বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

অভ্যন্তরীণ

দামুড়হুদা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য ঢেঁকি

| প্রকাশের সময় : ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

নুরুল আলম বাকু, দামুড়হুদা (চুয়াডাঙ্গা) থেকে  : দূর অতীতেও হেমন্তে নতুন ধান ঘরে ওঠার সাথে সাথে গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে পাল্লা দিয়ে  আয়োজন করা হতো পিঠা-পুলি উৎসবের। আর এ পিঠা-পুলির মূল উপকরণ আটা তৈরি করতে ব্যবহার করা হতো গ্রামবাংলার চিরচেনা ঐতিহ্যবাহী কাঠের তৈরি পরিবেশবান্ধব যন্ত্র ঢেঁকি। বর্তমানে যান্ত্রিক সভ্যতা ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় পিঠা-পুলির উৎসবের অন্যতম উপাদান গ্রামবাংলার চিরচেনা ঐতিহ্যবাহী সে ঢেঁকি আজ আর তেমন একটা চোখে পড়ে না। জানা যায়, দুই দশক আগেও দামুড়হুদার গ্রামীণ জনপদের প্রায় প্রতিটি গৃহস্থ বাড়িতেই ঢেঁকি ছিল। কালের বিবর্তনে ঢেঁকির সংখ্যা কমতে কমতে এখন পৌঁছেছে প্রায় শূন্যের কোটায়। কালেভদ্রেও আর দু-একটা চোখে পড়ে না সেই ছন্দময় সুর জাগানিয়া ধানভানার ঢেঁকি। আগেকার দিনে যখন এলাকায় রাইচমিল বা ফ্লাওয়ার মিল ছিল না তখন ঢেঁকিই ছিল গৃহস্থবাড়ির গৃহিণীদের চাল, চিড়া, চালের আটা তৈরি, হলুদ, মরিচ ও নানারকম মশলা গুঁড়ো করা, কুমড়ো বড়ি তৈরির উপকরণ তৈরিসহ নানা রকম কাজের একমাত্র ভরসা। আজ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষে ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকিশিল্প বিলীন হতে চলেছে। আগেকার দিনে হেমন্তে নতুন ধান ও খেজুর গুড় উঠলে গ্রামীণ জনপদের ঘরে ঘরে শুরু হতো পিঠা খাওয়ার ধুম। চলতো পুরো শীতকাল জুড়ে। গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় রীতিমতো পিঠা তৈরির প্রতিযোগিতা চলতো। আর ঢেঁকিতে চাল গুঁড়ো করে এই পিঠার মূল উপকরণ আটা তৈরি করা হতো। সেই আটা দিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত পিঠা বানিয়ে নিজেরা খাওয়া ও অতিথিদের আপ্যায়ন করার মজাই ছিল আলাদা। এখন আর পিঠা তৈরির মূল উপকরণ চাল গুড়া তৈরির জন্য চার পাঁচটা গ্রাম খুঁজলেও একটা ঢেঁকি পাওয়া যায় না। তাই অগত্যা কলেপেষা আটা দিয়েই তৈরি করতে হয় সেই পিঠা। কলে তৈরি আটা দিয়ে পিঠা খুব একটা ভাল হয় না এবং স্বাদও থাকে না। এয়াড়া মোটা জাতের আমন ধান দিয়ে ঢেঁকিতে চিড়া তৈরি হতো। সে চিড়ার স্বাদই ছিল আলাদা। গৃহস্থদের ঘরে ঘরে  চিড়া, খেজুরের গুড় ও ঘরে পাতা দৈ দিয়ে হতো সকালের নাস্তা। এখন চিড়া তৈরিরও মেশিন বসেছে তাতে চিড়া তৈরি হয় তবে ঢেঁকিতে তৈরি চিড়ার মত স্বাদ পাওয়া যায় না। বর্তমানে যান্ত্রিক সভ্যতার ভিড়ে ও কালের বিবর্তনে ঢেঁকি হারিয়ে যাওয়ায় গ্রামবাংলায় সে দৃশ্য এখন আর চোখে পড়ে না। আগেকার দিনে এত রাইসমিল ছিল না। বেশিরভাগ গৃহস্থ বাড়িতেই চাল তৈরি  ঢেঁকিতে ধান ভান হতো। গৃহবধূরা ভোর রাতে উঠে ঢেঁকিতে ধান ভেনে চাল তৈরি করত। সেই চাল দিয়েই সকালে ভাত রান্না হতো। অতীতে এই ঢেঁকিকে উপলক্ষ করেই রচিত হয়েছে নানারকম গান ও কবিতা। নববধূকে ঢেঁকিতে ধান ভানতে দিয়ে দাদি-নানিরা গান করতো “ও বৌ ধান ভানেরে ঢেঁকিতে পাড় দিয়া, ঢেঁকি নাচে বৌ নাচে হেলিয়া দুলিয়া...” ইত্যাদি। এক সময় গ্রামের দরিদ্র ঘরের বিধবা ও দুস্থ মহিলাদের উপার্জনের একমাত্র হাতিয়ার ছিল এই ঢেঁকি। তারা গ্রাম থেকে ধান কিনে সিদ্ধ করে শুকিয়ে ও ঢেঁকিতে ভেনে চাল তৈরি করে গ্রামে ও বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতো। ঢেঁকিছাটা চাউলের খুব কদর ছিল। কারণ ঢেঁকিছাটা চাউলে পুষ্টি বেশি। বর্তমানে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও বিদ্যুতের বিস্তার ঘটায় প্রতিটি গ্রামেই গড়ে উঠেছে রাইচ মিল। এসব রাইচ মিলে অল্প সময় ও স্বল্প খরচে ধান ভানা যায় বলে এখন আর ঢেঁকির খোঁজ করা হয় না। ঢেঁকিতে চাল তৈরি করা মহিলারা এ পেশা ছেড়ে চলে গেছে অন্য পেষায়। তবে এখনও প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে খোঁজ নিলে কোন কোন গৃহস্থ বাড়িতে দু’একটা ঢেঁকির সন্ধান মিলতে পারে। হয়ত পূর্ব পুরুষের স্মৃতি স্বরূপ বা শখের বশে কেউ কেউ বাড়ির এক কোণে দোচালা বা ছাপড়া ঘরে সযতেœ ঢেঁকি সংরক্ষন করে রেখেছেন। তবে বর্তমানে যা আছে কিছুদিন পর হয়ত তাও আর থাকবে না। গৃহস্থ বাড়ির এ ঢেঁকির ঠাঁই হবে যাদুঘরে। হয়ত সেদিন আর বেশি দুরে নয় যেদিন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের গ্রামের ছেলেমেয়েদেরকে বই-পুস্তকের গল্পের ঢেঁকি দেখাতে নিয়ে যেতে হবে যাদুঘরে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন