল প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়ার পর মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতার দুই প্রার্থীর দু’জনই কর্পোরেট পাওয়ার এলিটদের কাছে সুবিধাজনক প্রার্থী হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন। তবে মাঝখান দিয়ে রাশিয়ান হ্যাকিং বা ইন্টেলিজেন্স হস্তক্ষেপের অভিযোগ পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে আরো অস্বচ্ছ ও সন্দেহযুক্ত করে তুলেছে। ২০ জানুয়ারি ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতাগ্রহণ পরবর্তী পদক্ষেপ ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্যদিয়ে এসব সন্দেহ এবং অস্বচ্ছতা দূর হতে পারে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত রাষ্ট্রের ক্ষমতার কলকাঠির নেপথ্য বিষয়াবলী পুরোপুরি উন্মোচিত বা সংশয়মুক্ত করা হয়তো কখনই সম্ভব নয়। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর থেকে গত দুই মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও বিশ্ব রাজনীতির নানাবিধ ঘটনাপ্রবাহ এবং বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায়, শুরু থেকেই ডোনাল্ড ট্রাম্প তুমুল বিতর্ক ও কঠিন পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে তার যাত্রা শুরু করতে চলেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বাস্তবতা ও বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী ইশতেহারের বাস্তবায়ন অনেক কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে গিয়েই ট্রাম্প কর্পোরেট এলিটদের হাতে একজন দুর্বল ক্রীড়নকে পরিণত হতে পারেন বলে কেউ কেউ মনে করছেন। নির্বাচনের পর দু’মাস পার হয়ে গেলেও বিতর্ক ও গণবিক্ষোভ পিছু ছাড়ছে না ট্রাম্পের। আগামী শুক্রবার হোয়াইট হাউজের দায়িত্ব গ্রহণ করতে যাওয়া ট্রাম্পের বিরুদ্ধে গত ১৪ জানুয়ারি শনিবারও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার কর্মীরা ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। এমনকি ট্রাম্প সমর্থক ও ট্রাম্পবিরোধীদের উত্তেজনাও বেড়ে চলেছে। ট্রাম্পের অভিষেক উপলক্ষে তারা রাজপথে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে ডেমোক্রেট দলীয় প্রভাবশালী ও প্রবীণ কংগ্রেস সদস্য জন লুইসের সাথে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাকযুদ্ধ শেষ পর্যন্ত অনেক ডেমোক্রেট কংগ্রেস সদস্যের ট্রাম্পের শপথ অনুষ্ঠান বর্জনের কারণ হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার আন্দোলনের প্রবাদ পুরুষ মার্টিন লুথার কিং-এর সহযোদ্ধা, ১৯৬৩ সালে যে সমাবেশে মার্টিন লুথার কিং গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন সে সভায় বক্তৃতা করা বেঁচে থাকা একমাত্র নেতা জন লুইস দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প একজন অবৈধ প্রেসিডেন্ট, তিনি জনগণের ভোটে পাস করেননি, রাশিয়ান হ্যাকিং-এর কারণেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের বৈধতা সম্পর্কে জন লুইসের তোলা এই বিতর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক রাজনীতি ও মিডিয়া সেলিব্রেটিও সমর্থন জানাচ্ছেন। বিগ সিক্স নামে খ্যাত মার্কিন সিভিল রাইটাস আন্দোলনের অন্যতম নেতা জন লুইসের সাথে অশোভন বিতর্ক ট্রাম্পের জন্য বড় বিপর্যয়। এমনকি অনেক রিপাবলিকানও জন লুইযের বক্তব্য সমর্থন জানিয়ে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। এরা সকলেই ট্রাম্পের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান বর্জনের কথা বলছেন। এসব বিতর্ক নতুন প্রেসিডেন্টের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানকে হয়তো সরাসরি প্রভাবিত করবে না, তবে এর মধ্যদিয়ে ট্রাম্পের দায়িত্ব পালন শুরু থেকেই অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হলো।
গত প্রায় এক শতাব্দী ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ব্যবহার বিশ্বের বহু দেশে ক্ষমতার পালাবদল নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই এখন রাশিয়ার দ্বারা ইলেকশন ম্যানিপুলেশনের অভিযোগ তুলছে। সম্প্রতি বোস্টন গ্লোব অনলাইনে প্রকাশিত এক নিবন্ধে কীভাবে শত বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের দেশে দেশে নির্বাচন ও রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে তার ফিরিস্তি তুলে ধরেছেন লেখক স্টিফেন কিনজার। বিদেশে মার্কিনীদের ইলেকশন নিয়ন্ত্রণের প্রথম উদাহরণ হিসেবে ১৮৯৮ সালে স্পেনিশ যুদ্ধে কিউবার বিদ্রোহীদের সামরিক সহযোগিতা দেয়ার পর কিউবার প্রথম নির্বাচনে মার্কিনীরা নিজেদের অনুগত একজন প্রার্থীকে নির্বাচিত করতে অন্যসব প্রার্থীকে নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছিল। এর দু’বছর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হাওয়াই দ্বীপ দখল করে সেখানকার জনমত উপেক্ষা করে সেখানে এমন একটি নির্বাচনী ব্যবস্থা কায়েম করা হয়, যাতে আমেরিকার অনুগতদের বাইরে কেউ নির্বাচিত হতে না পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কোল্ড ওয়ারের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক কূটনীতি ও গোয়েন্দা কার্যক্রমের মূলনীতি হয়ে দাঁড়ায় ক্ষমতাকেন্দ্রিক নির্বাচনগুলোকে প্রভাবিত করা। এ ক্ষেত্রে ১৯৪৮ সালে ইতালির সাধারণ নির্বাচনে প্রো-মার্কিন দলকে ক্ষমতায় বসানোর কৌশল সফল হওয়ার বিশ্বের অন্যান্য দেশেও একই ধরনের কৌশল গ্রহণ করে সাফল্য লাভ করে। মার্কিন অনুগতদের ক্ষমতায় বসানোর পাশাপাশি দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী শাসকদের ক্ষমতাচ্যুত করতে বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক দল, সেনাবাহিনীর প্রতি প্রকাশ্য ও গোপন সহায়তা দিয়ে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার পাশাপাশি অগণতান্ত্রিক শক্তিকে ক্ষমতায় বসানোর অনেক উদাহরণ আছে। পঞ্চাশের দশকে ইরানের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মোসাদ্দেক সরকারকে গদিচ্যুত করে পাহলভি রাজবংশের ক্ষমতা পুনরায় নিরঙ্কুশ করা, পঞ্চাশের দশক থেকে ইন্দোনেশিয়া, লেবানন, নিকারাগুয়া, চিলি, ডমিনিকান রিপাবলিকসহ বিভিন্ন দেশে রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ন্ত্রণে সিআইএর ভূমিকার কথা তুলে ধরেছেন স্টিফেন কিনজার। ১৯৬৪ সালে চিলির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে সেখানকার মার্কিনপন্থি রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের অর্থায়ন, সংবাদপত্র, রেডিওসহ মিডিয়াগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সিআইএ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৭০-এর নির্বাচনে মার্কিন প্রভাব অকেজো করেই সোশালিস্ট প্রার্থীর নেতা সালভেদর আলেন্দে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আলেন্দেকে হত্যা ও জেনারেল পিনোশেকে ক্ষমতায় বসানোর পেছনেও মার্কিন প্রভাবের বিষয়টি অনেকটাই স্পষ্ট। বাংলাদেশে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের আগেই তৎকালীন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের নীল নকশা করেছিল বলে জানা যায়। ২০১১ সালে প্রকাশিত উইকিলিকস বার্তায় সে সময়ের মার্কিন রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টির একটি তারবার্তায় এই তথ্য উঠে আসে। নির্বাচনের দুইদিন আগে ওয়াশিংটনে পাঠানো সেই কূটনৈতিক তারবার্তায় ২০০৯ সালের ১০ জানুয়ারি সেনাসমর্থিত সরকার আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে বলে জানিয়েছিল। নির্বাচনের আগেই একটি নির্দিষ্ট দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের এই পরিকল্পনার কথা ফাঁস হয়ে যাওয়ার মধ্যদিয়ে সেই নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে সেনাসমর্থিত সরকার এবং আন্তর্জাতিক কুশীলবদের যোগসাজশের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
প্রায় শতাব্দী ধরে বিশ্বের রিজাইম চেঞ্জ’র খেলায় লিপ্ত মার্কিন কূটনৈতিক ও গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক কি এখন নিজেরাই প্রতিপক্ষের রিজাইম চেঞ্জ পরিকল্পনার টার্গেট হয়েছে? সর্বশেষ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হিলারির পরাজয়ের পর রাশিয়ানদের হ্যাকিংয়ের অভিযোগ এখন আর শ্রেফ রাজনৈতিক ব্লেইম গেমেই সীমাবদ্ধ নয়। খোদ মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের হস্তক্ষেপের কাহিনী নিয়ে হাজির হচ্ছে। মার্কিন নির্বাচন ব্যবস্থায় রুশ হস্তক্ষেপের এই অভিযোগ অনেক বেশি স্পর্শকাতর ও প্রেস্টিজিয়াস ইস্যু। ইতিপূর্বে ২০১১ সালে রাশিয়ান পার্লামেন্ট নির্বাচনে পুতিনের দল বিজয়ী হলেও আগের নির্বাচনের চেয়ে ৭৭টি আসন কম পাওয়ার পেছনে ওয়াশিংটনের হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলেছিলেন পুতিন, একই সময়ে মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট হিলারি ক্লিনটন মস্কোর বিরুদ্ধে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে পুতিনের কাছে চরম বিরাগভাজন ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। সাধারণ দৃষ্টিতে পুতিনবিরোধী হিলারিকে হোয়াইট হাউজের ক্ষমতায় বসতে না দেয়ার হ্যাকিং তৎপরতায় পুতিনের ভূমিকা ও সক্ষমতা যা’ই থাক, পুতিন এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তবে এখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে মার্কিন কর্পোরেট মিডিয়া ও গোয়েন্দা নেটওর্য়াকের রিপোর্টে যেসব উপাদান ও প্রোপাগান্ডা দেখা যাচ্ছে, তাকে কেউ কেউ ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুতিনপ্রীতি ডিঙিয়ে রাশিয়াকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে নতুনভাবে চিত্রিত করার প্রয়াস বলে অভিহিত করেছেন। নাইন-ইলেভেন পরবর্তী দশকে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সূচিত‘ওয়ার অন টেররিজম’-এর প্রভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা অর্থনীতিতে যে ধস নেমেছিল, সেই সাথে বিশ্বে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ভাব-মর্যাদার যে বড় ধরনের অবক্ষয় ঘটেছিল ২০০৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বারাক ওবামার প্রার্থিতা ঘোষণা এবং নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে যে পরিবর্তনের প্রত্যাশা তুলে ধরা হয়েছিল, পরবর্তী ৮ বছরে সে প্রত্যাশার কাক্সিক্ষত মাত্রা স্পর্শ করতে না পারলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি একটি ধ্বংসস্তূপের উপর যেন কিছুটা স্থিতিশীল অবস্থায় উঠে আসতে সক্ষম হয়েছিল। যদিও এ সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক ঋণের বোঝা ও বাজেট ঘাটতি দ্বিগুণ হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে রিজিম চেঞ্জ, আইএস, জঙ্গিবাদ নিয়ে ডাবল স্টান্ডার্ড গেম, ইত্যাদির মধ্যদিয়ে মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্স (এমআইসি)’র হাজার হাজার কোটি ডলারের বাণিজ্য হলেও সিরিয়ায় রাশিয়ান হস্তক্ষেপে এমআইসির বাণিজ্যিক এজেন্ডা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে শুরু করেছে। এ ধরনের বিশ্ব বাস্তবতায় মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্স তথা সাম্রাজ্যবাদী এজেন্ডা বাঁচিয়ে রাখতে একদিকে মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক বিরোধ-বিভক্তি ও উত্তেজনাকে জিইয়ে রাখা অন্যদিকে রাশিয়াকে আবারো মূল প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর পরিকল্পনা চলছে। অস্ত্র বিক্রির জন্য বড় জুজুজ ও প্রতিপক্ষ প্রয়োজন। সেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট যেন পুতিনের সাথে আপস করতে না পারেন, তারই ভিত্তি রচনার জন্য নতুন প্রোপাগান্ডা শুরু করেছে পশ্চিমা পাওয়ার এলিটরা। যেখানে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার টেনিউর শুরু হয়েছিল আকাশ সমান প্রত্যাশা এবং নোবেল শান্তি পুরস্কারের মধ্যদিয়ে, তারপরও বিশ্বব্যাপী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রণসজ্জা থামেনি। সেখানে আগের অনেক কিছু নাকচ করে দিয়ে, বর্ণবাদ ও ইসলাম বিদ্বেষের দামামা বাজিয়ে ক্ষমতায় আসা ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে একটি শান্তিকামী বিশ্বের প্রত্যাশা পূরণে কাজ করা অসম্ভব কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। হিলারির বিরুদ্ধে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বিজয়ী হতে রাশিয়ানদের নৈতিক সমর্থন থাকা অস্বাভাবিক নয়। তবে নির্বাচনে রাশিয়ার হ্যাকিং বা হস্তক্ষেপের অভিযোগের মধ্যেই ওয়ার মঙ্গারদের নতুন প্রোপাগান্ডা থেমে নেই, সম্প্রতি ভারমন্ট বিদ্যুৎগ্রীডেও রাশিয়ান হ্যাকারদের আক্রমণের অভিযোগ তোলা হয়েছে। অবশেষে সত্য হোক বা মিথ্যা হোক, মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করার শক্তি ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেই। বিদ্যমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে জর্জ বুশ, ওবামা অথবা ট্রাম্প যিনিই হোয়াইট হাউজে থাকুন না কেন পার্থক্য খুবই কম। ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রে হেইটক্রাইম বেড়ে গেছে। গত দুই মাসে বাংলাদেশি মুসলমানরাও বিভিন্ন স্থানে বর্ণবাদী হামলার শিকার হয়েছেন। যে দেশের প্রেসিডেন্টের হাতে হাজার হাজার পারমাণবিক বোমার কোড ও চাবি গচ্ছিত থাকে সে ব্যক্তিটি যদি হন বর্ণবাদী, রগচটা, মুনাফাবাজ ও স্থূল চেতনার মুসলিমবিদ্বেষী ডোনাল্ড ট্রাম্প, তাহলে আমাদের এবং বিশ্ব সম্প্রদায়ের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
bari_zamal@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন