মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

আমাদের এগিয়ে যেতেই হবে

উপ-সম্পাদকীয়

| প্রকাশের সময় : ২৯ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আফতাব চৌধুরী : পরিবেশবাদকে মূলত তিনটি ধারায় চিহ্নিত করা যায়। এ ধরনের বিভাজনের কিছু অসুবিধা থাকে, একটি ধারার মতামতের প্রতিফলন অন্য ধারাতেও পাওয়া যায়, কিছু মতবাদ শুধুমাত্র পরিবেশ-ভাবনাতে সীমাবদ্ধ নয় বরং আরো বৃহত্তর উদ্দেশ্যে তার গন্তব্য। তবু পরিবেশবাদের আলোচনায় এ বিভাজন বিভিন্ন মতামত বুঝতে সাহায্য  করে। এ তিনটি মূল ধারাকে চিহ্নিত করা যায় এভাবেÑ (১) প্রকৃতিকেন্দ্রিক (২) পরিবেশকেন্দ্রিক (৩) সমাজ-অর্থনীতিকেন্দ্রিক।
প্রকৃতিকেন্দ্রিক ভাবনা : প্রকৃতি সম্পর্কে মানুষের শুরু থেকে ভীতি-মিশ্রিত একটি শ্রদ্ধার ভাব রয়েছে, যা বিবৃত হয়েছে বিভিন্ন প্রাচীন দর্শনে, লোকগাথায়। প্রকৃতি সম্পর্কে শ্রদ্ধা, প্রকৃতির সঙ্গে ঐক্যের নতুন একটি মতাদর্শের আধুনিক পুনরুজ্জীবন ঘটে ঊনবিংশ শতাব্দীতে, ইউরোপ এবং আমেরিকায় এ নতুন ভাবনা আজকের শিল্পজাত দূষণের সমস্যা নিয়ে ভাবিত ছিল না, এর মূল আশঙ্কা নাগরিক যন্ত্রসভ্যতার বিকাশের ভবিষ্যৎ নিয়ে।
প্রকৃতিকেন্দ্রিক এ ভাবনার বিরোধিতাও অনেক দিনের। পুঁজিবাদের বিকাশ যেমন প্রকৃতিকে বিভিন্নভাবে বিপর্যস্ত করেছে, তেমনি একটি গোষ্ঠীর হাতে প্রযুক্তি ও আর্থিক সুবিধা যথেষ্ট অবসর এনে দিয়েছে প্রকৃতিকে উপভোগ করার। অনেকে মনে করেন, প্রকৃতিকেন্দ্রিক ভাবনার মূল সমর্থক এ সুবিধাভোগী অভিজাতরা। বিভিন্ন উন্নত দেশে আর্থিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতিপ্রেমীদের সংখ্যাও বেড়েছে। সামাজিক সমস্যা থেকে বিযুক্ত করে প্রকৃতিকে অক্ষুণœ রাখার আন্দোলনকে অনেকে তাই ধনী ও উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রকৃতি-বিলাসের রক্ষণশীল ধারার নতুন রূপায়ণ মনে করেছেন। উন্নত জীবনযাত্রার প্রতিনিধিরা অনুন্নত অংশের স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে বলেছেন নিজেদের প্রকৃতি প্রেমের স্বার্থে। তৃতীয় দুনিয়ার পশ্চাৎপদ সমাজ ও জীবনযাত্রাকে প্রকৃতি-সচেতনতার সম্মান দিয়ে তাদের সভ্যতার অগ্রগতির শরিক হতে বাধা এ প্রকৃতিকেন্দ্রিক পরিবেশবাদীরা। প্রকৃতিকেন্দ্রিক এ আন্দোলনের জন্য অনেক নতুন প্রকল্প স্থগিত হয়ে রয়েছে, যার যৌক্তিকতা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে পৃথিবীজুড়ে।
পরিবেশকেন্দ্রিক ভাবনা : প্রকৃতিকেন্দ্রিক ভাবনা থেকে পরিবেশকেন্দ্রিক ভাবনার তফাৎ হলো যে, পরিবেশকেন্দ্রিক ভাবনা প্রকৃতির গুরুত্বকে আধ্যাত্মিক স্তরে বিচার না করে বিজ্ঞানসম্মতভাবে তার কার্যকারিতাকে প্রমাণ করার চেষ্টা করে। অর্থাৎ একটি গাছ বা প্রাণীর সংরক্ষণে প্রকৃতির নৈতিক অধিকারের দাবি না তুলে প্রতিবেশে ওই বিষয়গুলোর ভূমিকা কতটা জরুরি তাকে গুরুত্ব দেয়। গেল ১৫০ বছর ধরে জীববিদ্যার একটি শাখা হিসেবে প্রতিবেশবিদ্যা ক্রমশ পরিণত হয়ে উঠেছে। সভ্যতার বিকাশ প্রাকৃতিক পরিবেশকে পরিবর্তন করা ছাড়া অসম্ভব, কিন্তু ক্রমাগত হস্তক্ষেপ কখনো ব্যাপক বিপর্যয়ের সূচনা করতে পারেÑ এ আশঙ্কাটি ষাট দশকে অনেক বিজ্ঞানীকে চিন্তান্বিত করে এবং প্রতিবেশের সংরক্ষণে বিশেষ গুরুত্ব নিয়ে বৈজ্ঞানিক আলোচনায় ও পরে সাধারণ পরিবেশবাদী ভাবনায় উপস্থিত হয়।
ষাটের দশকের শুরুতে একটি বই আমেরিকাতে সাড়া ফেলে। বইটির নাম ‘স্তব্ধ বসন্ত’ লেখিকা একজন জীববিদ, র‌্যাচেল কারসন। কারসন হুঁশিয়ারি দেন যে, বিভিন্ন কীটনাশক ও আগাছা-নাশকের, বিশেষত ডিডিটির যথেচ্ছ ব্যবহার পরিবেশকে দূষিত করে তুলেছে এবং পৃথিবীকে সমস্ত প্রাণীর বসবাসের অযোগ্য করে তুলছে। প্রকৃতিকে রাসায়নিক পদার্থ নিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার বিপরীতে তিনি জীববিদ্যাভিত্তিক নিয়ন্ত্রণের কথা বলেন। কারসনের বক্তব্যের মধ্যে কিছু অতিরঞ্জনের ঝোঁক থাকলে তার হুঁশিয়ারির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। জীবনযাত্রার ‘উন্নত’ অবস্থাকে চালু রাখতে যে ব্যাপক সম্পদ তৈরি করতে হচ্ছে, শিল্পে, কৃষিতে তা থেকে উদ্ভূত দূষণ প্রতিবেশকে ধ্বংস করছে। রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রচার ক্রমশ জোরদার হয়েছে এবং জৈব চাষ অর্থাৎ প্রাকৃতিক সার, কীটনাশক ব্যবহার করে কৃষিকাজের পক্ষে অনেকে মত দিয়েছেন। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, তার জন্য চাহিদা মিটানোতে এ ‘প্রাকৃতিক পথ’ যে কতটা কার্যকর সে প্রশ্নের এখনো সদুত্তর মেলেনি।
পরিবেশকেন্দ্রিক বিভিন্ন ভাবনার মূলে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান থাকলে একটি প্রচারধর্মী দর্শনের ঝোঁক এতে ছিল। ফলে অনেক সময় বৈজ্ঞানিক আলোচনা থেকে তা একদেশদর্শী ভাবনায় পরিণত হয়েছে। র‌্যাচেল কারসনের অনেক আশঙ্কা অতিরঞ্জিত, বিশেষত ডিডিটির বিরোধিতায় এ যৌগটির মানবকল্যাণে বিপুল অবদানের ইতিহাসকে অস্বীকার করা হয়েছে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের বিরোধিতায় খাদ্য সমস্যাকে উন্নাসিকভাবে অবহেলা করা হয়েছে। এটি সত্য যে, প্রকৃতির অনেক ব্যাপার খুব সুষ্ঠু নয় বরং বহু বছর ধরে মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে আন্তঃসম্পর্কে যে বিভিন্ন প্রতিবেশ-ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে তা স্বাভাবিক ব্যবস্থার থেকে কোনো অংশে খারাপ নয়। এশিয়ার কৃষিক্ষেত্রে, আমেরিকার তৃণাঞ্চল বা সাম্প্রতিক প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জে বিভিন্ন প্রজাতির বৈচিত্র্যÑ সব মানুষের প্রকৃতিতে সফল হস্তক্ষেপ।
সমাজ-অর্থনীতিকেন্দ্রিক ভাবনা : আধুনিক শিল্পজাত ও কৃষিজাত দূষণকে সীমিত রাখতে নতুন সমাজ ও জীবন দর্শনের প্রয়োজনীয়তা গত কয়েক দশকে ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। পাশাপাশি প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক বিভিন্ন সমাজব্যবস্থা, ধনতান্ত্রিক বা সমাজতান্ত্রিক যাই হোক না কেন, তার বিরোধী মতবাদগুলো পরিবেশ সমস্যাকে তাদের আন্দোলনের নতুন কেন্দ্র করে তুলেছে। পরিবেশ ভাবনা এসব বিভিন্ন ধারার মতামতগুলোকে একটি আপাত ঐক্যের সূত্রে গেঁথেছে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে পরিবেশ দূষণের সম্পর্কটি খুব নিবিড়। এ উন্নয়নের ধারা আর কতদিন চালানো সম্ভব? প্রযুক্তিনির্ভর এসব সমাজে অনেকে অনুভব করেছিল যে, সমাজ যন্ত্রের দাস হয়ে যাচ্ছে, মানুষ আর মানবিক থাকছে না। সে সমাজ হবে আনন্দময় যে সমাজ তৈরি হবে বিকেন্দ্রীভূত স্বনির্ভর জনগোষ্ঠীগুলো নিয়ে, যেখানে মানুষ তার ঘরের কাছে কাজ করবে, নিজেরা নিজেদের বিদ্যালয়, হাসপাতাল, জনসেবামূলক কাজের দায়িত্ব নিয়ে সত্যিকারের জনগোষ্ঠী গড়ে তুলবে। এ অবস্থায় এ সমাজের নাগরিকরা নিজস্ব সত্তা বিকশিত করতে পারবে, যা আজকের এ গণসমাজের নাগরিকরা হারিয়ে ফেলেছে।
যে প্রযুক্তি ছোট মাপের, মানব-শ্রমনির্ভর, বৃহৎ প্রকল্পে জড়িত নয়, যার জন্য প্রয়োজন কম পুঁজি এবং যা পরিবেশ দূষিত করবে ন্যূনতম, স্বনির্ভর, স্বশাসিত জনগোষ্ঠীর জন্য এ প্রযুক্তি-সৃষ্ট ছোট মাপের কর্মকা- মানবিক ও সুন্দরÑ এ ভাবনা পরিবেশ আন্দোলনে এক নতুন জোয়ার সৃষ্টি করেছে। এ বিকেন্দ্রীভূত স্বশাসনের তত্ত্বটি শক্তির ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রয়োগিক হচ্ছে। ফলে শক্তির শ্রেণিবিভাগ হচ্ছে কঠোর বা নমনীয় হিসেবে। নমনীয় শক্তি হচ্ছে বিকল্প শক্তি (মূলত সৌরশক্তি) যার জন্য বৃহৎ উৎপাদন কেন্দ্র (তাপবিদ্যুৎ বা পানিবিদ্যুৎ) লাগবে না যা ছোট ছোট প্রকল্পে দেশজুড়ে থাকবে, যার জ্বালানি পুনর্নবীকরণযোগ্য এবং দূষণমুক্ত।
উন্নয়ন-বিরোধিতা ও স্বনির্ভর জনগোষ্ঠীÑ এ দুটি ধারণা যথেষ্ট সমালোচিত। পশ্চিমি যথেচ্ছ উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিত উন্নয়ন-বিরোধিতায় যথার্থ থাকলে অনুন্নত দেশগুলোর কাছে তা ধনীর কৃচ্ছ্রসাধন বিলাস বলে মনে হতে পারে। এর প্রতিফলন হলো মানব-পরিবেশ সংক্রান্ত জাতিসংঘের ১৯৭২ সালে ১১২টি দেশের যুক্ত ঘোষণা। এতে পরিষ্কার করে ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর পরিবেশ সমস্যার বিভাজনের কথা বলা হয়Ñ ‘উন্নয়নশীল দেশগুলোর পরিবেশ সমস্যার কারণ হল অনুন্নত অবস্থা, অপরদিকে শিল্পোন্নত দেশগুলোতে এ সমস্যা শিল্পায়ন ও প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে জড়িত।
সহনশীল উন্নয়ন : পরিবেশ আন্দোলনের এখন একটি প্রধান লক্ষ্য হলো সহনশীল উন্নয়ন বা সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট কথাটি প্রথম ব্যবহৃত হতে দেখা যায় ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন)-এর ১৯৮০ সালের ওয়ার্ল্ড কনজারভেশন স্ট্র্যাটেজি দলিলে। এ দলিলের পুরো নাম ছিল ‘সহনশীল উন্নয়নের জন্য জীব সম্পদের সংরক্ষণ’। এর অনেক পর ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয় ওয়ার্ল্ড কমিশন অন এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের প্রকাশনা ‘আওয়ার কমন ফিউচার’ (আমাদের সবার ভবিষ্যৎ) এ রিপোর্ট থেকে সহনশীল উন্নয়ন কথাটি চালু হলো।
সহনশীল উন্নয়নে প্রকৃতি-পরিবেশকেন্দ্রিক ধারণার সঙ্গে পরবর্তী সময়ে সামাজিক বিষয়গুলো যুক্ত হয়েছে। প্রথম বসুন্ধরা সম্মেলনের ‘এজেন্ডা ২১’ সহনশীল উন্নয়নের কর্মসূচির তিন নম্বর ‘এজেন্ডা’ ছিল ‘দারিদ্র্য দূরীকরণ’, চার নম্বর ‘এজেন্ডা’ ছিল ‘ভোগের ধরন পরিবর্তন’, এমনকি ‘জনসংখ্যার পরিবর্তনও’। এরপর জাতিসংঘের বিভিন্ন দফতর তাদের বিভিন্ন উদ্দেশ্যের সঙ্গে সহনশীল উন্নয়নকে যুক্ত করে ২০০২ সালের, ‘সহনশীল উন্নয়নের জন্য বিশ্ব শীর্ষ সম্মেলন’র শেষে যে প্রধান সিদ্ধান্তগুলো প্রকাশিত হয় তার প্রথম দুটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল সহনশীল উন্নয়নের সঙ্গে দারিদ্র্য ও পরিবেশের ভূমিকা নিয়ে। এতে বলা হয়, এ শীর্ষ সম্মেলন পুনর্বার ঘোষণা করছে যে, আন্তর্জাতিক কর্মসূচির মূল বিষয় হলো সহনশীল উন্নয়ন এবং এ সম্মেলন দারিদ্র্য দূরীকরণ ও পরিবেশ সংরক্ষণে এক নতুন প্রেরণা এনেছে। এ সম্মেলনের ফলে সহনশীল উন্নয়ন সম্পর্কে ধারণাগুলো, বিশেষত সহনশীল উন্নয়নের সঙ্গে দারিদ্র্য, পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহারের যোগসূত্র আরো বিস্তৃত ও শক্তিশালী হয়েছে।
সুতরাং সহনশীল উন্নয়নের ব্যাখ্যায় যে তিনটি বিষয় যুক্ত হয়ে পড়েছে সেগুলো হচ্ছে, দারিদ্র্য দূরীকরণ, পরিবেশ সংরক্ষণ ও প্রাকৃতিক সম্পদের যোগ্য ব্যবহার। উন্নয়নের গুণাগুণ যাচাই হবে এসবের মাপকাঠিতে। সহনশীল উন্নয়নের ভাবনার মূল বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। অনেকে মনে করেন, উন্নত দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান না কমিয়ে গরিব দেশের মানুষদের সহনশীল উন্নয়ন করতে বলা অনৈতিক, এতে গরিব দেশের উন্নয়নকে থামিয়ে দেয়া হবে। সহনশীল উন্নয়নের সংজ্ঞা স্পষ্ট ও পরিষ্কার নয়, এরকম অগোছালো সংজ্ঞার সুবিধা নেবে সুবিধাভোগী শ্রেণি। উন্নত দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান না কমালে গরিব দেশের উন্নয়নকে থামিয়ে দেয়া হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট। বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরস্কার (১ম স্বর্ণপদক) প্রাপ্ত।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন