শরীফুর রহমান আদিল : গত ২০ জানুয়ারি আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন শপথ নিচ্ছেন তখন এই আনন্দ ওয়াশিংটনের পাশাপাশি উদযাপিত হয় মস্কোতেও! আন্তর্জাতিক খবরগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ওয়াশিংটনে যে পরিমাণ আনন্দের রেশ ছিল তারচেয়ে ঢের বেশি রেশ পরিলক্ষিত হয়েছে রাশিয়াতে! রাশিয়ার রাত ৮টায় মস্কো শহরে এই আনন্দ উদযাপনের সময় প্রধান স্লোগান ছিলÑ ‘ওয়াশিংটন হবে আমাদের’! আর পুরো অনুষ্ঠানটি প্রচার করে পুতিনের কট্টর সমর্থনকারী স্যাটেলাইট টিভি টসারগ্রাদ টিভি। শুক্রবার সারা রাত ধরে চলা এই পার্টি ও র্যালিতে শোভা পাচ্ছিল ট্রাম্প, পুতিন ও লি পেনের ছবি। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের শপথ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে যত না উৎসবের আমেজ ছিল তার থেকেও বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে বিক্ষোভের সুর। মস্কোর এই আনন্দ উদযাপনে আমেরিকার বিরোধী দলসহ অন্য রাষ্ট্রগুলোর বুঝতে বাকি ছিল না যে, আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্টের পেছনে আসল ব্যক্তি কে?
এসব আনন্দ উদযাপন ও আমেরিকার নির্বাচনে রাশিয়ার ইন্ধনের খবর সারা বিশ্বে যখন ছড়িয়ে পড়ছে তখন বিশ্ববাসীও অবাক চিত্তে আমেরিকার পতন দেখতে মুখিয়ে রয়েছে। কেননা, পূর্বে আমেরিকা ছোট-বড় সকল দেশের সকল বিষয়ে নাক গলাত এবং কে প্রেসিডেন্ট হবে না হবে সে বিষয়ে ভাগ্য নির্ধারণ করত আর এখন বিধিবাম হয়ে আমেরিকার রাজনীতিতে চলেছে উল্টো হাওয়া। রাশিয়া এখনো সুপার পাওয়ার দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি তবুও সুপার পাওয়ার দেশের ভাগ্য নির্ধারণে রাশিয়ার কৌশল আগামী বিশ্বকে নিজেদের হবু সুপার পাওয়ার বলেই জানান দিচ্ছে।
অনেকের মতে, ট্রাম্পকে রাশিয়া সমর্থন দিয়েছে তার প্রতিশোধপরায়ণতার জন্য। কেননা, রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভøাদিমির পুতিন জয়ী হলে রাশিয়ার রাজধানী মস্কোসহ বড় বড় শহরে বিরোধী দলগুলো প্রতিবাদ করতে নামলে হিলারি ক্লিনটন স্পষ্টই ঘোষণা করেনÑ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রযুক্তিগত ব্যাপক কারচুপি হয়েছে তখনই পুতিন এর প্রতিশোধ নেবেন বলে পণ করেন আর তখন থেকেই মূলত তিনি হিলারির বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য হ্যাকিংয়ে কোটি কোটি ডলার খরচ করেন।
অন্যদিকে, সিরিয়া কিংবা আইএস ইস্যুতে ওবামা প্রশাসনের সাথে পুতিন প্রশাসনের বরাবরই মতনৈক্য তৈরি হতো, এমনকি ট্রাম্প এমনও বলেছেন যে, আইএস ওবামা ও হিলারির সৃষ্টি। আর এর পেছনের যুক্তি হিসেবে রাশিয়ান বুদ্ধিকে কিংবা যুক্তিকেই তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন। কেননা, আমেরিকা সিরিয়ায় আইএস নির্মূলের নামে ১৬৭ বার বিমান হামলা করে একজন আইএস যোদ্ধাকেও হত্যা করতে পারেনি। কিন্তু রাশিয়া মাত্র তিনবার অভিযানেই ৮৯ জন আইএস নেতাসহ অনেক সমর্থক ও যোদ্ধাকে নির্মূল করতে সমর্থ্য হয়েছে।
আবার কাউকে কাউকে অন্য একটি কারণ বেশ জোরেই বলতে শোনা যাচ্ছে। তা হলো সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার দাঁতভাঙা জবাব প্রদান। কেননা, কয়েক বছরে আগে আমেরিকা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রায় সকল কর্মকা-ে নাক গলাত। তাদের প্রেসিডেন্ট গর্বাচেভকে হটিয়ে ইয়েলতসিনকে ক্ষমতায় বসাতে সব ধরনের সহায়তা করে সফল হয়। আর সফলতার রেশ ধরে আমেরিকা ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে দেয়। এখন পর্যন্ত যে অবস্থা তাতে রাশিয়া তার প্রতিশোধ নিতে মনে হয় উম্মুখ হয়ে আছে। তা না হলে ট্রাম্প কেন মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন? নাকি রাশিয়ার চাতুরতায় ভেঙে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র? অথবা সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার প্রতিশোধ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ভাঙার ফন্দি আঁটছেন পুতিন, যার প্রথম ঘোষণাই মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ। রাশিয়ার এসব চাতুরতা ট্রাম্প না বুঝলেও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর বিদায়ী চিফ জন ব্রেনান ঠিকই বুঝেছিলেন। তাই তার মন্তব্য হলো, রাশিয়ার হুমকি ও ফন্দি সর্ম্পকে ট্রাম্পের কোনো জ্ঞান/ধারণাই নাই। তাই তিনি টুইটারে আবোল তাবোল বা দায়িত্বহীনভাবে লিখে যাচ্ছেন। অন্যদিকে, ট্রাম্পের দুর্বল জায়গাগুলোতে আঘাত করেই রাশিয়া তার স্বার্থসিদ্ধি করতে চায়। যার প্রথম প্রস্তাবই ছিল ট্রাম্পের জন্য লোভনীয়! মস্কো ইতোমধ্যে ট্রাম্পকে তাদের সর্বোচ্চ সুন্দরীদের পতিতাস্থলে নিয়ে সেখানে বিনিয়োগের লোভনীয় প্রস্তাব দেয়। কে জানে এই লোভ ট্রাম্প সামলাতে পারবে কিনা? যে নাকি নিজের মেয়ে সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করতে ইতস্ততবোধ করে না, তার পক্ষে এই প্রস্তাব সামলানো যে দুষ্কর তা সবার কাছে মোটামুটি স্পষ্ট, যদি না ট্রাম্প তার এই লোভ সামলাতে পারেন তবে আমেরিকার ভাঙন নিশ্চিত। কেননা, নারীভোগে মত্ত কিংবা ভোগবিলাসী কোন শাসক পৃথিবীতে স্থায়ী হয়েছে সেই নজির নেই বললেই চলে। আর ট্রাম্প যদি স্থায়ী হয়ও তবে রাশিয়ার হাতের পুতুল হিসেবে তাকে বাঁচতে হবে।
পূর্বে আমেরিকা একক ও একচেটিয়াভাবে অস্ত্র ব্যবসা চালিয়ে গেলেও রাশিয়া এই বাণিজ্যে নিজেদের শক্ত অবস্থানের কথা জানান দিচ্ছে। এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ায় অনেকের ধারণা, ট্রাম্প তার ব্যবসায়িক মনোভাবকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়ে উন্নতির যুদ্ধে জিততে চাইবে। ফলে রাশিয়া এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে তাদের অস্ত্র ব্যবসাকে আরো সমৃদ্ধ করে সুপার পাওয়ার দেশ হওয়ার প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাবে। ফলে ধরে নেওয়া যায় যে, আমেরিকান কর্তৃত্ব ট্রাম্পের নেতৃত্বের মাধ্যমেই শেষ হতে চলল, যা অন্য প্রেসিডেন্ট এলেও আমেরিকাকে পূর্বের শক্তিশালী অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে রাশিয়াকে পেছনে ফেলতে পারবে না।
তবে সুপার পাওয়ার হওয়ার কাজটা খুব সহজেই মনে হয় রাশিয়া পেয়ে যাবে। কেননা, ট্রাম্প যে রাশিয়ার নিকট কিছুটা দায়বদ্ধ সেটা সবার কাছেই যেন ওপেন সিক্রেট। ব্রিটেনের সবচেয়ে প্রভাবশালী গোয়েন্দা ক্রিস্টোফার স্টিলি গত মে মাসে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনৈতিক অভিযোগ যেমন বিভিন্ন যৌন সম্পর্ক, পতিতাদের সাথে সম্পর্ক, কিংবা রিয়েল স্টেট বাণিজ্যে ঘুষের লেনদেন প্রভৃতি তদন্ত করার দায়িত্ব নিয়ে বের হয়েছিলেন কিন্তু তিনি কোনো ক্লুই পাননি! আর তার অভিযোগ, রাশিয়া সব তথ্যই হাতিয়ে নিয়েছে এবং এ হিসেবে রাশিয়াই আগামী বিশ্বের একমাত্র ক্ষমতাধর রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে এবং তাদের যে কোনো চুক্তি, পরামর্শ, কিংবা মতামত ট্রাম্প না গ্রহণ করলে তাতে তাদের হাতে থাকা এসব তথ্য ফাঁস করে দিয়ে ট্রাম্পকে ব্ল্যাকমেইল করতে পারে। ইতোমধ্যে বিশ্বখ্যাত হ্যাকার সংগঠন আনোনিমাস হুঁশিয়ার করে দিয়েছে যে, আগামী ৪ বছর ট্রাম্পকে অনুতাপে ভুগতে হবে। কেননা রুশ জঙ্গিগোষ্ঠী, শিশু পাচারকারী, ও অর্থপাচারকারীদের সাথে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত ও আর্থিক যোগাযোগ ছিল এবং এসব প্রমাণ তারা প্রকাশ করে দেবে। ফলে ট্রাম্প এক্ষেত্রে রাশিয়ার সাহায্য নিতে বাধ্য হবে। আর ট্রাম্প যদি রাশিয়ার পরামর্শে না চলে তবে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো মার্কিনিসহ সারা বিশ্বের লোকদের নিকট প্রকাশ করে দেবে। আর এ সুযোগে তার বিরুদ্ধে আনীত অন্যান্য অভিযোগ যেমন দুর্নীতি কিংবা অনৈতিক কর্মকা-ের বিরুদ্ধে বিরোধী দল রাস্তায় নামতে পারে। ফলে আরব বসন্তের মতো কোনো আন্দোলন আমেরিকান উইন্টার নাম ধারণ করলেও করতে পারে।
তার একটা ইঙ্গিত অবশ্যই ট্রাম্প নিজেই দিয়েছেন যেখানে বারাক ওবামা হ্যাকিংয়ের বিষয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষে, সেখানে ট্রাম্প বিষয়টি অযাচিত বলে এটিকে নমনীয় করার মনোভাব দেখান। অন্যদিকে, আমেরিকার স্বার্থেই ওবামা প্রশাসন জি-৮ থেকে রাশিয়াকে বাদ দিয়ে দিয়েছিল কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের যে ইঙ্গিত তাতে ধরে নেওয়া যায় রাশিয়া পুনরায় জি-৮ পরিবারের সদস্য পদ ফিরে পেতে যাচ্ছে। অন্যদিকে, আমেরিকা রাশিয়ার ওপর যে অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিল তা খুব অল্প সময়ের মধ্যে উঠে যাচ্ছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। এ ছাড়াও টিপিপি চুক্তি বাতিল রাশিয়াকে সুপার পাওয়ার হওয়ার জন্য ট্রাম্প আরো একধাপ এগিয়ে দিলেন বলতে হয়। আবার ওবামা প্রশাসনের সময় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পাওয়া সবাইকে ট্রাম্প বরখাস্ত করেন আর এ বিষয়টিকে অনেকেই রাশিয়ার ফাঁদের অংশবিশেষ বলে ভাবতে শুরু করেছেন।
ব্রিটেনের দ্যা ইন্ডিপেনডেন্ট অনলাইন এক প্রতিবেদনে দেখিয়েছে যে, রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিজেদের মতো করে তৈরি করতে দীর্ঘ পাঁচ বছর তার পেছনে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছে। আর এর অন্যতম উদ্দেশ্য হলো একটি সম্পদ হিসেবে ট্রাম্পকে রাশিয়া দাঁড় করিয়েছে, যাতে পশ্চিমা গণতন্ত্রকে খর্ব করা যায়। আর মার্কিন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বিষয়টি মনে হয় যথাযথভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। আর তাই তার বিদায়ী ভাষণে অশ্রুসজল দুই চোখে বারবার বলে গেছেন, আমেরিকার জনগণকে গণতন্ত্রের জন্য যুদ্ধ করতে হবে। এদিকে এ বিষয়ে সত্যতার জন্য টি লিভসের উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য। টি লিভস মূলত একজন কম্পিউটার বিজ্ঞানী। তিনি দাবি করেছেনÑ রাশিয়ান আলফা ব্যাংক ও ট্রাম্পের অর্গানাইজেশনের মধ্যে সার্ভারের মাধ্যমে গোপন উপায়ে যোগাযোগ চলে। তবে অনেকের মতে, রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের এই সুসম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্রকে আরো পরাক্রমশালী হতে সাহায্য করবে। কেননা, ইঙ্গ-মার্কিন জোট যেভাবে ইরাক ও আফগানিস্তান হামলা করে নিজেদের শক্ত অবস্থানের কথা জানান দিয়েছিল, ঠিক তেমনি রাশিয়া ও আমেরিকার এই সম্পর্ক আরো জোরদার হলে সারা বিশ্বে এই দুটি প্রভুত্ব বিস্তার করতে পারবে। কিন্তু সুপার পাওয়ার দেশ হিসেবে গণনা করা হবে রাশিয়াকে!
আগে ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদকে শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা মনে হলেও এখন রাশিয়ান গোয়েন্দা সংস্থা মনে হয় ইসরাইলকেও ছাড়িয়ে গেছে, এটা স্পষ্টই বোঝা গেল যে আমেরিকানরা টেকনোলজি কিংবা দূরদর্শিতার দিক থেকে রাশিয়ার চেয়ে পিছিয়ে আছে। ফলে রাশিয়া খুব সহজেই হিলারির ইমেইল হ্যাকিং করতে পারছে এবং নির্বাচনে এর শক্ত প্রভাবও বিস্তার করতে পেরেছে।
রাজপথে বিক্ষোভকারী অনেকের ধারণা, গত নভেম্বর নির্বাচনে কেবল ডেমোক্রেটিকরা হারেনি, হেরেছে পুরো আমেরিকা। অন্যদিকে একই সুরে বলা যায় এই নির্বাচনে কেবল ট্রাম্প জেতেনি বরং জিতেছে পুতিনসহ রাশিয়াও।
ষ লেখক : প্রভাষক, দর্শন বিভাগ, ফেনী সাউথ ইস্ট ডিগ্রি কলেজ
মন্তব্য করুন