মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

অভ্যন্তরীণ

হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী সুস্বাদু কাটারী মাছ

| প্রকাশের সময় : ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সরকার আদম আলী, নরসিংদী থেকে : হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী সুস্বাদু প্রাকৃতিক মাছ কাটারী। যাকে আঞ্চলিক ভাসায় কাটাইরা বলা হয়। মাছটির দেহ লম্বা, চাপা ও চেপ্টাকৃতির, মুখাকৃতি তীর্যক, মাছটির সারা শরীরে অতি ক্ষুদ্র আইশ থাকে, লম্বায় সর্বোচ্চ ১৪.২ সেন্টিমিটার হয়ে থাকে। দেহের উপরের অংশ ধুসর সবুজ, কখনো রূপালী রং’রও হয়ে থাকে। পার্শ্বদেশ বরাবর একটি অস্পষ্ট চৌড়া সাদা ডোরা রয়েছে। পাখনা স্বচ্ছ। পিষ্ঠীয় পাখনার অবস্থান পায়ূ পাখনার অগ্রভাগে অবস্থিত। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তালিকায় এ মাছের নাম নারকেলি চেলা বা চেলা মাছ। এ মাছটি একটি মিঠা পানির মাছ। পুকুর, নদ-নদী, বিল-ঝিল ও ডোবা-নালা, হাওর-বাঁওড়, ধান ও পাট খেতের স্বচ্ছ পানি ছিল এ মাছের বসবাসস্থল। একসময় এসব জলাশয়ে কাটারী মাছের ব্যাপক আধিক্য ছিল। এ মাছের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে গোসল করার জন্য জলাশয়গুলোতে নামা যেত না। পানিতে নামলে এ মাছ তেড়ে এসে সারা শরীরে ঠোকর মারত। পানিতে কোনো পোকামাকড় পড়লে ঝাঁকে ঝাঁকে কাটারী মাছ এসে সেটাকে আক্রমণ করে ছিঁড়ে ফালা ফলা করে ফেলত। এই মাছের জন্য জলাশয়ের পানিতে চাটাই, কাপড় ইত্যাদি ধোয়া যেত না। পানিতে চাটাই ফেললে এই কাটারী মাছ লাফিয়ে চাটাইয়ের উপরে উঠে যেত। লোকজন চাটাই থেকে কুড়িয়ে পেতো অন্তত, এক তরকারির মাছ। শুধু তাই নয় পানিতে নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে গামছা পেতে থুথু দিলে ঝাঁক বেঁধে কাটারী মাছ তা খেতে আসলে গামছা ছেকে ধরা হতো এসব মাছ। আর মাছ শিকারিরা ঠেলা জাল, মশারি, ধর্ম জাল, পাতলা কাপড়, ইত্যাদি দিয়ে এ কাটারী মাছ ধরে খেত। কাটারী মাছ সবচেয়ে বেশি দেখা যেত পুকুরে। সকাল বেলা পুকুর ঘাটে মানুষের উপস্থিতি টের পেলেই কাটারী মাছেরা সিঁড়িতে এসে দল বেঁধে ঘোড়াফেরা করত। মানুষ পানিতে নামলেই শুরু হতো কাটারী মাছের লাফালাফি খেলা। কাটারী মাছ খেতে খুবই সুস্বাদু। মানুষ এ মাছ ধরে পাতলা ঝোল রেধে খেত। শীতকালে সীম চিড়ি করে কেটে হালকা ঝোল দিয়ে রান্না করলে খুবই স্বাদ হতো। এই মাছ দিয়ে টমেটোর অম্বল বা টক একটি বিখ্যাত খাবার। শীতকালে বাঙালির ঘরে ঘরে টাকারী মাছের অম্বল রান্না হতো। সকালে রোদে বসে কড়কড়া ঠা-া ভাত দিয়ে কাটারী মাছের গরম অম্বল খেয়ে বাঙালিরা রসনা তৃপ্ত করত। কাটারী মাছ লাল করে ভেজে ঝোল রান্না করলে খেত বাঙালিরা। এছাড়া রসুনের কোয়া, পেঁয়াজ কাটা, কাঁচামরিচ ফেড়ে কাটারী মাছের পোড়া পোড়া রান্না তরকারি গরম ভাত দিয়ে খেলে এক বেলা জিভে স্বাদ লেগে থাকত। কিন্তু আফসোসের বিষয় এই কাটারী মাছ বাঙালি জীবন ও বাঙালি রান্না-বান্নার সংস্কৃতি থেকে ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। এখন বাজারে আর কাটারী মাছ খোঁজে পাওয়া যায় না। নরসিংদীসহ দেশের অধিকাংশ পুকুরই নগরায়নের কবলে পড়ে ভরাট হয়ে যাওয়ায় কাটারী মাছের সংখ্যা কমে গেছে। নরসিংদীর নদ-নদীগুলো শিল্পবর্জ্যে মারাত্মক দূষণের শিকার হওয়ায় নদ-নদী থেকেও হারিয়ে যাচ্ছে এই কাটারী মাছ। বিল-ঝিল, ডোবা-নালাগুলো দিন দিন ভরাট হয়ে পানি কমে যাওয়ায় সেখানেও এই মাছ এখন আর দেখা যায় না। নরসিংদীর বিশিষ্ট মাছ ব্যবসায়ী আবুল কালাম জানিয়েছেন, এখন বাজারে যা কিছু পরিমাণ মাছ বাজারে উঠে তা আমদানি হয় কিশোরগঞ্জ ও সিলেটের হাওর অঞ্চল থেকে। তবে অনেকে বলেন এসব হাওর অঞ্চলের মাছে এক ধরনের পেকড়া বা কাঁদাটে গন্ধ থাকে। সবচেয়ে সুস্বাদু কাটারী মাছ হচ্ছে মেঘনা, আড়িয়াল খাঁ, শীতলক্ষ্যা ও এর শাখা-প্রশাখার মাছ। এসব জলাশয়গুলো উপরিভাগের পানির মাছ হলো কাটারী মাছ। সাধারণত পোকা-মাকড় এবং প্লাংকটুন খেয়ে এসব মাছ বেঁচে থাকত। এখন এসব জলাশয়ের সংখ্যা কমে কাটারী মাছই হারিয়ে যাচ্ছে। বাজারে এখন আমদানি না হওয়ায় টাকারী মাছের নাম বিলুপ্তির তালিকায় উঠে গেছে। অথচ এমন একটি সুস্বাদু মাছ বাঙালি রসনা তৃপ্ত করাসহ আমিষের ঘাটতি পূরণে ছিল খুবই সহায়ক। মাছটি সহজলভ্য হওয়ায় বাঙালিরা সহজেই মাছটি ধরতে পারত এবং সহজেই রান্না করে খেতে পারত। পেশাদার জেলেরা জানিয়েছেন, মেঘনা অববাহিকায় এ মাছটি এখন খুবই কম দেখা যায়। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট যদি এ মাছটিকে চাষাবাদের আওতায় না আনে তবে এ মাছ একদিন চিরতরে হারিয়ে যাবে বাঙালির জীবন থেকে। যেমনভাবে হারিয়ে গেছে টাকা মাছ, এলগোনা, বিড়াল পটকা ইত্যাদি মাছ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন