মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ

উপ-সম্পাদকীয়

| প্রকাশের সময় : ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ আবদুল গফুর : গতকাল (বুধবার) থেকে শুরু হয়েছে ইংরেজি সালের দ্বিতীয় মাস ফেব্রুয়ারি। আমাদের দেশে ফেব্রুয়ারি মাস মানেই ভাষা আন্দোলনের স্মারক মাস। “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি”? না, আমরা একুশে ফেব্রুয়ারিকে কিছুতেই ভুলতে পারি না। একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের স্মারক হিসেবে আমাদের আবেগকে এতটাই নিয়ন্ত্রণ করে যে, সে ভাষা আন্দোলনকে উপলক্ষ করে আমরা একুশেকে স্মরণ করি, সেই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসটাও আমরা সঠিকভাবে জানার গুরুত্ব অনুভব করি না আবেগের আতিশয্যে।
অথচ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, তার পটভূমি ও ঐতিহাসিক তাৎপর্য আমাদের সঠিকভাবে জানা প্রয়োজন বাংলাদেশ নামের আমাদের আজকের প্রিয় স্বাধীন-সার্বভৌম মাতৃভূমির অভ্যুদয়ের ইতিহাস জানার স্বার্থেই। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়েই স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। সুতরাং স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস জানতে হলে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস পাঠের কোনো বিকল্প নেই।
আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস সম্পর্কে যারা সচেতন তারা সাক্ষ্য দেবেন ১৭৫৭ সালের পলাশী ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে পরাজিত ও হত্যা করার মধ্য দিয়ে সাত সমুদ্র তের নদীর ওপার হতে আসা ইংরেজরা আমাদের মাতৃভূমির স্বাধীনতা হরণ করে নেয়ার পর স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার লক্ষ্যে আমাদের বীর পূর্ব পুরুষরা একশ বছর ধরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই চালিয়ে যান। যারা এই সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন তাদের মধ্যে ছিলেন বাংলার মীর কাশেম, মহিশূরের হায়দার আলী, টিপু সুলতান, জিহাদ আন্দোলনের সৈয়দ আহমদ ব্রলভী, ফকীর মজনু শাহ, তিতুমীর, শরীয়তুল্লাহ, দুদু মিয়া প্রমুখের পাশাপাশি রংপুরের নুরুলদীন, সন্দ্বীপের আবু তোরাব, ত্রিপুরার সমশের গাজী প্রমুখ কৃষক নেতা। একশ বছরব্যাপী এসব স্বাধীনতা সংগ্রামের সর্বশেষ পর্যায়ে ছিল ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ।
দুঃখের বিষয় এসব স্বাধীনতা সংগ্রামে উপমহাদেশের বৃহত্তর প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দের অধিকাংশই অংশগ্রহণ ও সমর্থনদানের পরিবর্তে ইংরেজদের সঙ্গে সহযোগিতা করেন। ফলে এসব সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণ করার কারণে স্বাধীনতাকামী মুসলমানরা নব্য শাসক ইংরেজদের রোষানলে পতিত হন। সর্বশেষে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার ফলে স্বাধীনতাকামী মুসলমানদের ওপর শাসক ইংরেজদের নির্যাতনের খড়গ নতুনভাবে নেমে আসে।
নব্য শাসক ইংরেজরা পরিকল্পিতভাবে প্রশাসন, প্রতিরক্ষা, জমিদারি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি প্রভৃতি সকল গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হতে বেছে বেছে মুসলমানদের উৎখাত করে সেসব স্থানে ইংরেজ-অনুগত হিন্দুদের বসানোর নীতি গ্রহণ করে চলার ফলে ইতিপূর্বে যে সমাজে প্রচুর সচ্ছল মানুষ ছিল, সেই মুসলমানরা বাস্তবে একটি অসহায় সম্প্রদায়ে পরিণত হয়ে পড়ল। অন্যদিকে পলাশী বিপর্যয়ের কয়েক বছরের মধ্যে নব্য শাসকরা পূর্বতন ভূমি ব্যবস্থা বদলিয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নামে যে নতুন ভূমি ব্যবস্থা প্রবর্তন করল তার মাধ্যমে ইংরেজ ভক্ত এমন এক নব্য জমিদার গোষ্ঠী গড়ে উঠল, যার সিংহভাগই ছিল ইংরেজ ভক্ত হিন্দু।
 এই দুর্দশা থেকে মুসলমানদের রক্ষা করার লক্ষ্যে তদানীন্তন উত্তর ভারতের স্যার সৈয়দ আহমদ খান, বাংলার নবাব আবদুল লতিফ প্রমুখ মুসলিম নেতৃবৃন্দ সাময়িকভাবে হলেও ইংরেজদের সাথে সহযোগিতার মাধ্যমে মুসলমানদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ও উন্নত করে তোলার পথে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মুসলমানদের মধ্যে এই সহযোগিতার মনোভাবকে তাদের দুর্বলতা মনে করে একশ্রেণির ইংরেজ পাদ্রি ইসলাম ধর্ম, ইসলামের মহানবী, পবিত্র কোরআন প্রভৃতির বিরুদ্ধে অপপ্রচারে মেতে ওঠেন। দেশে তখন যে আলেম-ওলামা ছিলেন না তা নয়। কিন্তু শাসক সম্প্রদায়ের আশীর্বাদপুষ্ট খ্রিস্টান মিশনারিদের এ অপচেষ্টার বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ জানাতে এগিয়ে আসেননি। সে সময় খ্রিস্টান মিশনারিদের এ অপচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসেন যশোরের এক গ্রাম্য দর্জি, যিনি ইতিহাসে খ্যাত হয়ে আছেন মুনশী মেহেরুল্লাহ নামে। সুশিক্ষিত ইংরেজ পাদ্রিরা প্রথম দিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের মনোভাব দেখালেও একের পর এক তর্কযুদ্ধে (বাহাছ) মুন্সী মেহেরুল্লাহর কাছে পরাজয়বরণ করে ইসলামবিরোধী অপপ্রচার বন্ধ করতে বাধ্য হন।
মুন্সী মেহেরুল্লাহ শুধু খ্রিস্টান মিশনারিদের বিরুদ্ধে তর্কযুদ্ধের কারণেই নয়, তিনি সহজ সরল ভাষায় ইসলাম প্রচারের লক্ষ্যে কবিতা রচনায় উৎসাহ প্রদানের কারণেও আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন। বাংলার মুসলিম নব জাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীকে জাতীয় জাগরণী কবিতা রচনার ক্ষেত্রেও তার প্রেরণা বিশেষ কার্যকর ছিল। জাতীয় জাগরণে মুনশী মেহেরুল্লাহের প্রতি সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর এ ঋণ সিরাজী পরিশোধ করেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য সাধনায় বিভিন্নভাবে উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে। নজরুল ইসলাম স্বয়ং তাঁর সাহিত্য সাধনায় ইসমাইল হোসেন সিরাজীর এ অবদানের কথা শুধু স্বীকারই করেননি, তাকে তার পিতৃতুল্য বলে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে গেছেন।
আমরা বর্তমান নিবন্ধ শুরু করেছি আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ভাষা আন্দোলনের অবদানের গুরুত্ব বিশ্লেষণের মাধ্যমে। ইতিহাসবিদগণ এ কথা স্বীকার করবেন যে, পলাশীতে আমাদের স্বাধীনতা সূর্য অস্ত গেলেও কালক্রমে সমগ্র উপমহাদেশই ইংরেজদের পদানত হয়। ইংরেজদের সেই পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে আমরা প্রথম মুক্তি পাই ১৯৪৭ সালে। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশের হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল ভারত নামে এবং উপমহাদেশের মসুলিম অধ্যুষিত পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চল পাকিস্তান নামের দুটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ  করে। ১৯৪৭ সালে যে দুটি রাজনৈতিক দল ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দান করছিল তার একটি ছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, অপরটি ছিল নিখিল ভারত মুসলিম লীগ। প্রথমটির দাবি ছিল, সমগ্র ভারতবর্ষকে অখ- অবয়বে স্বাধীন হতে হবে। দ্বিতীয়টির দাবি ছিল, উপমহাদেশকে হিন্দু অধ্যুষিত ও মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীন হতে হবে। সেই নিরিখে আজকের বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি সাময়িকভাবে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। হাজার মাইলের ভূখ- দ্বারা বিছিন্ন দুটি ভৌগোলিক অঞ্চল নিয়ে একটি রাষ্ট্র গঠনের দৃষ্টান্ত ইতিহাসে খুব কমই দেখা যায়। এ জন্য পাকিস্তান আন্দোলনের ভিত্তিরূপী ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবেও পাকিস্তানের দুটি অঞ্চলে দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হবে বলে উল্লিখিত হয়েছিল। তবে লাহোর প্রস্তাবের আংশিক সংশোধিত রূপের সমর্থনে ১৯৪৬ সালে যে দিল্লি সম্মেলন হয় তাতে আপাতত দুই অঞ্চল নিয়ে একটি (পাকিস্তান) রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
তবে দিল্লি সম্মেলনে মূল প্রস্তাব উত্থাপনকারী জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাঁর প্রস্তাব উত্থাপনকালীন ভাষণে এক পর্যায়ে বলেন, অনেকে আমাকে প্রশ্ন করেছেন, পাকিস্তানই আমার চূড়ান্ত দাবি কিনা। এ প্রশ্নের কোনো জবাব আমি দেব না। তবে এ কথা অবশ্যই বলব, এ মুহূর্তে পাকিস্তানই আমার প্রধান দাবি। অর্থাৎ পরবর্তীকালে উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলীয় মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা তিনি বাতিল করে দিলেন না।
অনেকের মনে প্রশ্ন সৃষ্টি হয়, উপমহাদেশের বাংলা ভাষাভাষী জনপদ নিয়ে কি একটি স্বাধীন বৃহত্তর বাংলা রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব ছিল না? এর বাস্তব উত্তর হলোÑ সম্ভব ছিল এবং সেরকম উদ্যোগ নেয়াও হয়েছিল। শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম ও শরৎচন্দ্র বসুর উদ্যোগে ভারত ও পাকিস্তানের বাইর স্বতন্ত্র স্বাধীন বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্র গঠনের প্রয়াসের প্রতি লীগ নেতা জিন্নাহ সাহেবের সমর্থনও ছিল। কিন্তু গান্ধী, নেহেরু, প্যাটেল প্রমুখ অবাঙালি হিন্দু নেতা এবং শ্যামা প্রসাদ প্রমুখ বাঙালি হিন্দু নেতার প্রবল বিরোধিকার কারণে সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। তখন বাঙালি হিন্দু নেতা শ্যামা প্রসাদ এমনও বলেছিলেন, ভারত ভাগ না হলেও বাংলা ভাগ হতেই হবে। নইলে বাঙালি হিন্দুরা চিরতরে বাঙালি মুসলমানের গোলাম হয়ে যাবে। এতে বোঝা যায় বাঙালি মুসলমানের চেয়ে অবাঙালি হিন্দুর অধীনতা তাদের অধিকতর পছন্দ হয়েছিল।
এবার রাষ্ট্র ভাষা প্রসঙ্গে স্বাধীন ভারতে যে হিন্দি রাষ্ট্রভাষা হবে সে ব্যাপারে কংগ্রেস আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পাকিস্তানের ব্যাপারে কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত হওয়ার আগেই পাকিস্তানের জন্ম হয়। ভারতবর্ষ অখ-ভাবে স্বাধীন না হয়েও যেভাবে ভারত ও পাকিস্তান নামের দু’টি ষতন্ত্র রাষ্ট্র হিসাবে স্বাধীন হয় তাতেও দেখা যায় সমগ্র পাকিস্তানের ৫৬% নাগরিক বাংলা ভাষাভাষী। অথচ পাকিস্তানের উচ্চপদস্থ অফিসারদের সিংহভাগ উর্দুভাষী হওয়াতে কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত না হওয়া সত্ত্বেও গোপনে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার একটা গোপন চেষ্টা চলতে থাকে। এটা বোঝা যায় কোস্টগার্ড, মানিঅর্ডার, ফরম, এনভেলপ প্রভৃতিতে ইংরেজির পাশাপাশি শুধু উর্দুর ব্যবহার দেখে।
এই পটভূমিতেই তমদ্দুন মজলিস নামের নবগঠিত সাংস্কৃতিক সংস্থার পক্ষ হতে “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু” শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রকাশের মাধ্যমে ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ভাষা আন্দোলনের যাত্রা শুরু হয়। তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের তরুণ শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাশেম ছাড়াও উক্ত পুস্তিকায় আরো দুজনের লেখা স্থান পায়। তারা হলেন : বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন ও বিশিষ্ট  সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ। এর মধ্যে অধ্যাপক আবুল কাসেমের লেখায় ভাষা আন্দোলনের মূল দাবি তুলে ধরা হয় এভাবে : (এক) পূর্ব পাকিস্তানের অফিসাদির ভাষা হবে বাংলা, (দুই) পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার মাধ্যম হবে বাংলা, (তিন) পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা ও উর্দু।
১৯৪৭ সালেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন শাস্ত্র বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক (পরে ড.) নুরুল হক ভূঁইয়াকে কনভেনর কবে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামের যে ছাত্র সংস্থা গঠিত হয় সেটি গোড়া থেকেই তমদ্দুন মজলিস সূচিত ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। ছাত্রলীগ ভাষা আন্দোলনে যোগদানের পর তমদ্দুন মজলিস ও ছাত্রলীগের যুগপৎ সদস্য শামসুল আলমকে আহ্বায়ক করে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এ সময়ে পাকিস্তান গণপরিষদে কংগ্রেস দলীয় সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাতে বক্তৃতা দেয়ার অধিকার দাবি করলে তা নাকচ করে দেয়া হয়। এর প্রতিবাদে ১১ মার্চ সারা পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিবাদ দিবস ঘোষণা করা হয়। ১১ মার্চের প্রতিবাদ দিবস অত্যন্ত সফল হয়। রেল কর্মচারীরা ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার কারণে ওই দিন চট্টগ্রাম থেকে কোনো ট্রেন ঢাকা অভিমুখে রওনাই হতে পারেনি। সেক্রেটারিয়েট গেটে পিকেটিং করতে গিয়ে অনেকে গ্রেপ্তার ও পুলিশের লাঠিচার্জের শিকার হন। এ খবর ঢাকা শহরে ছড়িয়ে পড়লে সেক্রেটারিয়েটের চারদিক অচিরেই বিক্ষুব্ধ জনসমুদ্রে পরিণত হয়। এ অবস্থা ১১, ১২, ১৩, ১৪, ১৫ পর্যন্ত চলতে থাকলে প্রাদেশিক চিফ মিনিস্টার খাজা নাজিমুদ্দিন ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সকল দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এতে আপাতত পরিস্থিতি শান্ত হয়।
এরমধ্যে জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান প্রমুখ নেতৃবৃন্দের মৃত্যু হলে নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঢাকা সফরে এসে নাজিমুদ্দিন এক জনসভায় উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা হবে বলে ঘোষণা দিলে বাংলা-স্বার্থক জনগণ একে বিশ্বাসঘাতকতা বিবেচনা করে ২১ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ দিবস পালনের ঘোষণা দেন হয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ দিবস বানচালের লক্ষ্যে ঢাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। ভাষা আন্দোলনের ন্যায্য দাবিকে ব্যর্থ করার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বাংলা ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলে পুলিশের গুলিবর্ষণে বরকত, সালাম, জব্বার প্রমুখ ভাষা শহীদ বুকের রক্ত দিয়ে মাতৃভাষা বাংলার দাবি প্রতিষ্ঠা করে যান। এরপর কারও পক্ষে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে কথা বলার আর সাহস হয়নি। এরপর পাকিস্তানের দ্বিতীয় গণপরিষদে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতির মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত বিজয় হয়।
১৯৪৭ সালে তমদ্দুন মজলিসের প্রকাশিত “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু” শীর্ষক পুস্তিকার মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়। তাতে অধ্যাপক আবুল কাসেমের লেখায়, পাকিস্তানের ভিত্তিরূপী লাহোর প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করে জানানো হয়, এ প্রস্তাবে উপমহাদেশের পশ্চিম ও পূর্ব দিকের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ছিল। পরবর্তীতে সেই লক্ষ্যে দেশে প্রথমে স্বায়ত্তশাষিত ও পরে স্বাধিকার আন্দোলনের চেতনা জোরদার হয়ে ওঠে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ে সেই স্বাধিকার চেতনারই জয় হয়। জনগণের সেই ন্যায্য দাবিকে স্বীকৃতিদানের বদলে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী জনগণের স্বাধিকার চেতনাকে পশু বলে ধ্বংস করে  দিতে উদ্যত হলে জনগণ জীবন-মরণ সংগ্রাম করে নয় মাসের সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে। এভাবেই ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে শুরু হওয়া সংগ্রাম স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে বিজয় লাভ করে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন