মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ঐতিহ্যবাহী বাংলাদেশে এখন গণতন্ত্রের মহা দুর্দিন চলছে

| প্রকাশের সময় : ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ আবদুল গফুর : স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস সন্ধান করতে গেলে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের দ্বারস্থ হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। এ কথা এখন সর্বজনস্বীকৃত যে, ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়েই ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। তবে কথাটা যত সহজে উচ্চারণ করা গেল, ঘটনাটা তত সহজে ঘটতে পারেনি। সঙ্গত কারণেই। 

১৯৪৭ সালে ১৯০ বছরের ব্রিটিশ পরাধীনতার অবসানে সাবেক ভারতবর্ষ ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীন ভারতে হিন্দি যে রাষ্ট্রভাষা হবে সে ব্যাপারে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস পূর্বাহ্নেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে সে সম্বন্ধে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে এ নিয়ে আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক চলাকালেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিলে বহু ভাষাবিদ পন্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তার তীব্র প্রতিবাদ জানান এবং তাঁর বক্তব্যের স্বপক্ষে তথ্যসমৃদ্ধ রচনা প্রকাশ করেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে উর্দুভাষীদের প্রবল সংখ্যাধিক্যের সুযোগে এ সময়ে গোপনে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্র এগিয়ে চলে। তার প্রমাণ পাওয়া যায় নতুন রাষ্ট্রের পোস্টকার্ড, এনভেলপ, মানি অর্ডার ফরম প্রভৃতিতে ইংরেজির পাশাপাশি শুধু উর্দুর ব্যবহার থেকে।
এই পটভ‚মিতে ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠিত তমদ্দুন মজলিস নামের একটি সাংস্কৃতিক সংস্থার পক্ষ থেকে “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু” শীর্ষক পুস্তিকা প্রকাশের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। এই পুস্তিকায় তিনটি প্রবন্ধ স্থান পায়। এই প্রবন্ধত্রয়ের লেখক ছিলেন তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের তরুণ শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক ড. কাজী মোতাহার হোসেন এবং খ্যাতনামা সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ। এর মধ্যে অধ্যাপক আবুল কাসেমের নিবন্ধে ভাষা আন্দোলনের মূল দাবি স্থান পায় এভাবে :
(ক) পূর্ব পাকিস্তানের অফিস-আদালতের ভাষা হবে বাংলা।
(খ) পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা মাধ্যম হবে বাংলা।
(গ) পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে দুটি : বাংলা ও উর্দু।
সমগ্র ভাষা আন্দোলন এই দাবির ভিত্তিতেই পরিচালিত হয়। অধ্যাপক আবুল কাসেম শুধু দাবি জানিয়েই বসে ছিলেন না। এই দাবির পক্ষে জনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে ব্যক্তিগত যোগাযোগ, আলাপ-আলোচনার পাশাপাশি ঘরোয়া বৈঠক ও আলোচনা সভা ছাড়াও বিশিষ্ট সুধীজনদের স্বাক্ষরসহ বাংলা ভাষার দাবিতে সরকারের কাছে মেমোরেন্ডাম পেশ ইত্যাদি এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র শিক্ষকদের নিয়ে আলোচনা সভা চালিয়ে যেতে থাকেন।
১৯৪৭ সালেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক নুরুল হক ভ‚ইয়াকে কনভেনর করে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ১৯৪৭ সালে তমদ্দুন মজলিসের একক নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন এগিয়ে যায়।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগের একাংশ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ নামে একটি স্বতন্ত্র ছাত্র সংস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই সংস্থা প্রথম থেকেই তমদ্দুন মজলিস সূচিত ভাষা আন্দোলনের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করায় তমদ্দুন মজলিস ও ছাত্রলীগের যুগপৎ সদস্য শামসুল আলমকে কনভেনর করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠিত হয়। এ সময় করাচিতে অনুষ্ঠানরত পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে কংগ্রেস দলীয় সদস্য বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাতেও বক্তৃতা দানের অধিকার দাবি করলে সে দাবি প্রত্যাখ্যাত হয়। এর বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং ১১ মার্চ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিবাদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়।
১১ মার্চের এ প্রতিবাদ দিবস বিপুল সাফল্যমন্ডিত হয়। রেল কর্মচারীরা ভাষা আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করার ফলে ওই দিন চট্টগ্রাম থেকে কোনো ট্রেনই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে পারেনি। বাংলা ভাষা সমর্থকরা সেক্রেটারিয়েটের চারদিকে পিকেটিং করার ফলে খুব কম কর্মকর্তা-কর্মচারীই সেদিন সেক্রেটারিয়েটে প্রবেশ করতে সক্ষম হন। পুলিশ পিকেটারদের ওপর লাঠিচার্জ করার ফলে আবুল কাসেমসহ অনেক পিকেটার আহত হন। এ ছাড়া পুলিশ অলি আহাদ, কাজী গোলাম মাহবুব, শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেককে গ্রেফতার করে। পুলিশের লাঠিচার্জ ও গ্রেফতারের খবর শহরে ছড়িয়ে পড়লে কিছুক্ষণের মধ্যে বিভিন্ন মহল্লা থেকে আসা প্রতিবাদী মানুষের উপস্থিতিতে সমগ্র সেক্রেটারিয়েট এলাকা বিক্ষুব্ধ জনসমুদ্রে পরিণত হয় এবং সর্বত্র অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়।
এ অবস্থা ১১ মার্চ শুরু হলেও ১২, ১৩, ১৪, ১৫ মার্চ চলতে থাকে। এতে তদানীন্তন প্রাদেশিক চিফ মিনিস্টার খাজা নাজিমুদ্দিন ভয় পেয়ে যান। কারণ ১৯ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জনারেল কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকা সফরের কথা রয়েছে। নাজিমুদ্দিন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাত দফা দাবি মেনে নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। চুক্তির শর্তানুযায়ী গ্রেফতারকৃত নেতৃবৃন্দ মুক্তি পান। ফলে পরিস্থিতি সাময়িকভাবে শান্ত হয়ে আসে।
জিন্নাহ সাহেব ঢাকায় এসে প্রথমে রেসকোর্স ময়দানে জনসভায় এবং পরে কার্জন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তনে বক্তৃতা করেন। উভয় স্থানে তিনি উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। উভয় স্থানে তাঁর এ বক্তব্যের প্রতিবাদ জানানো হয়। রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসভায় কে কোথায় প্রতিবাদ জানান তা তিনি খেয়াল না করলেও কার্জন হলে সমাবর্তনে সীমিত উপস্থিতিতে কিছু ছাত্রের প্রতিবাদে তিনি বিস্মিত হন। কারণ এই ছাত্ররাই মাত্র অল্প কিছু দিন আগে তাঁর আহ্বানে পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তিনি অবাক বিস্ময়ে কিছুক্ষণ থেমে থেকে বক্তৃতা সংক্ষেপ করে চলে যান। পরে তিনি ছাত্রনেতাদের সাথে ভাষা প্রশ্নে ঘরোয়া আলোচনায় মিলিত হন। অবশ্য উভয় পক্ষই স্ব স্ব মতে অটল থাকায় আলোচনা ব্যর্থ হয়।
তবে লক্ষ্য করার বিষয়, তিনি ওই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে প্রকাশ্যে কোন বক্তব্য দেননি। বিশিষ্ট সাংবাদিক মোহাম্মদ মোদাব্বের লিখিত “সাংবাদিকদের রোজনামচা” শীর্ষক গ্রন্থ থেকে জানা যায়, মৃত্যু শয্যায় জিন্নাহ সাহেব তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক কর্নেল এলাহি বখশের কাছে নাকি প্রায়ই দুঃখ করে বলতেন, জীবনে তিনি অন্যের কথায় দুটি বড় ভুল করেছেন। এর একটি ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা দাবির বিরোধিতা করা। কারণ ছাত্রদের দাবির মধ্যে যথেষ্ট যুক্তি ছিল। আর দ্বিতীয়টি হলো লাহোর প্রস্তাবের আংশিক সংশোধন করে পূর্ব ও পশ্চিম দুই অঞ্চল মিলে একটি (পাকিস্তান) রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। এক শ্রেণির পাঞ্জাবির মধ্যে যে মনোভাব দেখেছি তাতে দুই অঞ্চল মিলে এক রাষ্ট্র টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।
পাকিস্তান যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন সমগ্র পাকিস্তানের ৫৬% অধিবাসী বাস করত পূর্ব পাকিস্তানে এবং তাদের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। পাকিস্তানের উচ্চপদস্থ আমলাদের মধ্যে উর্দুভাষীদের বিরাট সংখ্যাধিক্যের সুযোগে সেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করে শুধু উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা ছিল গণতান্ত্রিক দৃষ্টিতে এক অমার্জনীয় অপরাধ। শুধু তা-ই নয়, পাকিস্তান আন্দোলনেও বাঙালী মুসলমানের ছিল অনন্য অবদান। অতীতের দিকে তাকালে দেখা যাবে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা সংস্থা নিখিল ভারত মুসলিম লীগের জন্ম হয় ১৯০৬ সালে ঢাকায় নবাব সলিমুল্লাহর উদ্যোগে। ১৯৪০ সালের যে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের ভিত্তি তার উস্থাপক ছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। তা ছাড়া ১৯৪৬ সালের যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তান দাবির ইস্যুকে ভিত্তি করে, সে নির্বাচনে একমাত্র তদানীন্তন বাংলাতেই মুসলিম লীগ বিজয়ী হয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে সরকার গঠন করে পাকিস্তান আন্দোলনের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তে কায়েদে আজমের হাত শক্তিশালী করতে সক্ষম হয়।
এসব ঐতিহাসিক অবদানের কারণে যেখানে পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানের প্রত্যাশা ছিল বেশি সেখানে সারা দেশের ৫৬% মানুষের মাতৃভাষা বাংলা হওয়ার পরও তাকে বাদ দিয়ে একমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা ছিল শুধু গণতন্ত্রবিরোধীই নয়, পাকিস্তান আন্দোলনে বাঙালী মুসলমানের অবদানের অবমূল্যায়নও বটে। রাষ্ট্রের অধিকাংশ নাগরিকের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করার অপচেষ্টা ছিল গণতন্ত্রের দৃষ্টিতেও সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। এসব কারণেই দেখা যায়, পাকিস্তান আমলে ভাষা আন্দোলনকে ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে আমাদের স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী জনগণের সেই স্বাধিকার-চেতনাকে এ বলে ধ্বংস করে দিতে উদ্যপশু হলে জনগণ জান কবুল করে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে নয় মাসের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে তোলে।
উপরের ইতিহাস থেকে এ কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি পরতে পরতে গণতন্ত্র ছিল আমাদের পথচলার প্রধান আলোকবর্তিকা। এই সংগ্রামের চ‚ড়ান্ত ফসল স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি স্থান লাভ করে তার মধ্যেও গণতন্ত্র সর্বোচ্চ গুরুত্ব লাভ করে স্বাভাবিক কারণে। অন্যান্য তিনটি মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকার পরিবর্তন ও সংশোধনের চেষ্টা করলেও গণতন্ত্রের গায়ে আঁচড় দিতে সাহস পায়নি কোনো সরকারই জনরোষের ভয়ে।
দুঃখের বিষয়, যে গণতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেয়া হয়েছে সংবিধানে, তাকেই বাস্তবে সবচেয়ে বেশি অবমূল্যায়ন করা হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রায় শুরু থেকে। গণতন্ত্রের মূল কথা, বিরুদ্ধ মতের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করা এবং সহনশীল থাকা। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের আমলেই সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একটিমাত্র সরকারি দল রেখে দেশে একদলীয় বাকশালী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা হয়।
পরবর্তীকালে বহু দুঃখজনক ঘটনার মধ্য দিয়ে দেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তিত হলেও একপর্যায়ে একটি নির্বাচিত সরকারকে সামরিক ক্যুর মাধ্যমে উৎখাত করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে বসেন তদানীন্তন সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সে সময় সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেই সামরিক ক্যুর প্রতি সমর্থন দান করে বসেন দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর এ কাজের সমর্থনে একমাত্র যুক্তি (কুযুক্তি) ছিল এই যে, সামরিক ক্যুর মাধ্যমে উৎখাত হওয়া নির্বাচিত সরকারের নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগের নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি। এতে প্রমাণিত হয়, নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের তুলনায় তাঁর কাছে অধিক পছন্দনীয় মনে হয়েছিল সামরিক ক্যুর নেতৃত্বদানকারী সেনাপতির শাসন। বলা বাহুল্য, এটা তার গণতন্ত্রপ্রীতির প্রমাণ বহন করে না।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মনে থাকার কথা, এর পর শুরু হয় জেনারেল এরশাদের দীর্ঘ স্বৈরাচারী শাসনকাল। একপর্যায়ে জেনারেল এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আন্দোলন শুরু করলেও আওয়ামী লীগ প্রথম দিকে এ ব্যাপারে নীরব থাকে। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগও বাস্তবতা বিবেচনায় এরশাদবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেয়। এরশাদের শাসনামলের শেষ পর্যায়ে যখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচনের প্রশ্ন ওঠে তখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দেশের এই প্রধান দুই দলের সম্মতিক্রমে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা হয়।
যেমনটা আশা করা গিয়েছিল, নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়। এই নির্বাচনে নিজস্ব ভোটকেন্দ্রে ভোটদানের পর আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে একপর্যায়ে বলেন, আমি সকল জেলার খবর নিয়েছি। নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু হয়েছে। আপনারা লক্ষ্য রাখবেন, কেউ আবার ভোটে হেরে গিয়ে এর মধ্যে থেকে কারচুপি আবিষ্কার না করে। ভোট গণনা শেষ হলে যখন দেখা গেল নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নয়, জয়ী হয়েছে বিএনপি, তখন অবলীলাক্রমে শেখ হাসিনা বলে ফেললেন নির্বাচনে সূ² কারচুপি হয়েছে। এতে বোঝা গেল সুষ্ঠু নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ পরাজিত হলে ধরে নিতে হবে নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে।
এরপর স্বাভাবিকভাবে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয় এবং শেখ হাসিনা হন বিরোধীদলীয় নেত্রী। খালেদা সরকারের মেয়াদ শেষের দিকে গেলে প্রধানত আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনার দাবির মুখেই দেশের সকল জাতীয় নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের বিধান সংবিধানে বিধিবদ্ধ করা হয়। এই বিধান মতে থেকে বেশ কয়েকটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে পালাক্রমে দুই প্রধান দল নির্বাচনে জয়ী হয়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে।
এতে প্রমাণিত হয়, বাংলাদেশের বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনই গণতন্ত্রের নিরিখে সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা। দুঃখের বিষয় এক পর্যায় এই সুন্দর ব্যবস্থাকেও অতিরিক্ত ক্ষমতা ক্ষুধার মাধ্যমে পচিয়ে ফেলা হয়। দুই প্রধান দলের দ্ব›েদ্বর সুযোগে একপর্যায়ে অসাংবিধানিক শক্তি ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশ করে সেনা-সমর্থিত সরকারের নামে সেনা-প্রভাবিত সরকার গঠন করে দেশের দুই নেত্রীকে সংসদ প্রাঙ্গণের দুই ভবনে আটক রেখে দুই দলের সংস্কারপন্থিদের নিয়ে সরকার গঠনের পাঁয়তারা চালায়। সৌভাগ্যক্রমে দুই দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের প্রবল বিরোধিতার কারণে এই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়।
এ সময়ে একপর্যায়ে শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন, আমি ক্ষমতায় গেলে অসাংবিধানিক সরকারের সকল কর্মকান্ডের বৈধতা দান করব। এরপর ঐ অসাংবিধানিক সরকারের অধীনে যে নির্বাচন হয় তাতে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেন। শেখ হাসিনা তার কথা রেখেছেন। ফলে অসংবিধানিক সরকারের হোতারা এখন স্বাচ্ছন্দ্যেই আছেন। এদিকে শেখ হাসিনা সরকার গঠনের পর একপর্যায়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায় সরকারের অধীনে নির্বাচনের পরিবর্তে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের বিধান করে সংবিধান সংশোধন করলে অতীত সমঝোতা লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে বিএনপি তার বিরোধিতা করে। তবে শেখ হাসিনা তার সর্বশেষ অবস্থানে অটল থেকে তার নিজের অতীত দাবি থেকে সরে এসে বাংলাদেশে নিয়মতান্ত্রিক গণতন্ত্রের পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এর ফলে বাংলাদেশের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় মূলনীতি গণতন্ত্র এখন মহাদুর্দিনে রয়েছে। নিজ দলীয় সরকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচন মোকাবেলায় শেখ হাসিনা সাহস না পাওয়ায় প্রমাণিত হচ্ছে, তার পায়ের তলায় যে মাটি নেই এ সত্যে তিনি বিশ্বাসী হয়ে উঠছেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন